Robbar

সুজাতা চক্রবর্তীর কণ্ঠে ‘ভুল সবই ভুল’ শ্রোতাদের বুকে আজও বেজে চলেছে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 31, 2025 3:41 pm
  • Updated:October 31, 2025 7:52 pm  
Recording of the maiden song by sujata Chakraborty

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় চুপচাপ অজয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন– ‘আমার মনে হয় গানটা না রাখাই ভালো…’ সেই দ্বিধা– কোনও যুক্তিহীন নয়। সেই যুগে নতুন কণ্ঠকে মানুষ সহজে গ্রহণ করত না। ঝুঁকিটা ছিল প্রকৃত। অজয় কর চুপ করে গেলেন কিছুক্ষণ। তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি– গানটির দৃশ্যায়ন করবেন। সম্ভবত দৃশ্যই সুরের পক্ষে কথা বলবে। টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে সবাইকে ডেকে দেখানো হল গানটি। একটা অদ্ভুত নীরবতা ছড়িয়ে পড়ল সেখানে। মানুষ অনুভব করল– সুর আর চিত্রের মাঝখানে এক নরম সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তবু সন্দেহ থাকল হেমন্তবাবুর মনে– ‘নতুন শিল্পী– দর্শক চিনবে তো?’

দেবজ্যোতি মিশ্র

৪.

ভি বালসারা। ভারতের অন্যতম সেরা এই মিউজিশিয়ান ও মিউজিক অ্যারেঞ্জারকে আমি দীর্ঘদিন ধরে কাছ থেকে দেখে এসেছি। স্টুডিওর ভেতর তাঁর উপস্থিতি ছিল নীরব অথচ নির্ধারক– মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ানো যে কোনও শিল্পীর থেকেও অধিক দৃশ্যমান। আটের দশকের প্রায় শুরুতে আমি তখন ওঁর অর্কেস্ট্রায় ভায়োলিন বাজাই। এদিকে আমি সলিল চৌধুরীর সহকারী হিসেবেও পুরোদমে কাজ করছি তখন। স্টুডিওতে আমার যাতায়াত ছিল অবাধ। ভি বালসারা মহাশয় আমাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন। তাঁর সঙ্গে দাঁড়িয়ে জীবনের সেরা মুহূর্তগুলো কাটিয়েছি। এক দুপুরের লাঞ্চের বিরতিতে, আটেক দশকে এইচএমভি (HMV) ফ্লোরে পিয়ানোর সামনে বসে ‘ভুল সবই ভুল’ গানের একটা ইমপ্রোভাইজড ভার্সন বাজাচ্ছিলেন। লাঞ্চ সেরে মিউজিশিয়ানস ফ্লোরে ফেরত আসেননি তখনও। এর দু’দিন আগেই এই এইচএমভি ফ্লোরেই সলিল চৌধুরীর সুরে হেমন্তদার পুজোর গান হয়েছে। সব মিলিয়ে একটা গল্পের পরিসর তৈরি হয়ে ছিলই। ওঁর মুখেই শুনলাম এই গল্প। গল্পটি অনেক আগের– ১৯৬২ সাল।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘নবদিগন্ত’ ছবির গান রেকর্ড চলছিল। সব ঠিকঠাক– স্টুডিও বুকড, ভি বালসারা-র তত্ত্বাবধানে ‘সুরশ্রী অর্কেস্ট্রা’ হায়ার করা হয়েছে। প্রতিটি নোট যেন আলোর মতো অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু রেকর্ডিংয়ের দিন চারেক আগে প্রযোজক জানালেন– এই গান আর তাঁরা রাখবেন না। কথাটা ছিল একেবারে হঠাৎ, এবং নিষ্ঠুরও কিছুটা। কেউ কিছু ভাবার সুযোগ পেল না।

এদিকে সমান্তরালভাবে অজয় করের ছবি ‘অতল জলের আহ্বান’ চলছে– সেই ছবির সুরও হেমন্তবাবুর। খবরটি শোনামাত্র অজয় কর প্রায় দৌড়েই এসে বললেন– ‘হেমন্তবাবু, তিনদিনের মধ্যে মহিলা কণ্ঠে একটা আবেগী গান তৈরি করে দিন। দৃশ্যায়নের প্রস্তুতি আছে। রেকর্ডিং বাতিল করবেন না।’

তারপর শুরু হল প্রশ্ন– কে গাইবেন গানটি? সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়? কিন্তু তিনি তখন শহরের বাইরে, কোথাও অন্য এক মঞ্চের আলোয়। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এদিকে সিকোয়েন্স জেনেই একটু সময় চেয়েছিলেন মাত্র– কিন্তু তাঁর কাছে সময় কবিতার মতোই নমনীয়। গান তৈরি হয়ে গেল দ্রুত।

‘ভুল সবই ভুল
এই জীবনে পাতায় পাতায়
যা লেখা সবই ভুল…’

এবার আবার সেই প্রশ্ন– গাইবে কে?
গৌরীবাবু উচ্চারণ করলেন– এক নতুন গায়িকা, সুজাতা চক্রবর্তী। নাম অচেনা। মুখও নয় চেনা। তবে গলার ভিতর কেমন যেন অনির্বচনীয় একটা আলো। হেমন্তবাবু, অজয় কর– দু’জনেই শুনলেন তাঁর কণ্ঠ। আর রেকর্ডিং শুরু হল। ভি বালসারার অর্কেস্ট্রা সেই মুহূর্তে যেন এক অদৃশ্য শৃঙ্খলার মধ্যে দাঁড়িয়ে। সুররা হাঁটছে ধীরে– আর মাঝখানে নতুন কণ্ঠ একটি নরম উজ্জ্বলতা নিয়ে উঁকি দিচ্ছে। গান শেষ হলে সবাই শান্তভাবে স্বীকার করল– এখনও অদেখা কিন্তু সুন্দর কিছু জন্ম নিল।

তবু হেমন্ত মুখোপাধ্যায় চুপচাপ অজয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন– ‘আমার মনে হয় গানটা না রাখাই ভালো…’ সেই দ্বিধা– কোনও যুক্তিহীন নয়। সেই যুগে নতুন কণ্ঠকে মানুষ সহজে গ্রহণ করত না। ঝুঁকিটা ছিল প্রকৃত। অজয় কর চুপ করে গেলেন কিছুক্ষণ। তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি– গানটির দৃশ্যায়ন করবেন। সম্ভবত দৃশ্যই সুরের পক্ষে কথা বলবে। টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে সবাইকে ডেকে দেখানো হল গানটি। একটা অদ্ভুত নীরবতা ছড়িয়ে পড়ল সেখানে। মানুষ অনুভব করল– সুর আর চিত্রের মাঝখানে এক নরম সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তবু সন্দেহ থাকল হেমন্তবাবুর মনে– ‘নতুন শিল্পী– দর্শক চিনবে তো?’ ঠিক তখন ভি বালসারা খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন– ‘এ গান থাকবে। এ গানকে সরানো যাবে না।’ যেন কোনও অতিরিক্ত ব্যাখ্যার দরকার নেই। এবং সেই একবাক্যে গানটি নিজের আসন পেয়ে গেল– ‘অতল জলের আহ্বান’ ছবিতে।

সময়ের ধুলো জমেছে সেই কাগজে, তবু আজও মানুষ মনে রাখে সেই গান। আর মনে রাখে সুজাতা চক্রবর্তীকে– যা তিনি পেলেন মাত্র একটি গানেই। আমরা অনেকেই নিজের জীবনে বহু দেওয়াল ছুঁয়ে ফিরে আসি– একটা সুযোগ আমাদের বদলে দিতে পারে। তার বেশি কিছু নয়।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সলিল চৌধুরী

আমি আজও মনে করি– গানেরও ভাগ্য থাকে। যে গান হারিয়ে যাওয়ার জন্য জন্মায় না, সে গান বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পায়ই। এই গানের মতোই। ‘অতল জলের আহ্বান’ মুক্তি পেল একদিন সকালে। কলকাতার রাস্তা ধুলো উড়িয়ে ট্রামের ঝনঝনি, আর সিনেমা হলের সামনে ছোটখাটো ভিড়। কে জানত– এক অচেনা নারীকণ্ঠ সেদিন থেকে শহরের বুকে এক সূক্ষ্ম কম্পন তৈরি করবে?

গানটা পর্দায় এল– এক গভীর আবেগের দৃশ্য– হেমন্তবাবুর সুর তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ল, ভি বালসারার অর্কেস্ট্রা গলির মোড় থেকেও যেন শোনা গেল, আর তার মাঝেই সুজাতা চক্রবর্তীর কণ্ঠ শ্রোতাদের বুকের ভিতর কোনও নরম, শব্দহীন জায়গায় গিয়ে বসে রইল।

কেউ কেউ বলল– ‘এই মেয়েটি কে?’ কেউ বলল– ‘গলার ভিতরে যেন কান্না লুকিয়ে আছে…!’ আর বাকি সবাই মুখে কিছু না বললেও চোখে স্বীকার করল এই গান প্রয়োজন ছিল। সিনেমার পরে, জনমনে উত্তাপ তারপর যা হল– বাকিটা ইতিহাস।

স্টেশনারি দোকানের রেডিও, চায়ের দোকানের গ্রামোফোন– সব জায়গায় একই সুর– সেই বহুলপ্রিয় গান, যার কণ্ঠ নতুন কিন্তু আবেগ পুরনো প্রেমের মতো চেনা।

মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল– এ গান একবার শোনা যায় না, আবার শুনতে হয়। আরও একবার। আরও একবার।

সুজাতার জীবনের আলো-ছায়া, সুজাতা চক্রবর্তী– যে মেয়ের ঘরে রেকর্ড মুক্তির আগেও কাগজে লেখা স্বপ্নগুলো একগোছা অপ্রকাশিত কবিতার মতো পড়েছিল, তার জীবনও বদলে গেল। হয়তো প্রথমদিকে দরজায় তেমন কেউ কড়া নাড়েনি– কিন্তু পোস্টম্যানের হাতে ধীরে ধীরে জমতে লাগল শ্রোতাদের চিঠি। অপরিচিত নামদের ভালোবাসা।

তিনি জানতেন– একটি গানই তার অস্তিত্ব। এবং সেই অস্তিত্ব শুনে ফেলেছে গোটা শহর।

নতুন প্রস্তাব এল। অল্প হলেও এল– কারণ সিনেমা তো অনেক, কিন্তু মানুষের মনে গেঁথে যাওয়ার সুযোগ দিনে দিনে কমে যায়। তিনি হাসতেন। চুপচাপ। কারণ জীবনের মাঝেই সেই একটি চিহ্নিত গান তাঁর সব পরিশ্রমের সার্থকতা।

স্টুডিওর ভেতরের বিস্ময়, সেই যুগে রেকর্ডিং মানে, অর্কেস্ট্রা মানেই যেন এক যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে সংগীতের পতাকা ওড়ানো। স্টুডিও ফ্লোরে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ৪০-৫০ জন বাদ্যযন্ত্রী, মাইক্রোফোনের সংখ্যা কম, ভুল করলে আবার একদম প্রথম থেকে, কোনও কাট-কপি-পেস্ট নেই। বালসারাদা দাঁড়িয়ে থাকতেন সামনে– দৃষ্টি দুটো হাওয়াকে নাড়িয়ে দিত, আর সঙ্গে সঙ্গে বেহালা-তবলা-ট্রাম্পেট একইসঙ্গে নিশ্বাস নিত।

হেমন্তবাবু ছিলেন সুরের রাজার মতো– কিন্তু তারাও কখনও কখনও নিজ সৃষ্টির ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্বিধায় পড়েন– সেই দ্বিধার ফাঁকেই গড়ে ওঠে সংগীতের কিংবদন্তি।

অজয় কর

আর অজয় কর– ছবির পরিচালক হলেও সেদিন ছিলেন গানের রক্ষাকর্তা। তিনি না হলে এই সুর হয়তো পৃথিবীর কানেই পৌঁছত না। অনেকদিন পরেও যখন কোথাও সুজাতা চক্রবর্তীর নাম লেখা হয়– এই একটি গানের নাম তার ঠিক ওপরে জ্বলজ্বলে অক্ষরে দাঁড়িয়ে থাকে।

আমার মনে হয়– গানেরও হৃদয় আছে, যে গান নিজের ভাগ্য নিজেই লিখে নিতে জানে।

হারিয়ে যেতে হতে পারে– তবু সে বাঁচে। মানুষের স্মৃতির মধ্যে। কারণ কিছু গান জন্মায় অমরত্ব পাওয়ার জন্য। এ গানটির প্রথম সুর ভেসে উঠতেই মনে হয়, দিনের ভেতর থেকে আলোটা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে– আকাশের শেষ রোদের মতো।

‘ভুল সবই ভুল’– গানটির ভেতর এক নীরব সন্ধ্যা আছে। কোনও শহরের ফাঁকা রাস্তায় একাকী পুরনো ল্যাম্পপোস্ট জ্বলে ওঠে, আর তার নিচে একজন দাঁড়িয়ে থাকে নিজের হৃদয়ের ভুল ভুলে যাওয়ার চেষ্টা নিয়ে। এই গান শুনলে হঠাৎ মনে পড়ে যায় পশ্চিমের সারেনেড– বিশেষ করে শুবের্টের সেই নিঃশব্দ আর্তি, যেখানে সুরটা কোনও দরজায় কড়া নাড়ে না– বরং চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, যদি কেউ নিজে থেকে দরজা খুলে দেয়।

গানটি শুরু হয় একটা অদ্ভুত কোমল প্রিলিউডে– যেন বাদ্যযন্ত্রগুলোও আগে একটু শ্বাস নেয় কী বলতে চায় তা ভেবে। স্ট্রিংসের ওপরে একটি অলক্ষ্য অবলিগাটো গল্প চালিয়ে যায়– তাদের ছায়া-সুর গানের প্রধান সুরকে কখনও সমর্থন করে, কখনও চ্যালেঞ্জ– যেন দু’টি মানুষ একই বেদনার পথে হাঁটছে, কিন্তু কেউ কারও হাত ধরতে পারছে না।

ভি বালসারা

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর– সেটা ছিল এক অসাধারণ বেদনার মানচিত্র। ভুলের ভিতরেও যে সত্য লুকিয়ে থাকে, সেই সত্যকেই তিনি সুরে প্রকাশ করেছেন। গানটিকে মনে হয়– কেউ খুব কাছ থেকে নিজের হৃদয়ের সঙ্গে কথা বলছে, আর আমরা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে সেই কথোপকথন শুনে ফেলছি। একটি ভুল যদি আমাদের ভেঙে দেয়– তবু সেই ভাঙা অংশের ভেতরে অদ্ভুত একটা আলো থাকে– এই গান সেই আলোর গল্প। বুকে জমে থাকা সব ‘অসমাপ্ত বিদায়’ এই সুরে ফিরে আসে– ফিসফিস করে বলে– ভুল সবই ভুল তবু– যা রয়ে যায়, সেইটুকুই সত্য।

ভাগ্যিস ভি বালসারা, অজয় কর এই গানটিকে চিনতে ভুল করেননি।

পড়ুন অফ দ্য রেকর্ড কলামের অন্যান্য পর্ব

পর্ব ১: প্রণব রায় না থাকলে ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’ ইতিহাস হত না

পর্ব ২: ‘মেরি গো রাউন্ড’ গানের রেকর্ডিং-এ গায়িকার জন্য সারাদিন অপেক্ষা করেছিলেন সুচিত্রা সেন

পর্ব ৩: গঙ্গা: সলিলের সংগীত, রাজেনের স্তব্ধতা