কেমন মনে হল, কাজের সমুদ্রে দাঁড়িয়ে আছি, ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে পায়ের ওপর কাজ সাজিয়ে দিচ্ছে। দেবুদার রেকর্ডিংয়ের দিন গেলাম দুপুর নাগাদ। তখন দেবুদার সিকোয়েন্স করে রাজানারায়ণ দেব। ‘পরশপাথর’-এরও আগে ‘চন্দ্রবিন্দু’-তে বাজিয়েছে সে। স্টুডিওতে এসে চুপ করে বসে থাকা খুব বিরক্তির। কিন্তু দেবুদা মিউজিকের প্যাটার্নটা আমার সঙ্গে ডিসকাস করতে লাগল। একবার বললাম, ‘আরে, আমায় জিজ্ঞেস করছ কেন?’ দেবুদা একটু হেসে বলল, ‘তুই যে ডিরেক্টর।’
৯.
প্রথম দু’-তিন বছর মোবাইল ছিল বড়লোকদের পকেটবন্দি, ‘তারা বাংলা’র সময় থেকে বস্তুটি মধ্যবিত্তের করায়ত্ত হচ্ছে আস্তে আস্তে। ‘মোটোরোলা’ কোম্পানির বিজ্ঞাপনের মুখ ছিল ঋতুদা। একটা বানানো গল্প, ঋতুপর্ণর হাসিমুখ-সহ বাহারি সই। এইচএমভি-র কুকুরের পর যাকে সবচেয়ে ভালোবেসেছিলাম, সেই ‘হাচ’ কোম্পানির কুকুরের তখনও আসরে নামতে বহু দেরি। এ এমন একটা সময়, যখন ইনকামিং কল-এ পয়সা নিত। ঋতুদা যখন কানেকশন নিয়েছিল, সেই সময়ই অর্ঘ্যকমল মিত্র, সুদেষ্ণা রায়ও ছিল, ফলে ওদের নাম্বারগুলো মাত্র একটা সংখ্যার এদিক-ওদিক। বন্ধুদের মধ্যে কেউ মোবাইল নিলে– সে এক বিরাট উৎসব!
তারায়, আমাদের ব্যাচ-এ বোধহয় সবার আগে মোবাইল নিয়েছিল দেবাশিস। অফিসে আরও কিছু প্রোডাকশনের লোক ছিল, যারা কানে ঢাউস একটা মোবাইল দিয়ে কথা বলত। পরে বুঝলাম, ওগুলো মোবাইল নয়, ওয়াকিটকি। সিনেমার বাইরে এ জিনিস চোখের সামনে, প্রথম। বাংলা চ্যানেলের শুটিংয়ে ইউনিট ওয়াকিটকিতে কথা বলছে, এ জিনিস এর আগে দেখেনি কলকাতা। তারা চ্যানেল আরও কিছু আঞ্চলিক ভাষায় লঞ্চ করা হয়েছিল। মোদ্দা উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দি রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারের পাল্টা একটা অবস্থান। উদ্দেশ্য হয়তো সৎ ছিল, কিন্তু বিধেয় চিরকাল নড়বড়েই থেকে গেল এ চ্যানেলের। যাক, সে গল্প পরে। কিন্তু তারার ওপেনিংটা বাঘের মতো, থুড়ি বীরেন্দ্র সেবাঘের মতোই ছিল। সমস্ত যন্ত্রপাতি আসত ‘দেব ফিচার্স’ বলে এক কোম্পানি থেকে। পরে জেনেছি, সে ছিল কপিল দেবের সংস্থা। ফলে ক্যামেরা, লাইট, বুম কিংবা লেপেলকে সমীহের চোখে দেখতাম। প্রোডাকশনে একজন কাজ করত, নাম বাবুল (সত্যি নামটা লিখলাম না)। সবার দেখাদেখি সে-ও একটা মোবাইল কিনে ফেলল। ঋতুপর্ণর বাসায় যে ধন আছে, আমার বাসায়ও তাই। মোবাইলের স্পর্শে তার আঙুল ফুলে কলাগাছ! এদিকে ভালোভাবে বুঝতে পারছে না সে নতুন যন্তরটা। দেবাশিস, কৌশিক, দেবু– প্রত্যেকে তার নতুন নতুন গল্প শোনাত। ইনকামিং কল আসার পর ঠায় চুপ করে শুনত ওপারের কথা, নিজে টুঁ শব্দটি করত না। কারণ জিজ্ঞেস করলে, খেঁকিয়ে উঠে বলত, ‘কথা তো বলিনি, পয়সাটা কাটবে কোত্থেকে!’
পড়ুন ‘রিইউনিয়ন’ পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
সেলফোনের মতোই আর এক ছোঁয়াচে রোগ তখন অফিসে ছড়িয়ে পড়েছিল। ক্রেডিট কার্ড। বিদেশি ব্যাঙ্কগুলো লোভনীয় অফারে কার্ড বিলোচ্ছিল। পয়সা না ঠেকিয়ে যে জিনিস কেনা যায়, সেই প্রথম বুঝছে বাঙালি। কী আনন্দ কী আনন্দ, যত খরচ হয়, তত মাকুন্দ। তিনমাস পরে সকলেরই বিলের বহর আকাশছোঁয়া, স্বল্প মাইনের চাকরি তখন, কী করে শুধবে সেই চিন্তায় দিন গুজরান। আমার ধারণা এই সপাটে খরচ করার ছোঁয়াচে রোগভোগ ঋতুদার থেকেই অফিসে ছড়িয়েছিল। জীবন যে আসলে এক্সট্রাভ্যাগেন্ট, জানতে শিখলাম ঋতুদাকে দেখে। মেঝেতে নাকি গ্লাস রাখতে নেই, রাখতে হয় কোস্টারে। ‘বুকএন্ডস’ কাকে বলে, জানতাম না। টিম মিটিংয়ে একটা বই পাড়তে গিয়ে দুটো পিতলের হাতল আলগা হয়ে গিয়েছে। ঋতুদা চেঁচাচ্ছে, ‘আমার বুকএন্ডসগুলোর বারোটা বাজিয়ে দিলি।’ আমি তো বুঝতেই পারছি না, কী বলছে! সম্পূর্ণ নতুন এক শব্দভাণ্ডারের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি রোজ। একেবারে বল্গাহীন ঘোড়ার মতো ছুটছে জীবন। জানলাম, তারাদের কথাই নয়, আরও একটা প্রোগ্রাম করতে হবে আমায়। সে প্রোগ্রামটার নাম ঋতুদা ভেবে রেখেছে। ‘অচেনা উত্তম’। কী হবে তাতে?
ঋতুদা বলল, ‘ভাবিস না হয়ে যাবে। বিভিন্ন জেনারেশনের লোক নিয়ে একটা ফ্যান ক্লাব তৈরি করব আমরা উত্তমকুমারের। তারা ইন্টারভিউ করবে উত্তমের কাছের মানুষদের। তুই দেবুকে ফোন কর, তোর প্রোগ্রাম দুটোর টাইটেল মিউজিক বানিয়ে দেবে।’
–বাজেট খুব কম, দেবুদা করবে?
–ফোন করে বল।
পড়ুন ‘রিইউনিয়ন’ পর্ব ৮: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ওমা, দেবুদা সত্যি রাজি হয়ে গেল! এর আগে ‘তারা করছেটা কী’র একটা অনবদ্য মিউজিক করে দিয়েছিল দেবুদা। ঋতুদা চন্দ্রিলকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর আইকন বাইকন’-এর মিউজিক কে করবে?’ চন্দ্রিল সটান বলে দিল, ‘অনিন্দ্য।’
কেমন মনে হল, কাজের সমুদ্রে দাঁড়িয়ে আছি, ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে পায়ের ওপর কাজ সাজিয়ে দিচ্ছে। দেবুদার রেকর্ডিংয়ের দিন গেলাম দুপুর নাগাদ। তখন দেবুদার সিকোয়েন্স করে রাজানারায়ণ দেব। ‘পরশপাথর’-এরও আগে ‘চন্দ্রবিন্দু’-তে বাজিয়েছে সে। স্টুডিওতে এসে চুপ করে বসে থাকা খুব বিরক্তির। কিন্তু দেবুদা মিউজিকের প্যাটার্নটা আমার সঙ্গে ডিসকাস করতে লাগল। একবার বললাম, ‘আরে, আমায় জিজ্ঞেস করছ কেন?’ দেবুদা একটু হেসে বলল, ‘তুই যে ডিরেক্টর।’
সেই প্রথম কেউ ‘ডিরেক্টর’ বলল আমায়। তড়িঘড়ি বাইরে পালিয়ে একটা সিগারেট ধরাই। কী বলছে, ‘ডিরেক্টর’! শব্দটা এত সুন্দর জানাই ছিল না। স্টুডিওতে এসে দেখি আর একজন গিটারিস্ট এসে হাজির, ‘অচেনা উত্তম’-এর জন্য বাজাবেন তিনি। গিটার ট্র্যাকটা হয়ে যাওয়ার পর, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ সুরে অসাধারণ শিস দিল। দেবুদা আলাপ করিয়ে দিল, প্রবুদ্ধ, অসামান্য গিটার বাজায়। পেশায় ইঞ্জিনিয়র।
প্রথম শুটিং করার আগেই মিউজিকের কাজ শেষ। উৎসাহে টগবগ করছি পুরো। ‘মেলোডিস্ক’ স্টুডিও থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লর্ডস মোড়ের কাছে এলাম। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড তখনও অন্ধকারে ঢাকা। সাউথ সিটি হওয়ার আগে পর্যন্ত জায়গাটা ওর’মই থাকত। একটা পিসিও বুথ থেকে ঋতুদাকে ফোন করলাম। গড়গড় করে প্রচুর কথা বলতে লাগলাম। তখনও পর্যন্ত জরুরি ফোন নাম্বার সব মুখস্থ থাকত। ঋতুদার নাম্বার ছিল ৯৮৩০০৫৬০০৪। বেশ খানিকক্ষণ বকবক করার পর খেয়াল হল, সেলফোনে ফোন করেছি। বললাম, ‘বাড়ির ফোনে করি? এটায় তো অনেক টাকা কেটে নেবে?’ ঋতুদা খুব হাসল। বলল, ‘টাকা তো এই আছে, এই নেই। টাকা খরচ হওয়ার জন্যই জন্মায়। তুই বরং প্রোগ্রামটায় মন দে, জীবনটা ঠিকভাবে খরচ কর।’