সমিতির ধর্মতলা কেন্দ্রে কয়েকদিন ক্লাস করতে এসেছিলেন লেডি রানু মুখার্জি। তাঁকে নিয়ে আমাকে বেশ বিপাকে পড়তে হয়েছিল। দু’-একদিন ক্লাসে হাজিরা দেওয়ার পর বায়না ধরলেন সমিতির ক্লাসে না, উনি আমার কাছে আলাদাভাবে পাঠ নিতে চান, এর জন্য উপযুক্ত দক্ষিণা দিতে প্রস্তুত। শর্ত: ঘণ্টা হিসেবে দক্ষিণা এবং নগদ বিদায়। তাতেও আমার তেমন একটা আপত্তি ছিল না, কিন্তু উনি ধরে বসলেন ওঁর বাড়ি গিয়ে পড়াতে হবে। এখানেই আমার আপত্তি!
১৮.
রুশ দেশের হাওয়া
১৯৫৫ সলে বুলগানিন খ্রুশশ্যোভের ভারত সফরের পর থেকে ‘হিন্দি রুশি ভাই ভাই’ স্লোগানটা এই সময়টাতে বোধহয় তুঙ্গে উঠেছিল, ততদিনে, ‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই’-এর রেশ কেটে গিয়ে ‘হিন্দি রুশি ভাই ভাই’-এর যুগ শুরু হয়ে গিয়েছিল। এরপর অন্তত আরও দীর্ঘ তিন দশক এই তরঙ্গ অব্যাহত ছিল। ১৯৬৬ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্রেজনেভের যুগের সূচনা। ইতিমধ্যে ১৯৬১ সালে পৃথিবীর প্রথম মহাকাশচারী গাগারিনের মহাকাশ পরিক্রমা এবং ১৯৬৩ সালে পৃথিবীর প্রথম মহিলা মহাকাশচারী ভালেন্তিনা তেরেশকোভার মহাকাশ পরিক্রমার ফলে বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যক্ষেত্রে আমাদের দেশের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা এবং বলাই বাহুল্য, আমাদের দেশে ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় সে দেশের সাহিত্যের ব্যাপক আমদানি ও প্রচারের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের জনপ্রিয়তা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, তা অনেক সময় হিড়িকের পর্যায়ে চলে যায়!
আমি তখন কলকাতার ৭৭ নম্বর ধর্মতলা স্ট্রিটের (তখনও ‘লেনিন সরণি’ নাম হয়নি) ভারত-সোভিয়েত সংস্কৃতি সমিতিতে নিয়মিতভাবে রুশ ভাষার ক্লাস নিচ্ছি। সাতের দশকে আমি সমিতির অন্যতম সম্পাদক। সমিতির রুশ ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্বও আমার ওপর ছিল। তখন কলকাতার আরও দু’-একটি জায়গায় রুশ ভাষা শেখানো হত ঠিকই, কিন্তু আমাদের কেন্দ্রেই ভর্তির জন্য বেশি ভিড় হত– এত বেশি হত যে, শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার ছয় মাস আগে থাকতে ভর্তির জন্য নাম লেখাতে হত। সমিতির প্রধান দপ্তর ছাড়া কলকাতার আরও কয়েকটা জায়গায়– এমনকী, কলকাতার বাইরে শ্রীরামপুর, চুঁচুড়া, আসানসোল এবং মেদিনীপুরেও (মেদিনীপুরের কেন্দ্রে রুশ ভাষা শেখাতেন অধ্যাপক অনিমেষ পাল) সমিতি থেকে রুশভাষা শিক্ষাকেন্দ্র খোলা হয়েছিল। কলকাতা থেকে আমরাও মাঝে মাঝে বাইরের কেন্দ্রগুলিতে গিয়ে রুশ ভাষার ক্লাস নিতাম। কিন্তু বিশেষ করে ধর্মতলা স্ট্রিটের কেন্দ্রে প্রার্থীদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হত। এখানকার ভাষা শিক্ষাকেন্দ্রের আরও একটি বাড়তি আকর্ষণ ছিল: ভারত-সোভিয়েত মৈত্রীর খাতিরে কলকাতার সোভিয়েত দূতস্থানের সংস্কৃতি বিভাগের রুশ কর্মীরাও এখানে সপ্তাহে দু’দিন রুশ ভাষার ক্লাস নিতেন। তাছাড়া অনেকের ধারণা ছিল, সমিতিতে ভাষা শিখতে পারলে মস্কোর পৃষ্ঠপোষকতায় সমিতির আয়োজিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সোভিয়েত দেশ ভ্রমণের, এমনকী, সেদেশে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য স্কলারশিপ জুটে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। সে ধরনের কিছু সম্ভাবনা যে একেবারেই ছিল না তা নয়, কিন্তু সে ছিল অনেকটা লটারি পাওয়ার মতো বা বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার মতো। খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থীকেই অবশ্য আমরা ভর্তি নিতে পারতাম, যেহেতু আমাদের ক্লাসরুম বলতে ছিল মাত্র দেড়খানা ঘর। কিন্তু তাতেও অনেকে দমার পাত্র নন। তাঁরা ভেতরে জায়গা না পেলে করিডরে দাঁড়িয়েও ক্লাস করতে ইচ্ছুক, কেন-না অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে যে, কোনও বিদেশি ভাষা শিক্ষার ক্লাসে কয়েক মাসের মধ্যে শিক্ষার্থীদের ভিড় অনেকটাই হালকা হয়ে আসে। শিক্ষার্থীরা নানা ধরনের জীবিকার লোক: কেউ শিক্ষক, অধ্যাপক, কেউ চাকুরিজীবী, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ সাংবাদিক, কেউ কেউ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। কারও কারও ধৈর্যে কুলোয় না, কেউ কেউ সময় দিতে পারেন না, ঘন ঘন ক্লাস কামাই করে ফেলেন, ঠিকমতো হোমটাস্ক করে উঠতে পারেন না– ফলে পিছিয়ে পড়ে খেই হারিয়ে ফেলেন– শেষকালে এক সময় ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তাই মাস কয়েকের মধ্যে ক্লাস রুমের ভিড় এবং ওই একই হারে করিডরের ভিডও ফাঁকা হয়ে আসে– দেখতে দেখতে ক্লাসরুমে সকলেরই দিব্যি ঠাঁই হয়ে যায়। শিক্ষাবর্ষের শেষে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা জন্য দশ-বারোয় এসে ঠেকত।
এই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধনে বুদ্ধিজীবীরা ছাড়াও কলকাতার শৌখিন সমাজের ব্যক্তিরাও বাঁধা পড়েছিলেন, কারণ নানা উপলক্ষে শহরের বড় বড় হোটেলে দূতস্থানের অনুষ্ঠিত ডিনার পার্টিগুলিতে তাঁরাও আমন্ত্রিত হতেন। এঁদের মধ্যে দু’-একজনের কাজ চালানো গোছের বা নিদেনপক্ষে টোস্ট করার মতো রুশ ভাষা শেখার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ ছিল।
সমিতির ধর্মতলা কেন্দ্রে কয়েকদিন ক্লাস করতে এসেছিলেন লেডি রাণু মুখার্জি। তাঁকে নিয়ে আমাকে বেশ বিপাকে পড়তে হয়েছিল। দু’-একদিন ক্লাসে হাজিরা দেওয়ার পর বায়না ধরলেন সমিতির ক্লাসে না, উনি আমার কাছে আলাদাভাবে পাঠ নিতে চান, এর জন্য উপযুক্ত দক্ষিণা দিতে প্রস্তুত। শর্ত: ঘণ্টা হিসেবে দক্ষিণা এবং নগদ বিদায়। তাতেও আমার তেমন একটা আপত্তি ছিল না, কিন্তু উনি ধরে বসলেন ওঁর বাড়ি গিয়ে পড়াতে হবে। এখানেই আমার আপত্তি! আমি প্রাইভেট টিউশন দিতাম বটে কিন্তু কারও বাড়ি গিয়ে পড়াতাম না, তাতে অযথা সময় নষ্ট হয়। শেষকালে তিনি নিজেই বললেন যে, পার্ক সার্কাসে আমার বাড়ি এসে পাঠ নিতেও তিনি রাজি আছেন। কথাটা অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে না-ও হতে পারে কিন্তু ভদ্রমহিলাকে আমার যথেষ্ট বিনয়ী বলেই মনে হয়েছিল। আমি কিন্তু কিন্তু করে রাজি হয়ে গেলাম। তবে এতে কয়েকটা অসুবিধা দেখা দিল: আমার বাড়িতে টেলিফোন ছিল না, এদিকে ভদ্রমহিলা প্রায়ই নির্দিষ্ট দিনে আসতে না পেরে কোনও রকম জানান না দিয়ে মর্জিমাফিক যেদিন খুশি আসতে শুরু করে দিলেন– আসতেন সকালের দিকে, তাই আমাকে বাড়িতে পেয়েও যেতেন। কিন্তু উনি এলেই আমার পাড়ায়, আশপাশের ফ্ল্যাটে সাড়া পড়ে যেত, অনেকেই নানা রকম কৌতূহলও প্রকাশ করত। দু’-এক সময় তাঁর পিছু ধাওয়া করে কিছু লোকজন কেন যেন হুজ্জুতিও শুরু করত– উনি ওদের খেদিয়ে দিতেন। ফলে আমি ভদ্রমহিলাকে নানা অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে যেতে লাগলাম। একবার বার্তাবহ দিয়ে উনি আমাকে একটা চিঠি লিখে পাঠালেন।
you are the most slippery teacher- you never come when you say you will come. Will you come today at 2.30 pm to my residence at 7. Harington St (Ho Chi Min Sarani). I am not far from you. I am giving up gradually all hopes of you as a teacher.
সেদিন আমি ওকে ওঁর বাড়িতে ফোন করে জানাই হ্যারিংটন স্ট্রিটে নয়, একাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ পাঠ দিতে রাজি আছি। উনি তাতেই রাজি। সপ্তাহে একদিন যেতাম, তবে সন্ধ্যার দিকে সেখানে তো অনুষ্ঠান লেগেই থাকত, তাই সন্ধ্যার আগে আগেই যেতে হত। উনি আমাকে একাডেমির যে কোনও অনুষ্ঠানে যে কোনও দিন প্রবেশের একটা ছাড়পত্র লিখে দিয়েছিলেন। আমি সেটা কোনও দিনই কাজে লাগাইনি। তাতে তিনি ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। তবে যা-ই হোক, খুব একটা বেশিদিন তাঁকে পাঠ দিইনি– যথারীতি তেমন একটা ফাঁক পেতেন না– অনেক সময়েই পাঠ নিতে পারতেন না, কিন্তু তাই বলে খালি হাতে ফিরিয়েও দিতেন না। সে এক বিড়ম্বনা অবশ্য। সেই সময়ের মধ্যে কাজ চালানোর মতো ভাঙা ভাঙা রুশি তিনি শিখেও গিয়েছিলেন।
ভারত-সোভিয়েত মৈত্রীর কল্যাণে এই সময় আরও এক ধরনের অস্বস্তিকর কাজ আমার কপালে জুটেছিল: অন্যের বকলমে রুশ ভাষায় প্রেমপত্র লিখে দেওয়া এবং রুশ ভাষায় লেখা প্রেমপত্রের অনুবাদ করে দেওয়া। বাণিজ্য জাহাজে কর্মরত আমাদের দেশের অনেক অল্পবয়সি নাবিক সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্দরে গিয়ে স্থানীয় মেয়েদের প্রেমে পড়ে যেত। কেউ কারও ভাষা বোঝে না। যুবকেরা দেশে ফিরে আসার পর চিঠিপত্র চালাচালি হত। ওদিক থেকে চিঠি আসত রুশ ভাষায়, আবার জবাবও লেখা চাই রুশ ভাষায়– অতএব মাঝখানে একজন দোভাষী বা অনুবাদক দরকার। কাজটা বেশ মজার লাগত। ওরা যেমন যেমন বলত, অনেক সময় তার চেয়েও বেশি আবেগ ঢেলে দিতাম। শেষ পর্যন্ত কে কতটা সফল হয়েছিল, তা অবশ্য অনুসরণ করতে পারিনি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ভারত-সোভিয়েত মৈত্রীর কল্যাণে এই সময় আরও এক ধরনের অস্বস্তিকর কাজ আমার কপালে জুটেছিল: অন্যের বকলমে রুশ ভাষায় প্রেমপত্র লিখে দেওয়া এবং রুশ ভাষায় লেখা প্রেমপত্রের অনুবাদ করে দেওয়া। বাণিজ্য জাহাজে কর্মরত আমাদের দেশের অনেক অল্পবয়সি নাবিক সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্দরে গিয়ে স্থানীয় মেয়েদের প্রেমে পড়ে যেত। কেউ কারও ভাষা বোঝে না। যুবকেরা দেশে ফিরে আসার পর চিঠিপত্র চালাচালি হত। ওদিক থেকে চিঠি আসত রুশ ভাষায়, আবার জবাবও লেখা চাই রুশ ভাষায়– অতএব মাঝখানে একজন দোভাষী বা অনুবাদক দরকার। কাজটা বেশ মজার লাগত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
শুধু রুশ ভাষা শিক্ষার জন্য নয়, আরও একটি কারণে এই সময় সমিতির সদস্যপদ লাভের জন্য হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। ভারত সরকারের সঙ্গে সোভিয়েত সরকারের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের কর্মসূচি স্বাক্ষরিত হওয়ার ফলে কখনও সোভিয়েত সার্কাস, কখনও সে দেশের লোকনৃত্য, সংগীত, ব্যালে ইত্যাদি অনুষ্ঠান আমাদের দেশের বিভিন্ন শহরে প্রায়ই লেগে থাকত। প্রচণ্ড ভিড় হত। মানুষজন টিকিটের জন্য হা-পিত্যেশ করে মরত। এরই মধ্যে সরকারের মৌখিক সম্মতিতে হোক বা যে কোনও ভাবেই হোক, আলাদা করে আমাদের সমিতিও ওরকম দু’-একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করার দায়িত্ব পেত। সেখানেও টিকিটের জন্য হুড়োহুড়ি, কিন্তু সমিতির সদস্য হলে অগ্রাধিকার পাওয়া যেত।
এইরকম একটা অনুষ্ঠানের শিল্পীদের অনুশীলনের দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল। খুব সম্ভব ১৯৭১ সাল। শহরে বলশয় থিয়েটারের ট্রুপ এসেছে। ভারত সোভিয়েত সংস্কৃতি সমিতি একদিনের জন্য ট্রুপের ব্যালে অনুষ্ঠান অয়োজনের সুযোগ পেয়েছিল। কর্মকর্তা ও ব্যালে শিল্পীদের মিলিয়ে জনা পঁচিশের একটি দল। সামলানো দায়, তার ওপর টিকিটের জন্য ভিড় তো লেগেই আছে। এছাড়া আরও একটা অসুবিধা দেখা দিয়েছিল: কলকাতায় ব্যালে নৃত্যানুষ্ঠান পরিবেশনের উপযোগী প্রশস্ত মঞ্চই খুঁজে পাওয়া দায় হয়ে উঠেছিল– গ্রিনরুমগুলিও নাকি যথেষ্ট প্রশস্ত নয়। ব্যালে শিল্পী দলের কর্মকর্তাদের কোনও হল ঘরই মনঃপূত নয়। যা হোক করে রবীন্দ্রসদনে রাজি করানো গেল, তবে মঞ্চের এবং মঞ্চের আড়ালে গ্রিনরুমের অনেকখানি অদলবদল করতে হল। শ’খানেক টাওয়েলেরও ফরমায়েশ হল, যদিও আমরা বুঝতে পারলাম না ওগুলো কোন কাজে লাগবে! অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে থেকে গ্রিনরুমে শিল্পীদের অনুশীলন শুরু হয়ে গেল। ঘরে দিব্যি ঠান্ডা, কিন্তু অনুশীলনটা এতটাই শ্রমসাধ্য যে, শিল্পীদের সর্বাঙ্গে ঘাম ঝরতে শুরু করে দিয়েছে, তাঁরা ঘন ঘন টাওয়েল দিয়ে শরীর ও মুখের ঘাম মুছছেন: এতক্ষণে টাওয়েলের রহস্য বোঝা গেল! অনুশীলন শেষ হতে না হতে প্রায় কোনও বিরতি না দিয়েই তাঁরা একে একে মঞ্চে নেমে অনুষ্ঠান পরিবেশন করতে শুরু করলেন– এটাই নাকি নিয়ম, এ না হলে হাত-পায়ের খিল ছাড়ানো যায় না। উইংসের আড়ালে দাঁড়িয়ে আমরা যখন দর্শকদের তুমুল করতালিধ্বনি শুনতে পাচ্ছি, আমার তখন কেবলই মনে হচ্ছিল নৃত্যশিল্পীদের বোধহয় এতক্ষণে নাভিশ্বাস উঠছে। মনে হয়েছিল এ-ও তো এক ধরনের বুর্জোয়া বিলাসিতা! দেখে-শুনে ব্যালের প্রতি আমার ভক্তি চটে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু সেটা বোধহয় সাময়িক প্রতিক্রিয়া। এরপর সোভিয়েত দেশে গিয়ে ব্যালের অনুষ্ঠান অনেক দেখেছি, দেখে মুগ্ধ হয়েছি। বিশেষত চাইকোভস্কির ‘সোয়ান লেক’, মায়া প্লিসেৎস্কায়ার মতো ব্যালে নৃত্যশিল্পীর অনুষ্ঠানের তো কোনও তুলনাই হয় না। আশ্চর্য! আর্ট কি তাহলে একশ্রেণির মানুষের প্রবল আকুতিবশত এমন এক আত্মাহুতি, যাতে শিল্পী নিজেকে নিংড়ে দিয়ে আনন্দ পান, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আনন্দ উপভোগ করেন আরেক শ্রেণির মানুষ– তার উপভোক্তারা? অবশ্য উপভোগের প্রকৃতিও অনেকাংশে নির্ভর করে উপভোক্তার মানসিকতার ওপর।
ওদেশে এই সমস্ত অনুষ্ঠানগৃহে দর্শকদের অনেক আসনই মঞ্চ থেকে এতটা দূরে থাকে যে, খালি চোখে দেখতে গেলে বেশ খানিকটা কষ্ট করতে হয়! এই কারণে অপেরা গ্লাস-এর সাহায্য নিতে হয়। হল-এ ভাড়া পাওয়া যায়। কোনও কোনও দর্শক নিজেরাই বাড়ি থেকে নিয়ে আসেন।
আমাদের দেশের এক বিশিষ্ট লেখক ছয়ের দশকের কোনও এক সময় সোভিয়েত দেশ ঘুরে এসে তাঁর স্মৃতিকথায় এই প্রসঙ্গে লিখলেন যে, স্বল্পবসনা নর্তকীদের অন্তর্বাস দেখার জন্যই নাকি এর সাহায্য নেওয়া হয়। কিছু বলার নেই– ঠাকুর ঠিকই বলতেন: ‘যেমন ভাব তেমনি লাভ’।
…পড়ুন রুশকথার অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৭। একদিন হঠাৎ সুভাষদা আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে নিয়ে
পর্ব ১৬। মুখের সেই পরিচিত হাসিটা না থাকলে কীসের সুভাষ মুখোপাধ্যায়!
পর্ব ১৫। রুশ ভাষা থেকেই সকলে অনুবাদ করতেন, এটা মিথ
পর্ব ১৪। মস্কোয় ননীদাকে দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিদেশি, ভারতীয় নয়
পর্ব ১৩। যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি অনুবাদক
পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি