জেলের ভেতরে যখন যাই ছোট ছোট ছেলেদের কাছে, যাদের বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই, তাদের আমার মানুষের মতো মানুষ মনে হয়। দে আর রিয়েল পিপল। ওরা যা, ওরা তাই। বাইরে আমরা মুখোশ পরে থাকি। ভেতরটা আসল জগৎ। সেই জন্যই আমার ভেতরটা এত ভালো লাগে।
৬.
যারা যুবাশ্রম বা কিশলয়ে আছে, তাদের আমি ততটা সময় দিতে পারি না। আর ওরা তো দোষ করেনি, ওদের উদ্ধার করে আনা হয়েছে। কিন্তু হোমে থাকে বলে, এটা বন্দি জীবনই বলা যেতে পারে। যেখানে-সেখানে যাওয়ার স্বাধীনতা ওদের নেই। ইচ্ছেমতো থাকার অনুমতি নেই ওদের। সেটা কিন্তু ওদের নিরাপত্তার জন্য। আর যারা দোষ করে এখানে এসেছে, তারা কিন্তু বারেবারে কিছু না কিছু করে ভেতরে চলে আসে। সবাই ওদের দিকে আঙুল তোলে, কিন্তু সাধারণ মানুষ কোনও দিনও জানার চেষ্টা করেনি কেন ওরা বারবার জেলের ভেতরেই চলে আসে। ১৪-১৫ বছরের ছেলে সব। ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর ওরা কোনও দিশা খুঁজে পায় না। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়, স্কুলে ফিরে যেতে পারে না, বন্ধুবান্ধবরা মেশে না। তখন যেটা হয়, যারা ওদের গ্রহণ করেছিল, যারা খারাপ মানুষ, ওরা সেখানেই ফিরে যায়। কারণ একমাত্র ওরাই গ্রহণ করেছিল। আবারও একটা ভুল করে, আবারও জেলে ঢোকে। আমরা যারা সমাজের কথা ভাবি, সমাজের ভাল করতে চাই, অপরাধহীন কাঠামো তৈরি করতে চাই, তাদের কিন্তু এদের দিকে তাকাতে হবে। এই জায়গায় সংশোধন আনতে হবে। আমাদেরও আরও অনেক অনেক মানবিক হতে হবে। আমরা ছোট মেয়েদের জন্য অনেক কিছু করার কথা ভাবি, আমাদের ছোট ছেলেদের জন্যও ভাবতে হবে। ছোট ছেলেরাও সমানভাবে অ্য়াবিউজড হয়, ওদেরও পাচার করা হয়। আমরা যদি ছোটবেলা থেকে তাদের মন তৈরি করতে না পারি, যথাযথ মানবিক শিক্ষা না দিতে পারি, তাহলে ওদেরকেই বিপদের দিকে ঠেলে দেব, অপরাধ বাড়িতে তুলব। এমনকী, ছেলেদের প্রকাশ করাতেও সমাজের মানা। তারা তাদের দুঃখটা চেপে রাখে। ওদের যদি নিরাপত্তা না দিতে পারি, তাহলে মেয়েদের নিরাপত্তাও আমরা সুরক্ষিত করতে পারব না।
এখনকার ছেলেমেয়েদের যত দেখি, তত কষ্ট হয়। ওদের কোনও ছোটবেলা নেই, ওদের কল্পনার দুনিয়া নেই। আমরা কিন্তু একদম অন্যরকম ছোটবেলা কাটিয়েছি। আমাদের সময়টা ডিজিটাল দুনিয়া ছিল না। তখন মানুষ মানুষের সঙ্গে মিশত, কোনও সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের সঙ্গে মিশত না। জেলের ভেতরে যখন যাই ছোট ছেলেদের কাছে, যাদের বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই, তাদের আমার মানুষের মতো মানুষ মনে হয়। দে আর রিয়েল পিপল। ভিতরে যারা থাকে, তারা আর যাই হোক, মুখোশ পরে থাকে না। ওরা যা ওরা তাই। বাইরে আমরা মুখোশ পরে থাকি। ভেতরটা আসল জগৎ। সেই জন্যই আমার ভেতরটা এত ভালো লাগে। ওদের মধ্যে কোনও ছলচাতুরি নেই। অন্তত আমার সঙ্গে কোনও ছলচাতুরি নেই। কত সময় আমার সঙ্গে ঝগড়া করে, তর্ক করে, রাগ করে চলে যায়। তারপর কিছুক্ষণ পরে আমার পাশে এসে বসবে। বলে, ভেতরে থাকি তো, মাঝে মাঝে মাথা গরম হয়ে যায়। আমি বলি, আমার সামনে মাথা গরম করবে না তো কার সঙ্গে করবে?
ভেতরে গিয়ে আমি বোধহয় অনেক বেশি পেয়েছি, ওরা আমার থেকে যা পেয়েছে, তার তুলনায়। বাইরেই যদি আমি শুধু নাচ শেখাতাম, আর পারফর্ম করতাম, তাহলে আমার এই আত্মশুদ্ধিটা হত না।
আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে আমার নাচকে দেখার ভঙ্গিটাও বদলে গিয়েছে। আমি আর দেখি না দর্শকাসনে ক’জন বসে আছে। ওদেরকেও আমি এটাই শেখাই। তোমাদের দেখার দরকার নেই আসনের দিকে। যদি চারটে লোকও আসে, তারা সমান এক্সপেক্টেশন নিয়ে এসেছে, ওই চারজনের জন্যই তোমরা তোমাদের সবটা ঢেলে নাচবে। সবাই ভালোবেসে এসেছে। আমার নাচটাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে। আমার নাচ আমার কাছে নৃ্ত্যাঞ্জলি, আমার পুজো। আমি তো তাছাড়া পুজোআচ্চা করি না। নাচ আমার কাছে ঈশ্বরের সঙ্গে যোগসূত্র।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved