গঙ্গাবক্ষের ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে সময়-সময় এ শহরের দর্পণ মনে হয়। ওয়াংখেড়ে কিংবা ফিরোজ শাহ কোটলার ছবিতে মুম্বই-দিল্লির ছায়া পড়ে কি না, জানা নেই। তবে ইডেনে পড়ে, কলকাতার ছায়া। চলনে-বলনে, আবেগে ধরনে, ইডেন বাড়াবাড়ি রকমের বাঙালি। তার বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন। বাঙালির মতোই সে কখনও উদাত্ত। কখনও নিরুত্তাপ। কখনও সচেষ্ট। কখনও অলস। কখনও পক্ষপাতী। কখনও নিরপেক্ষ। কখনও দেশপ্রেমী। কখনও শুধুই ক্রিকেটপ্রেমী।
তিরতিরে তিস্তার আদুরে আবেগ মেখেছেন গায়ে? অভিমানী প্রেমিকা কখনও ছিল আপনার? বাড়িতে রাগী বড়দা আছে? ছাত্রবেলায় পাল্লায় পড়েছেন সাক্ষাৎ বিপ্লবের, পেয়েছেন তার বিদ্রোহী আঁচ?
পেলে পেয়েছেন। ভাল। না পেলে যান, ইডেন আছে!
ইডেন, ওহ্ ইডেন। তোমার ইডেন। তোর ইডেন। আমার ইডেন। আপনার ইডেন। অজয় বসুর ইডেন। পুষ্পেন সরকারের ইডেন। ভিভিএসের ইডেন। আজহারের ইডেন। শান্তির ইডেন। অশান্তির ইডেন। ভালবাসার ইডেন। ঘৃণার ইডেন। বিদ্রোহের ইডেন। বৈরাগ্যের ইডেন। সর্বোপরি, বাঙালির ইডেন। বাঙালিয়ানার ইডেন!
গঙ্গাবক্ষের ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে সময়-সময় এ শহরের দর্পণ মনে হয়। ওয়াংখেড়ে কিংবা ফিরোজ শাহ কোটলার ছবিতে মুম্বই-দিল্লির ছায়া পড়ে কি না, জানা নেই। তবে ইডেনে পড়ে, কলকাতার ছায়া। চলনে-বলনে, আবেগে, ধরনে, ইডেন বাড়াবাড়ি রকমের বাঙালি। তার বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন। বাঙালির মতোই সে কখনও উদাত্ত। কখনও নিরুত্তাপ। কখনও সচেষ্ট। কখনও অলস। কখনও পক্ষপাতী। কখনও নিরপেক্ষ। কখনও দেশপ্রেমী। কখনও শুধুই ক্রিকেটপ্রেমী।
এ পেশায় আসার পর দু’-তিনটে এমন অমর মুহূর্তের সাক্ষী থেকেছি, যার লয়-ক্ষয় সম্ভব নয়। তার আগেও শুনেছি, খবরের কাগজে পড়েছি। দেখা দিয়ে শুরু করে শোনায় যাওয়া যাবে পরে। ৫ মে, ২০১২ যেমন। ক্রিকেটে বাঙালির বঙ্গভঙ্গের দিন। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বনাম কেকেআর-কে মাধ্যম করে ইডেন সেদিন যে কলকাতা বনাম কলকাতার দুর্লভ ছায়াছবি উপহার দিয়েছিল, ভারতের অন্য কোনও শহরে ইহজীবনে সম্ভব? শাহরুখ খান সে রাত্তিরে সৌরভের হাত ধরে ইডেন পরিক্রমায় নেমে না পড়লে, ‘আমার সৌরভ’ বনাম ‘তোমার কেকেআর’-এর হাল্লা-যুদ্ধ চলতও আরও, গড়াত রাত। ক্রোধের ইডেনও দেখিনি কি? বেশ মনে পড়ে কেকেআরে সৌরভ ‘ব্রাত্যজন’ হওয়ার পর তাঁর হয়ে ‘ক্রুদ্ধসংগীত’ গেয়েছিল আর কেউ নয়, ইডেন! আইপিএলে মাঠ ফাঁকা করে দিয়ে! কী খুঁজছেন এবার, মেঘ-ঘন ক্রিকেট-প্রেম? ইডেন ২০০১-এ ফিরে যান। ভারতীয় ক্রিকেটের শ্বাস-প্রশ্বাস পড়বে যতদিন, স্টিভ ওয়ার অশ্বমেধের ঘোড়াকে সৌরভের ভারতের ‘বশীকরণ’ কাহিনি জীবিত থাকবে ততদিন। ভিভিএস-দ্রাবিড়-হরভজনে অলৌকিক সেই জয় সম্ভবই হত না, ইডেন-আত্মা জেগে না উঠলে। ওটা তাই বাদ থাক। তার বাইরেও এ মাঠের অত্যাশ্চর্য ক্রিকেটপ্রেমের স্বাক্ষরও পেয়েছি অঢেল। তখন সৌরভ সিএবি প্রেসিডেন্ট। ইডেনে বিরাট কোহলির আরসিবি বনাম কেকেআর ‘মল্লযুদ্ধ’ চলছে। কোহলি আর এবি ডে’ভিলিয়ার্স মিলে ছাতু করে দিচ্ছিলেন নাইট বোলারদের। লোয়ার টিয়ারে দাঁড়িয়ে হতচকিত আবিষ্কার করেছিলাম, ইডেন ঘুরছে! প্রিয় টিমের প্রতি স্নেহ বিসর্জন দিয়ে, ক্রিকেটের নন্দনকানন অবলীলায় ঘুরে যাচ্ছে নান্দনিক ক্রিকেট অভিমুখে! দৌড়ে সৌরভের ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, চলছেটা কী? স্মিত হাস্যে উত্তর আজও কানে বাজে, ‘প্লেয়ার্স, ইটস প্লেয়ার্স হু ম্যাটার্স!’
শতভাগ সত্য। দিন শেষে ইডেনের কাছে প্লেয়ার সত্য, ক্রিকেট সত্য, জগৎ মিথ্যা! বিশ্বাস না হলে, প্রাক্তন পাকিস্তান কাপ্তান আসিফ ইকবালকে জিজ্ঞাসা করুন। কথাবার্তার সময় ভদ্রলোক একটা কথা প্রায়শই বলেন, ‘আপনি ক্যালকাটার লোক, একটা কথা বলি আপনাকে। ইডেনকে আমি মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ভুলতে পারব না।’ ভুলবেন কী করে ইকবাল সাহেব? ক্রিকেট থেকে আসিফের অবসরের দিন যে উদারতা দেখিয়ে ‘স্ট্যান্ডিং ওভেশন’ দিয়েছিল ইডেন, তা লাহোরেও পেতেন কি না সন্দেহ! পরস্পর-বিরোধী আবেগ-স্ফূরণের উদাহরণও কত শত। কেন, ছিয়ানব্বই বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল মনে নেই? বিনোদ কাম্বলির সঙ্গে যখন মিশে গিয়েছিল ইডেনের কান্না। যন্ত্রণার অনলে ‘আত্মহুতি’ দিয়েছিল সে দিন ইডেন, সাধের ক্রিকেটকে নিশ্চল করে দিয়ে। আক্রোশের আগ্নেয়গিরি ইডেন জ্বালিয়ে দিয়েছিল আরও একবার, শচীন তেণ্ডুলকর নামক ‘সন্তান’-এর প্রতি পাকিস্তানি অবিচারের প্রতিবাদে। ইডেনকে শান্ত করতে স্বয়ং শচীনকে বেরতে হয়েছিল নিরানব্বইয়ের সে দুপুরে, খেলা শুরুর অনুনয় নিয়ে। আবার এই একই ইডেন, ভারতীয় টিম থেকে সৌরভ বাদ পড়ার পর ধকধকে জিঘাংসা নিয়ে রাহুল দ্রাবিড়ের ভারতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কাগজে পড়া। শোনা যায়, সবুজ পিচে দক্ষিণ আফ্রিকা পেস ব্যাটারি নামক লেলিহান শিখার মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল দ্রাবিড়ের ভারতকে। যাকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছিল এক-একটা ভারতীয় উইকেট পতনের পর উল্লাসের তোপধ্বনি! এতটাই যে, পরের ম্যাচ খেলতে গিয়ে নাকি দ্রাবিড় বলেছিলেন, ‘যাক বাবা, ভারতে ফিরলাম!’
বলবেন কী একে? ইডেনের এই ‘নাদান’ আবেগকে? দুরন্ত কিশোরের মতো যা এদিক-সেদিক ছুটে যায়, এ পাড়া থেকে ও পাড়ায়। যে যখন যা ইচ্ছে, তাই করে। কখনও ‘অচ্ছুত’কে কাছে টেনে নয়। কখনও ‘প্রিয়তম’কে দূরে ঠেলে দেয় (দু’বার আইপিএল দেওয়ার পরেও গৌতম গম্ভীরকে ইডেনের বিদ্রুপ গিলতে হয়েছে)। দেশ-সমাজের শর্ত মানে না যে, দেশপ্রেমের খুঁতখুঁতে হিসেব বোঝে না যে। মর্ত্যে হয় না এ জিনিস, পৃথিবীতে সম্ভবই হয় না। ব্রহ্মাণ্ডের আইনকানুন চলে না মাত্র এক জায়গায়। আর তাই অজয় বসুরা ভুল বলতেন। ভুল বলতেন যে, ‘নমস্কার, আমি ইডেন উদ্যান থেকে বলছি।’ বলা উচিত অন্য।
নমস্কার, আমি স্বর্গোদ্যান থেকে বলছি!
রিয়েঙ্কা ইউক্রেনের স্থানীয় ফুটবল দল নাইভা-র হয়ে গলা ফাটাত মাঠে গিয়ে। যুদ্ধের সময় চার মাস রুশ সেনার অধীনে বন্দিত্ব এবং ছাড়া পেয়ে ফ্রন্টলাইনে রাইফেল নিয়ে থাকা। গত ২১ মে মাত্র ২১ ছোঁয়া রিয়েঙ্কা চলে যায় গানশটে! গ্যালারিতে সেই মুখ, টিফো– লেখা– ‘পিস হ্যাজ আ প্রাইস’।