ইতিহাস বলছে, প্রায় ৫০০০ বছর আগে, মিশরে ইজিপশিয়ানদের মস্তিষ্ক থেকে এই ব্র্যান্ড সিস্টেমের জন্ম। সেই সময়ের সম্পন্ন মানুষ তাদের নিজস্ব গরু, ঘোড়া ইত্যাদি অন্যের থেকে আলাদা করতে একটা চিহ্ন-প্রথার উদ্ভাবন করল। লিখছেন মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়।
১.
হ্যাঁ। এখন বিশ্বজুড়ে যেদিকে তাকাবেন, শুধু দেখবেন ব্র্যান্ডের আওয়াজ। আর সেই আওয়াজে মাতোয়ারা মনুষ্যজাতি। সে আওয়াজ কর্কশ, না মধুর– তাতে কী বা যায় আসে!
আসলে বিশ্ববাজারে এক অকল্পনীয় আর্থিক লাভের জোগান দিচ্ছে এই ব্র্যান্ড ম্যানিয়া। যার জন্য ভাল-মন্দ বিচার না করেই মানুষ সমাজে নিজের আইডেন্টিটি প্রতিষ্ঠা করতে পণ্যের আইডেন্টিটির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
আমরা জানি, গঙ্গার উৎস গোমুখ। ব্র্যান্ডিংয়ের উৎসও ওই গরু বা চারপেয়েদের জড়িয়েই। ইতিহাস বলছে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে (২৭০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) মিশরে ইজিপশিয়ানদের মস্তিষ্ক থেকে এই ব্র্যান্ড সিস্টেমের জন্ম। ইজিপশিয়ানদের অতুলনীয় উদ্ভাবনী শক্তির কথা আমরা জানি। সেই সময়ের সম্পন্ন মানুষ তাদের নিজস্ব গরু, ঘোড়া (cattle) ইত্যাদি অন্যের থেকে আলাদা করতে একটা চিহ্ন-প্রথার উদ্ভাবন করল। প্রথম দিকে, একটুকরো কাঠ পুড়িয়ে গরু বা ঘোড়ার গায়ে চামড়ার ওপর ছেঁকা দিয়ে একটা চিহ্ন তৈরি করত, যাতে তার নিজস্ব চতুষ্পদগুলি অন্যদের সঙ্গে মিশে না যায়। ওই পোড়া কাঠটিকে প্রাচীন ইংরেজি ভাষায় বলা হত ‘byrnan’ বা ‘brinnan’.পরে ভাষার বিবর্তন হতে হতে মধ্যযুগীয় ইংরেজি ভাষায় রূপান্তরিত হল ‘birnan’ থেকে ‘brond’. এই হল কথাটার উৎপত্তি। পরে অবশ্য পোড়া কাঠের বদলে তপ্ত লোহার ছেঁকায় ওই চিহ্নগুলি দেওয়া বা ব্র্যান্ডিং করা হত। এবং এই প্রসেসে শুধু ‘cattle’ ব্র্যান্ডিং নয়, সেই সময় ‘slave’ ব্র্যান্ডিংও করা হত। অর্থাৎ যদুর গরু, ঘোড়া, ছাগল, এর সঙ্গে মধুর গরু, ঘোড়া, ছাগল আলাদা করতে এই ব্র্যান্ডিংয়ের ভাবনা শুরু প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। এখনও আধুনিক সভ্যতা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও টেকনোলজির মহা মাতব্বর হয়েও সমস্ত উৎপাদক সংস্থা জুতো, মোজা, প্যান্ট, শার্ট, গাড়ি, বাড়ি– সবকিছুর ব্র্যান্ডিং করে ‘আমায় দ্যাখ আমায় দ্যাখ’ বলে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে চলেছে। আর দেশকাল ভেদে অপামর মনুষ্যজাতি ১০০ টাকার মাল ব্র্যান্ডিংয়ের খাতিরে একহাজার টাকায় কিনে নিজের সোশ্যাল ইমেজ তৈরিতে ব্যস্ত।
বর্তমান বাজারে ব্র্যান্ডিংয়ের প্রাধান্য এত বেড়ে গিয়েছে যে, সামান্য ছাতুও ব্র্যান্ডিং করতে শুরু করেছে। বাকি আছে ফুচকা। খবরে দেখলাম, আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে ফুচকা খাওয়াচ্ছেন! তাহলে ফুচকাই বা বাদ যায় কেন?
এবার ‘ব্র্যান্ড বাজাও’ নিয়ে কিছু তথ্য জানাই। একথা ঠিক যে, বর্তমান বিশ্ব বাণিজ্য পরিস্থিতিতে ব্র্যান্ডের মধুচক্র থেকে বেরনো মুশকিল। তাই আমাদের মতো ক্রেতাদের সঙ্গে ব্র্যান্ড-বিষয়ক ধারণাকে একটু ঝালিয়ে নিলে কেমন হয়!
ব্র্যান্ড বা ব্র্যান্ডিংয়ের অনেকগুলো ভাগ বা বংশ আছে। বর্তমানে বিশ্ব বাজারে প্রায় ২১ ধরনের ব্র্যান্ড আছে। গবেষকরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫ লক্ষ ব্র্যান্ড দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এতরকম ব্র্যান্ডের বংশপরিচয়ের মধ্যে না গিয়ে আমরা নিত্যব্যবহার্যগুলির কথাই বলি। এমন নিত্যব্যবহার্য ব্র্যান্ডের বংশ ৬টা। কর্পোরেট, প্রোডাক্ট, সার্ভিস, পার্সোনাল, রিটেল আর কালচারাল ও জিওগ্রাফিক্যাল ব্র্যান্ডিং।
আগামীতে যখন পৃথিবীজুড়ে বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলির উত্থান-পতনের গল্প বলব, তখন বংশ পরিচয়টাও বুঝিয়ে দেব। এবার বলি ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি বা চেনার উপায় কী? সহজ ব্যাখ্যা হল, দাড়ি মানেই রবীন্দ্রনাথ, তেকোনা টুপি মানেই নেতাজি, সরু গোল গোল কাচের কান জড়ানো চশমা মানেই মহাত্মা গান্ধী আর গেরুয়া পাগড়ি মানেই বিবেকানন্দ। এইগুলোই হচ্ছে এই অতি বিখ্যাত মানুষের আইডেন্টিটি বা দৃশ্য-পরিচিতি। তেমনই সব বিখ্যাত কোম্পানির, বিখ্যাত প্রোডাক্ট, বিখ্যাত হোটেল বা হাসপাতালের নিজস্ব আইডেন্টিটি আছে, যা লোগো সিম্বল, কালার– ইত্যাদি দিয়ে চিহ্নিত করা যায়।
মোদ্দা কথা, ব্র্যান্ড বা ব্র্যান্ডিংয়ের হরেক রকম গল্প বলার আগে পাঠককুলের কাছে এটি আমার ‘ব্র্যান্ড বাজাও’-এর মুখবন্ধ। আর ব্র্যান্ড নিয়ে বাজনা বাজানোর উদ্দেশ্যেটা হল যেহেতু আমার পাঠককুল এই আলোচিত ব্র্যান্ড বংশের উপভোক্তা বা কনজিউমার, তাঁরাও যেন বুঝে-সুঝে ব্র্যান্ডের মধুচক্রে গা ভাসান বা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে না ভোগেন।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved