ভারতে দুধের স্থান সব দেশের থেকে আলাদা। শুধু খাদ্য নয়, ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয়, চর্চিত এবং আরাধ্য বস্তু হল দুধ। বেদে দুধকে আলো বা জ্যোতির প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। খনার বিখ্যাত বচন ‘ঘিয়ে বুদ্ধি বৃদ্ধি আর দুধে বৃদ্ধি বল’ ঘরে ঘরে প্রায় সব লোকেদেরই ঠোঁটস্থ। উথলিয়ে ওঠা দুধকে সমৃদ্ধির বাহক বলে মনে করা হয়। কিন্তু দুধ পুড়ে যাওয়া মানে আমাদের দেশে আজও অশুভ। বলা হয়, এতে সংসারে অশান্তি বাড়বে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হবে মনোমালিন্য, এমনকী লক্ষ্মী হারানোর সম্ভাবনাও তৈরি হতে পারে।
২২.
দুধ তো পশু মাত্রই খায়। মানুষও পশু। সেও খেয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। আলতামিরা গুহার সময় বা তারও আগে, জন্তু মেরে মাংস খাওয়ার আনন্দ-চিত্র যখন আঁকছিলেন আমাদের কোনও পূর্বপুরুষ তখনও হয়তো কোথাও, কোনও কোলে, মায়ের দুধ খাচ্ছিল কোনও শিশু। ‘মা কা দুধ পিয়া হ্যায়’-র গরিমা তাই বলিউডের মৌরসিপাট্টা নয়। সমস্যা হল অনেক পরে, মানুষ যখন নিজের দুধের সঙ্গে সঙ্গে অন্য প্রাণীর দুধ খাওয়া শুরু করল, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’-র চিন্তা উদয় হল মাথায়, তখন সেই দুধকে সঞ্চয় করতে গিয়ে তার গুরুত্ব বাড়িয়ে ফেলল কয়েক গুণ। আগুনের তাপে দুধ জাল দেওয়ার প্রথা জন্ম নিল ক্রমে। কিন্তু সেই প্রণালীতে কোনও দুধের পাত্র যখন পুড়ে যেত এক পশলা, তখন কুয়াশার মতো ছেয়ে যেত ভয়। কারণ, এ কেবল খাবারের অপচয় নয়, অপয়ার সতর্কবার্তাও।
শুরুটা ছিল বাস্তবিক। গবাদি পশুরা মানুষের বশে আসার পরে মাংসের চেয়ে দুধের চাহিদা বাড়ল বেশি। কারণ, শরীরের পুষ্টি যদি দুধে পুষিয়েই যায়, তাহলে পোষা পশুটাকে আর মারতে হয় না। তাই একদিকে এক এক লিটার দুধ যেমন হয়ে উঠল বিশাল সম্পদ, তেমনই পুড়ে যাওয়া দুধ হয়ে গেল ন্যায্য দুশ্চিন্তার বিষয়। কী হবে যদি ভোরে ঘুমতে যাওয়া শিশুটার বোতল দিন ফুরনোর আগেই যায় ফুরিয়ে? কোনও রোগী যদি মারা যায়, তার হকের শেষ পথ্যিটুকু না পেয়ে? দুধের অপচয় আটকানোর জন্যই এসব ভাবনা তাই ধীরে ধীরে মেলানো হল লোকগল্পে।
এর পরের পর্যায়ে মানবিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে দুধ পেল নতুন রূপ– পবিত্রতা। ভগবানের প্রসাদের তাজা দুধ যদি পুড়ে যায় আগুনে, তবে কি অনুচিত কিছু ঘটার ইঙ্গিত দিচ্ছেন ঈশ্বর? পুরোহিতরাও এমন সুযোগ ছাড়বে কেন? কখনও দেবতার রাগ, কখনও রীতি-ভঙ্গের অজুহাত দেখিয়ে আরও বেশি করে উসুল করা শুরু হল অনুতপ্ত ভক্তের উপঢৌকন। সাধারণ মানুষকে আরেকটু বাগে আনা গেল দীর্ঘ প্রার্থনার সমর্পণে। তাছাড়া মধ্যযুগে বেশিরভাগ বাড়িই ছিল কাঠের তৈরি, যার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল আগুনে পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকিও। স্বাভাবিকভাবেই পোড়া দুধের অশুভ সংকেত তাই ঘর পোড়ার ভীতিকে করে তুলেছিল আরও বেশি জোরদার।
তিব্বত কিংবা মোঙ্গোলিয়ায় দুধের অপচয় ছিল আত্মিক ভারসাম্যহীনতার প্রতীক। পূর্ব আফ্রিকার কিছু গোষ্ঠীর কাছে দুধ ছিল সম্পদ ও সম্মানের প্রতীক। আতিথেয়তা দেখাতে দুধ ভাগাভাগি করা হত, বিয়ের উপাচারে দুধকে গুরুত্ব দেওয়া হত, এমনকী, রাজার রাজ্যাভিষেক বা বংশগত পরিচয় নিদর্শনের জন্যেও দুধের স্থান ছিল খুব উঁচুতে। তাই দুধ পুড়ে যাওয়াটা সেক্ষেত্রে যথেষ্ঠ অসম্মানের বিষয় ছিল বইকি। আমেরিকার পূর্ব ইতিহাস যদিও ভিন্ন ছবি দেয়। মহাদেশীয় আদিবাসী সংস্কৃতিগুলোর মধ্যে সেখানে দুধ সংগ্রহ করে রাখার চল ছিল সামগ্রিকভাবেই কম, তাই দুধ পোড়া নিয়ে কোনও সংস্কার ততটা গড়ে ওঠেনি।
ভারতে দুধের স্থান সব দেশের থেকে আলাদা। শুধু খাদ্য নয়, ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয়, চর্চিত এবং আরাধ্য বস্তু হল দুধ। বেদে দুধকে আলো বা জ্যোতির প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। খনার বিখ্যাত বচন ‘ঘিয়ে বুদ্ধি বৃদ্ধি আর দুধে বৃদ্ধি বল’ ঘরে ঘরে প্রায় সব লোকেরই ঠোঁটস্থ। এক্ষেত্রে অবশ্য শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাও অস্বীকার করা যায় না। তাঁর প্রভাবেই গয়লা সম্প্রদায়ের প্রতি ভারতবাসীর জেগেছিল অপার সম্ভ্রম। ভারতের অনেক প্রদেশে আজও কিন্তু নতুন সংসার পাতলে বা গৃহপ্রবেশ হলে দুধ ফোটানো এক মাঙ্গলিক রীতি। উথলিয়ে ওঠা দুধকে সমৃদ্ধির বাহক বলে মনে করা হয়। পোঙ্গল উৎসবে চাল আর দুধ একসঙ্গে না ফুটিয়ে দিলে দেবতার প্রতি করা যে কোনও উৎসর্গ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কিন্তু দুধ পুড়ে যাওয়া মানে আমাদের দেশে আজও অশুভ। বলা হয়, এতে সংসারে অশান্তি বাড়বে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হবে মনোমালিন্য, এমনকী, লক্ষ্মী হারানোর সম্ভাবনাও তৈরি হতে পারে। অনেকের মতে, বারবার দুধ পুড়ে যাওয়া কিন্তু সংসারে নেতিবাচক শক্তি ঢুকে পড়ার লক্ষণ।
আফ্রিকায় গরু আর দুধকে শুধু খাবার নয়, গণ্য করা হয় সম্পদ আর মর্যাদার প্রতীক হিসেবে। অনেক গোষ্ঠীর কাছে গরু মানে ধন, সম্পদ, জীবনের ধারণের পথ। এককথায় রুজি-রুটির উপায়। দুধ নিয়ে তাই বিশ্বাসগুলোও এখানে তীব্র। যেখানে দুধ প্রতিদিন সংগ্রহ করাই কঠিন, সেখানে একফোঁটা নষ্ট হওয়াও যে অশুভ বলে ধরে নেওয়া হবে, তা খুবই স্বাভাবিক। তাই দুধ যদি কারও ভুলে উথলে পড়ে, ধরে নেওয়া হয় সারা পরিবারের অপচয় হচ্ছে, আর তার ফল ভুগতে হবে গোটা পরিবারকেই। এই ধারণা সরাসরি সমাজের অর্থনৈতিক ক্ষতির সঙ্গে যুক্ত। যুক্ত সাম্যের ধারণার সঙ্গেও। আফ্রিকার অনেক অঞ্চলের আবার বিশ্বাস, দুধ পুড়ে যাওয়া আদতে পূর্বপুরুষদের ক্রোধের কারণ। দুধকে তারা দেবতার উপহার বলে মনে করে, তাই সে জিনিস নষ্ট হওয়া মানে দেবতার প্রতি অসম্মান। ফলে পুড়ে যাওয়া মানে শুধু অপচয় নয়, আধ্যাত্মিক শাস্তি বয়ে আনাও বটে। কিছু গোষ্ঠীর বিশ্বাস দুধ পুড়ে গেলে বিবাহ বিচ্ছেদ বা গোষ্ঠী দ্বন্দ্বও পর্যন্ত হতে পারে।
জাপানি সংস্কৃতিতে ‘symmetry’ বা ভারসাম্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোনও কিছু যদি বেশি হয়ে যায়, তবে সেটাকে বিপদের ইঙ্গিত মনে করা হয়। তাই দুধ উথলে পড়া মানে বাড়ির ভেতরে ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার শামিল। জাপানি লোককাহিনিতে এমনও উল্লেখ আছে যে, যদি নববধূর প্রথম রান্নায় দুধ উথলায়, তবে তার জীবনে শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে অশান্তি অবশ্যম্ভাবী। কোথাও আবার মত একেবারে উল্টো, বলা হয় এতে দাম্পত্য মজবুত হয়, কারণ উথলানো মানে অনুভূতির উপচে পড়া। তা সে প্রেম হোক বা দয়া। একেবারে বিপরীত দুই ব্যাখ্যা একই সমাজে এভাবেই পাশাপাশি চলে এসেছে বহুকাল।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দুধ পুড়ে যাওয়া কিন্তু সবসময় খারাপ চিহ্ন হিসেবেই ধরা হয়। ইন্দোনেশীয়রা বিশ্বাস করে, দুধ পুড়ে যাওয়ার আধ্যাত্মিক অর্থ হল ঘরের আত্মাদের অসন্তুষ্টি। মালয়েশিয়ায় বলা হয়, এতে পরিবারের মধ্যে মনোমালিন্য বাড়ে বা টাকার ক্ষতি হয়। অনেক জায়গায় ধরে নেওয়া হয় পুড়ে যাওয়া দুধে নজর ছিল শয়তানের, তাই অবশিষ্ট যতটাই থাক না কেন, তা আর কোনও কাজে লাগানো হয় না, ফেলে দেওয়া হয়। যাতে খারাপ শক্তি ঘরে না ঢোকে।
তাই সবসময় এ দাবি করা বৃথা যে, দুধ উথলে ওঠা বা পুড়ে যাওয়ার কুসংস্কারই একমাত্র থামাতে পারে দুধের মতো এক অমূল্য শিশুখাদ্যের অপচয়। উলটো দিকে এও সত্য, বহু জায়গায় এই কুসংস্কারই আবার বাধ সাধে অবান্তর খরচে। আসলে যে পৃথিবীতে এখনও অনেক মানুষ থাকে অভুক্ত, অনেক শিশু অপুষ্টিতে ঢলে পড়ে মৃত্যুর চৌকাঠে, সেখানে কুসংস্কারও যদি দেবতার ভয়াল মূর্তির মতো এসে দাঁড়ায়, চোখ রাঙায় অপচয়ের কুঅভ্যাসের বিপরীতে, তবে তাকে স্বাগত। তাতেই শেষমেশ বৃহৎ মঙ্গল।
……………..অপয়ার ছন্দ অন্যান্য পর্ব……………..
পর্ব ২১। ভাঙা বিগ্রহ জানান দেয়, সৌন্দর্যের শত্রুরা আজও বর্তমান
পর্ব ২০। পেঁচা মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতি আর অলৌকিকের মাঝের সীমানা খুব সূক্ষ্ম
পর্ব ১৯। রাতে, ঝাঁটা নিয়ো না হাতে
পর্ব ১৮। তিল থেকে তাল
পর্ব ১৭। অন্ধবিশ্বাস মাথাচাড়া দিলে ‘অপয়া’ হয় মাথায় হাত
পর্ব ১৬। চুল তার কবেকার অন্ধকার অপয়ার নিশান
পর্ব ১৫। যে আত্মীয়তার ডাককে অপয়া বলে বিকৃত করেছে মানুষ
পর্ব ১৪। অকারণে খোলা ছাতায় ভেঙে পড়েছে পাবলিক প্লেসে চুমু না-খাওয়ার অলিখিত আইন
পর্ব ১৩। দলবদলু নেতার মতো ধূমকেতু ছুটে চলে অনবরত
পর্ব ১২। কখনও ভয়ংকর, কখনও পবিত্র: দাঁড়কাক নিয়ে দোদুল্যমান চিন্তা!
পর্ব ১১। শুধু একটা হ্যাঁচ্চো– বলে দেবে কীভাবে বাঁচছ
পর্ব ১০। অপয়ার ছেলে কাঁচকলা পেলে
পর্ব ৯। চোখের নাচন– কখনও কমেডি, কখনও ট্র্যাজেডি!
পর্ব ৮। জুতো উল্টো অবস্থায় আবিষ্কার হলে অনেক বাড়িতেই রক্ষে নেই!
পর্ব ৭। জগৎ-সংসার অন্ধ করা ভালোবাসার ম্যাজিক অপয়া কেন হবে!
পর্ব ৬। প্রেম সেই ম্যাজিক, যেখানে পিছুডাক অপয়া নয়
পর্ব ৫। ডানা ভাঙা একটি শালিখ হৃদয়ের দাবি রাখো
পর্ব ৪। জন্মগত দুর্দশা যাদের নিত্যসঙ্গী, ভাঙা আয়নায় ভাগ্যবদল তাদের কাছে বিলাসিতা
পর্ব ৩। পশ্চিম যা বলে বলুক, আমাদের দেশে ১৩ কিন্তু মৃত্যু নয়, বরং জীবনের কথা বলে
পর্ব ২। শনি ঠাকুর কি মেহনতি জনতার দেবতা?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved