প্রথমে ভেবেছিলাম নিজেদের সুবিধের জন্যে ট্রেন কোম্পানি শুধু ভেজিটেবিল চপ আর আলু বন্ডা রাখে, কিন্তু পরে দেখলাম অন্য কোনও চপ পাওয়াই যায় না বেশির ভাগ জায়গায়। ভাটাপাড়ায় স্টেশনের কাছে এক আলু বন্ডার দোকানে এত বিক্রি যে বিকেলে দুই ঘণ্টার মধ্যে দোকান খালি হয়ে যায়। একদিন দোকানে হাজির হতে আমি তাজ্জব– মালিক বাঙালি। দোকানে ভিড় কমলে আমি আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আলুর চপের মর্যাদা নষ্ট করছ কেন ভাই?’
রাজস্থানে উদয়পুরে থাকাকালীন ঘাটি পেরিয়ে প্রায় প্রত্যেক রবিবার একলিঙ্গজির মন্দিরে হাজির হতাম তার পাশের দোকানে মির্চি বড়া, মানে লঙ্কার চপের লোভে। সেখানে দেখেছি লঙ্কা বেসনে ডুবিয়ে ভেজে দিচ্ছে আর লোকে ভিড় করে খাচ্ছে। বাংলাতে চপের দোকানে রকমারি পসরা– আলু থেকে মোচা, কীসের চপ পাওয়া যায় না! বাংলাদেশ আরও এক কাঠি সরেস, সেখানে পেঁয়াজিকে আদর করে ‘পেঁয়াজু’ বলে। কিন্তু বাংলার সীমা পার করলেই আলু বন্ডা আর সামোসা ছাড়া কিছুই নজরে আসে না। প্রথমে ভেবেছিলাম নিজেদের সুবিধের জন্য ট্রেন কোম্পানি শুধু ভেজিটেবিল চপ আর আলু বন্ডা রাখে, কিন্তু পরে দেখলাম অন্য কোনও চপ পাওয়াই যায় না বেশিরভাগ জায়গায়। ভাটাপাড়ায় স্টেশনের কাছে এক আলু বন্ডার দোকানে এত বিক্রি যে, বিকেলে দু’ঘণ্টার মধ্যে দোকান খালি হয়ে যায়। একদিন দোকানে হাজির হতে আমি তাজ্জব– মালিক বাঙালি। দোকানে ভিড় কমলে আমি আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আলুর চপের মর্যাদা নষ্ট করছ কেন ভাই?’ সে জিভ কেটে উত্তর দিল, ‘দাদা আলুর চপ দিয়েই শুরু করেছিলাম দোকান, কিন্তু কেউ আসত না। বাধ্য হয়ে বন্ডা শুরু করলাম, আর দেখুন, দিয়ে কূল পাচ্ছি না!’ বুঝলাম আলু যেখানে গোল, তার চপকেও গোল হতে হবে– এই যুক্তিতে আলু বন্ডা আলুর চপকে আশপাশেই আসতে দেয়নি। হিন্দি বলয়ে দস্তুর চপের আকৃতি সবজির মতোই হতে হবে। তখন বুঝলাম কেন এখানে বেগুনি বা মোচার চপ বাংলার বাইরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।
ভাটাপাড়ায় থাকার সময় হঠাৎ রায়পুর থেকে তলব এলে যখন-তখন রায়পুর দৌড়তে হত। আর অবধারিতভাবে সিমগা আর কবরধাতে দেখতাম খাবারের দোকানে ভিড় উপচে পড়ছে। কিন্তু কাজের চাপে আর সেই একঘেয়ে পুরি-সবজি, বন্ডা আর সামোসার বাইরে কিছু পাওয়া যাবে না ভেবে কোনও দিনই সেখানে থামিনি। এক সকালে এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার সময় বেজায় খিদে পেয়েছিল, তাই সেখানে থামলাম। দোকানে গিয়ে আমি অবাক– এখানে বন্ডা নয়, এখানে বিভিন্ন সবজির টুকরো করে সেগুলো বেসনে ডুবিয়ে ভেজে রেখে দিয়েছে আর কিলোদরে বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় গ্রামবাসীরা ভিড় করে সেগুলো কিনছে। ঠান্ডা সবজি-পকোড়া খেতে দেখে শিউরিয়ে উঠতে গিয়েও থমকে গেলাম, মনে পড়ল বর্ধমানের তিনকোনিয়া বাসস্ট্যান্ডে মুড়ির সঙ্গে চপ মেখে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিয়ে নরম করে নিয়ে স্থানীয় গ্রামবাসীদের তৃপ্তির খাওয়া। আর এটাও বুঝলাম শহরের মানুষ যতই সবজির আকৃতি বুঝে চপ বানিয়ে খাক, সব জায়গার মাটির মানুষের কাছে স্বাদই শেষ কথা– ঠান্ডা হোক বা গরম, তৃপ্তি দিয়েই খাবার হজম করে নেয়।
কালকে জানতে পারলাম আমেরিকাতেও লোকে চপ-তেলেভাজা বিস্তর খায়, কিন্তু সাহেবি কায়দায়। চিকুকে ঘড়ি দেখে ফোন করতে হয়, কারণ ইউনিভার্সিটির ভেতরে থাকলে কাজের চাপে কথা বলতে পারে না, আর বাইরে থাকলে খাবার চাপে কথা বলতে পারে না। সেদিন ফোনে জিজ্ঞেস করলাম কী করছে, বলল সাদার্ন হাশপাপি খাচ্ছে। আমেরিকা উন্নত দেশ জানি, তাই বলে পাপীদের খাওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি ঢপবাজি বলতে সে উল্টে জিজ্ঞেস করল আমি কোনও দিন এই সাদার্ন হাশপাপি খেয়েছি কি না। খাইনি শুনে পরিষ্কার জানিয়ে দিল, আমার জীবন নাকি বৃথা। কৌতূহলে নেট ঘেঁটে ছবি আর বানানোর পদ্ধতি দেখে আমি বেকুব– ও হরি, এ তো আমাদের ফুলুরি! সেটা ওকে জানাতে রেগে গেল। ওর কাছে শুনলাম ‘বাফেলো ওয়াইল্ড উইংস’ নামে এক নামী রেস্তরাঁ চেনের কথা, সেখানে ফুলকপির টুকরো বেসনে ভেজে পছন্দের স্যসের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়। কলিফ্লাওয়ার উইংসের একটা ছবি পাঠাল, সেখানে ক্যালোরির মাপ অবধি দেওয়া আছে। দাম প্রায় সাড়ে চারশো টাকা। তার সঙ্গে টেক্সাস রোডহাউস চেনের ক্যাকটাস ব্লসমের ছবি পাঠাল, বেসনে ডুবিয়ে পেঁয়াজ ভাজা। চিকুকে আমার সিমগার রাস্তার হোটেলে বসে খাওয়া পেঁয়াজ ভাজি আর গোবি ভাজির ছবি পাঠালাম রিটার্ন গিফট হিসেবে, তলায় ২০/- লিখে একটা স্মাইলি দিলাম।
চিকুর ফোনের অপেক্ষায় আছি।