এই হল লিপস্টিক অবতারের মহিমা। তবে ব্র্যান্ডপার্টির হুজুগে মেম্বারদের দাম নিয়ে মাথাব্যথা নেই, আছে ব্র্যান্ড নিয়ে। ঠোঁট বলে কথা। লক্ষণীয়, কসমেটিক্স ব্র্যান্ডজাদুকররা ঠোঁট নিয়ে যতটা মাথা ঘামিয়েছেন, চোখ নিয়ে ততটা নয়। কারণ মনে হয় ঠোঁটের যৌন আবেদন চোখের থেকে অনেক বেশি। শুধু কি যৌন আবেদন, রাঙা ঠোঁটের নানা আবেদন বা ব্যবহার নিয়ে কত যে কথা!
নারীশরীরের বহিরঙ্গের মুখ্য দৃশ্যমান অংশ হল মুখমণ্ডল। এই মুখমণ্ডল দু’টি আকর্ষণীয়তম দ্রষ্টব্য হল চোখ আর ঠোঁট। এর মধ্যে ঠোঁট সদা ব্যস্ত। বাক্যবাণ, বাক্য সুধা, বাগ্মীতা, গান, গল্প, ভোজন পর্ব এবং প্রেমপর্ব। বাকি সব কাজ বাদ দিয়েও বলি প্রথম প্রেমের প্রকাশ চুম্বন ছাড়া কি সম্ভব? তাই এই ঠোঁট নামক প্রত্যঙ্গটিকে সযত্নে আকর্ষণীয় করে রাখতে কত ভাবনা-চিন্তা, গবেষণার উদ্ভাবন।
সুকুমার রায়ের ‘গোঁফের আমি গোঁফের তুমি’ ধার করেই বলি ঠোঁটের আমি ঠোঁটের তুমি ঠোঁট দিয়ে যায় চেনা– সেই ঠোঁট চেনাতেই তো লিপস্টিক অবতার ধরাধামে অবতীর্ণ হলেন। কেন ‘অবতার’ বললাম?
তবে জেনে রাখুন, বিশ্বের সব থেকে দামি লিপস্টিক ব্র্যান্ড হল: H. Couture Beauty Diamond Lipstick. সাবধান– দাম শুনলে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন! একটি স্টিকের মূল্য ১.৪ কোটি টাকা মাত্র। এই হল লিপস্টিক অবতারের মহিমা। তবে ব্র্যান্ডপার্টির হুজুগে মেম্বারদের দাম নিয়ে মাথাব্যথা নেই, আছে ব্র্যান্ড নিয়ে। ঠোঁট বলে কথা!
লক্ষণীয়, কসমেটিক্স ব্র্যান্ডজাদুকররা ঠোঁট নিয়ে যতটা মাথা ঘামিয়েছেন, চোখ নিয়ে ততটা নয়। কারণ মনে হয় ঠোঁটের যৌন আবেদন চোখের থেকে অনেক বেশি। শুধু কি যৌন আবেদন, রাঙা ঠোঁটের নানা আবেদন বা ব্যবহার নিয়ে কত যে কথা!
পুরাকাল থেকেই ভারতীয় নারীকুল এক চমৎকার প্রাকৃতিক উপায়ে, মানে পান খেয়ে ঠোঁট রাঙানোর ব্যবস্থা করে নিয়েছিল। কিন্তু ৫০০০ বছর আগে মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় যখন প্রথম ঠোঁট রাঙানোর প্রথা প্রচলন হল, তখন পানপাতার হদিশ কোথায়! তাই মেসোপটেমিয়া বা মিশরীয় সভ্যতায় নারীকুল ঠোঁট রাঙানোর ব্যাকুলতায় নানা মণিমানিক্য গুঁড়ো করে তার সঙ্গে বিভিন্ন ভেষজ, পোকা ইত্যাদির সংমিশ্রণে একটি তরল পদার্থ ব্যবহার করতে শুরু করল।
মিশরীয় মহিয়সী ক্লিওপেট্রা ছিলেন বড্ড রঙিন ঠোঁটের ভক্ত। তিনি পরতেন টকটকে লাল রং দু’টি কারণে। এক, রাজশক্তির প্রদর্শন, দুই, মরুভূমির গরম থেকে বহু রাজপুরুষের স্বপ্ন, পেলব দু’টি ওষ্ঠপল্লবকে আগলে রাখা। তবে এই ধরনের ওষ্ঠরঞ্জনী অনেক সময় বিষাক্ত হয়ে উঠত। এমনও শোনা যায় যে, মিশরীয়রা প্রথমদিকে এই ওষ্ঠরঞ্জনীর মিশ্রণে ভেড়ার ঘাম আর কুমিরের বিষ্ঠা পর্যন্ত ব্যবহার করত। এর থেকে বোঝা যায়, ঠোঁট রাঙানোর নেশায় সে যুগের নারীকুল কেমন আচ্ছন্ন ছিল!
কিন্তু নারীকুলের এই উচ্ছাস ধাক্কা খেল খ্রিস্টীয় সভ্যতায় চার্চের অনুশাসনে। মেক-আপ বিষয়টি তাদের মতে সভ্য ব্যাপার নয়। আর লাল রঙের ঠোঁট মানে শয়তানের পূজারি। ঠোঁট রাঙানোর অধিকার ছিল একমাত্র যৌনকর্মী ও নাট্যকর্মীদের। এইসব শাসন, অনুশাসনের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এক ফরাসি সুগন্ধ ব্যবসায়ী প্রথম ‘Guerlain’ নামে লিপস্টিক ব্র্যান্ড বাজারে নিয়ে এলেন। তাতেও কিন্তু এই লিপস্টিক ব্যবহারের মরালিটি নিয়ে বিতর্ক থামল না। ১৯২০ সালের পর থেকে দু’টি ঠোঁট রাঙানোর হাজারো ঝঞ্ঝাট, সমাজ, নৈতিকতা ইত্যাদি প্রভৃতির মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে পাশ্চাত্যের নারী বাহিনী অবাধ লিপস্টিকের ব্যবহার শুরু করে দিল। এমনকী, বিশ্বযুদ্ধের সময় রাঙা ঠোঁট মনোবল বৃদ্ধির প্রতীক হয়ে উঠল।
১৯৩০ থেকে ১৯৫০ লিপস্টিক বিপ্লবের ঢেউ উঠল তুঙ্গে। পাঁচের দশকে মাঠে নামলেন স্বয়ং রানি এলিজাবেথ। তাঁর করোনেশনের সময় নিজের পোশাকের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে লিপস্টিকের শেড তৈরি করালেন তাঁর পছন্দের ব্র্যান্ড ক্লারিনস-কে দিয়ে। হলিউডই বা বাদ যায় কেন! মেরিলিন মনরো, এলিজাবেথ টেলার, গ্রেস কেলি, অদ্রে হেপবর্ন প্রভৃতি হলিউড তারকা লিপস্টিক কীর্তনে জগৎকে মাতিয়ে তুললেন।
সেই মাতন থেমে থাকেনি। আপাতত প্রায় দুশোরও বেশি শেডে বিশ্বের নারীশক্তি তাদের সযত্নলালিত ওষ্ঠ রাঙিয়ে ব্র্যান্ড বাজিয়ে নতুন যুগের লিপ রেভোলিউশনের দিকে এগিয়ে চলেছে।