প্রোডাক্ট তো অতি উচ্চমানের হলেই হবে না, তাকে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য চাই উপযুক্ত বিপণন ব্যবস্থা। ‘পিয়ার্স’ সাবান সেখানেও নতুন ধরনের ক্লাসিক বিজ্ঞাপন করে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সেই সময়ের খ্যাতনামা ব্রিটিশ শিল্পী জন এভাটঁ মিলাইস-এর বিখ্যাত পেন্টিং ‘বাবলস’ যেখানে এক সহজ-সরল দেবশিশু সাবান জল দিয়ে বুদ্বুদ বা বাবলস তৈরি করে ওড়াচ্ছে, সেই ছবি ব্যবহার করে পিয়ার্স সাবানের বিজ্ঞাপন জনমানসে দারুণ সাড়া ফেলল।
বিশ্বজুড়ে শিল্প জগতে ব্র্যান্ড তৈরির ইতিহাসে অনেক ঘটন-অঘটন আমাদের অবাক করেছে। কিন্ত কখনও শুনেছেন সেই ১৮০৭ সালে এক নরসুন্দরের হাতে সৃষ্টি হল ত্বক সুন্দর রাখার এক আশ্চর্য প্রোডাক্ট, যা বিশ্বের ত্বক পরিচর্যার ইতিহাসে প্রথম ব্র্যান্ড হিসেবে ২০০ বছরেরও বেশি সময় রাজত্ব করে চলেছে?
এক চাষির ছেলে, অ্যান্ড্রিউ পিয়ার্স লন্ডনের সোহ-তে ১৭৯০ নাগাদ একটা চুল-দাড়ি কাটার সেলুন খুললেন, এবং সেখানে নিজের তৈরি কিছু ক্রিম, পাউডার বিক্রি শুরু করলেন। সোহ জায়গাটিতে উচ্চবিত্ত ও ধনী মানুষের বসবাস, যার ফলে ওই সেলুনে বেশ কিছু ধনীদেরও যাতায়াত ছিল। অ্যান্ড্রিউ পিয়ার্স লক্ষ্য করলেন, এইসব সৌন্দর্য সচেতন সাহেব-মেমরা নিজেদের ফর্সা চামড়ার ক্ষত ঢাকতে প্রায়ই তাঁর তৈরি ক্রিম, পাউডার প্রভৃতি কিনতেন। পিয়ার্সের অনুসন্ধিৎসু মন খোঁজ খবর নিয়ে জানল যে, ত্বক পরিষ্কারের সাবানে ক্ষতিকর কেমিক্যাল থাকায় ওইসব সাহেব-মেমদের চামড়ায় তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। ব্যস, শিল্পোদ্যোগী অ্যান্ড্রিউ পিয়ার্স উঠেপড়ে লাগলেন এক উচ্চমানের সাবান তৈরিতে। অনেক এক্সপেরিমেন্টের পর প্রাকৃতিক ভেষজ এবং গ্লিসারিন মিশিয়ে অ্যান্ড্রিউ পিয়ার্স এক অতি উন্নতমানের শুদ্ধ স্বচ্ছ সাবান তৈরি করলেন, যা সাবানের ইতিহাসে প্রথম ‘‘Pears’ Transparent Glycerine Soap’’ নামে ১৮০৭ সালে লন্ডনের বাজারে আবির্ভূত হল। দেখতে দেখতে Pears’ সাবান তার গুণমানের কারণে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছল, এমনকী, ‘Great Industrial Exhibition’-এ পুরস্কৃতও হল।
‘পিয়ার্স’ সাবানের জন্মই হয়েছিল একটা অসাধারণ ঐশ্বর্য নিয়ে, স্বচ্ছতার ঐশ্বর্য, আর শুদ্ধতার গ্যারান্টি দিয়ে। প্রোডাক্ট যখন নিজেই স্বচ্ছ ও শুদ্ধ, তখন তাকে নিয়ে বিজ্ঞাপনের জয়ঢাক বাজিয়ে ব্র্যান্ডের তকমা দিতেও সময় লাগল না।
প্রোডাক্ট তো অতি উচ্চমানের হলেই হবে না, তাকে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য চাই উপযুক্ত বিপণন ব্যবস্থা। ‘পিয়ার্স’ সাবান সেখানেও নতুন ধরনের ক্লাসিক বিজ্ঞাপন করে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সেই সময়ের খ্যাতনামা ব্রিটিশ শিল্পী জন এভাটঁ মিলাইস-এর বিখ্যাত পেন্টিং ‘বাবলস’ যেখানে এক সহজ-সরল দেবশিশু সাবান জল দিয়ে বুদ্বুদ বা বাবলস তৈরি করে ওড়াচ্ছে, সেই ছবি ব্যবহার করে পিয়ার্স সাবানের বিজ্ঞাপন জনমানসে দারুণ সাড়া ফেলল। কারণ শিশুটির সারল্য ও বুদ্বুদের স্বচ্ছতা পিয়ার্স সাবানের গুণগুলির সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্যভাবে মিশ্রিত হয়ে ক্রেতাদের মনে যে আবেগ তৈরি করল, তার ফলে এই বাবলস পেন্টিং দিয়ে পিয়ার্স সাবানের বিজ্ঞাপন বহু দশক ধরে ব্র্যান্ড বাজিয়ে ছিল। এই হল বিজ্ঞাপনের ম্যাজিক, যখন প্রোডাক্ট আর বিজ্ঞাপন ‘মেড ফর ইচ আদার’।
এছাড়াও পিয়ার্স সাবান তার বিপণনে ও বিজ্ঞাপনে সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক নতুন নতুন ভাবনার সার্থক প্রয়োগ করে, যা পিয়ার্স সাবানের ব্র্যান্ড ভ্যালু অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। ১৮৮২ সালে পিয়ার্স সাবানই প্রথম বিজ্ঞাপনে সেলিব্রেটি এনডোর্সমেন্ট কনসেপ্ট নিয়ে আসে এবং তখনকার দিনের বিখ্যাত ব্রিটিশ সুন্দরী, যিনি ছিলেন একাধারে সোশালাইট, স্টেজ অ্যাকট্রেস, খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক ও রাজপুরুষ ঘনিষ্ঠ এক কিংবদন্তি চরিত্র, এমিলি শার্লোট বা লিট্ল ল্যানগট্রি পিয়ার্স সাবানের পোস্টার গার্ল হয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় জনপ্রিয়তায় ঢেউ তোলেন।
পিয়ার্স সোপের ব্র্যান্ড বিল্ডিংয়ে কোম্পানির উদ্ভাবনী শক্তি বিস্ময় জাগায়। ১৮৯১ থেকে ১৯২৫– পিয়ার্সের অ্যানুয়াল পাবলিকেশন, ডিরেক্টরি, ক্যালেন্ডার– সবই সংগ্রহযোগ্য হয়ে পড়ে। এছাড়াও
শিশুদের নিয়ে বাৎসরিক ‘মিস পিয়ার্স’ প্রতিযোগিতা, যেখান থেকেই বিজ্ঞাপনে ব্যবহারের জন্য ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর বাছা হত, যা ছিল মা-বাবাদের অতি পছন্দের প্রমোশনাল প্রোগ্রাম।
তবে বিপণন ভাবনার অতি চমৎকার ও ক্লাসিক নিদর্শন ছিল পিয়ার্স সাইক্লোপিডিয়া। এটি একটা বাৎসরিক এনসাক্লোপিডিয়া, যাতে ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ব্যবসা, ধর্ম প্রভৃতি নানা জ্ঞাতব্য বিষয়ের ভাণ্ডার নিয়ে ১৮৯৭ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার হীরক জয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত হয়। এই পাবলিকেশনের বিপুল চাহিদার জন্য ১৮৯৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রকাশনা চালু রাখতে হয়।
এ হেন পিয়ার্স কোম্পানি কালের নিয়মে ১৯১৭ সালে ‘লিভার ব্রাদার্স’-এর সঙ্গে যুক্ত হয় এবং পরে ‘ইউনিলিভার’ কোম্পানির হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯০২ সালে পিয়ার্স সাবান তার স্বচ্ছতা ও শুদ্ধতা নিয়ে ভারতে বিপণন শুরু করে এবং জনপ্রিয় হয়। পরে পিয়ার্স সাবানের সমস্ত প্রোডাকশন শুধু ভারতে ও সৌদি আরবে উৎপন্ন হয়ে বিশ্বের ২০০টি দেশে পরিবেশিত হচ্ছে।
পিয়ার্স সাবানের ব্র্যান্ড হয়ে ওঠার গল্পে থামার সুযোগ নেই। কিন্ত থামতে তো হবেই। তাই থামার আগে পাঠকদের একটা প্রবাদপ্রতিম প্রাচীন সংস্কৃত শ্লোকের কথা বলি। ‘উদ্যোগিন পুরুষসিংহমুপৈতি লক্ষ্মী’ অর্থাৎ উদ্যোগী পুরুষের লক্ষ্মী লাভ হবেই। এ কথা যে কত সত্য, তার প্রমাণ অ্যান্ড্রিউ পিয়ার্স। এক সামান্য নাপিত থেকে উদ্যোগ ও চেষ্টার ফলে এমন এক সাবান তৈরি করলেন, যা ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গ্লিসারিন সাবানের জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে বসে আছে।
থ্রি চিয়ার্স… পিয়ার্স।