দাসবাবু মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে গলায় দড়ি দেওয়ার, এবং অকৃতকার্য হলে নিজেই পাথড় জোগাড় করে সকলের মাথা থেঁতলে জেলে যাওয়ার হুমকি দেন। বন্দুক নিয়ে সবটা সন্দেহ দূর না হলেও আমরা সেদিনের পর মোটামুটি মেনেই নিয়েছিলাম যে ওর কাছে কষ্মিনকালেও কোনও ধরনের বন্দুক ছিল না। অতএব স্টোনম্যানের ভয় আবার ফিরে আসে।
৬.
এরপর সবকিছুই খুব দ্রুত ঘটেছিল। কাকিমা লোকটির কলার ধরে সপাটে তিন-চারটে বিরাশি সিক্কার চড় কষালে জেনারেল কলরব ছাপিয়ে চিৎকার করতে থাকেন, ‘ফাজলামো হচ্ছে, তাই না? জানোয়ারের বাচ্চা, দেশলাই হয়েছ? চাবকে তোমার ছাল তুলে দেব।’ সবক’টা চড় লোকটার গালেই পড়েছিল, সে বিষয়ে আমরা কেউ-ই শিওর নই, কারণ কোলাহল স্তব্ধ হলে কাকিমার হাতে সুকান্তর জামার কলার এবং পদতলে ব্যানার্জি জেঠুকে অজ্ঞান অবস্থায় চিৎপাত হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। সুকান্তকে তারপর বহুকাল কেউ দেখেনি। এই লোকটা আমাদের আপাত শান্ত জীবনে স্টোনম্যানের আতঙ্ক সঙ্গে নিয়ে ফিরে এসেছিল। সে গল্পে পরে আসছি।
অতএব নারানদা চুনি-পান্না সেজে জ্যান্ত স্টোনম্যান হয়ে ঘুরে বেড়ানোয় তেমন কোনও বড় সামাজিক বিপর্যয় ঘটেছিল, বলা যাবে না। তবে বিহার মোড়ের কাছে বাবাজিদের আশ্রমের দেওয়ালে বহুকাল যাবৎ চৈতন্য মহাপ্রভু, নিত্যানন্দ এবং অনেকানেক অজানা অচেনা নেড়া-নেড়িদের সংকীর্তনের ছবি আঁকা ছিল। দোলের পর তাতে প্রতি বছর নতুন রং চড়ত, এবং দেওয়ালচিত্রটি ছিল সমগ্র এলাকাবাসীর অত্যন্ত প্রিয় একটি গর্বের বিষয়। স্টোনম্যানের ঘটনা সমাজকে গ্রাস করার কিছুদিনের মধ্যে কিছু ফাজিল ছোকরা হাত তুলে নৃত্যরত প্রতিটি বাবাজির দু’হাতের মাঝে একটি বড় পাথড়ের চাঁই ধরিয়ে দেয়। অপূর্ব শিল্পকর্মের ফলে এফেক্টটা মারাত্মক হয়েছিল। এখন হলে সাইকাডেলিক ব্যাপারটাকে ম্যাজিক রিয়ালিজমের চূড়ান্ত প্রকাশও বলা যেত অনায়াসে। গেরুয়া বসন পরা, টাক মাথা, তিলক কাটা, বড় বড় অর্ধনিমিলিত চোখওলা কিছু স্টোনম্যান খোল-কত্তাল বাজিয়ে হরে কৃষ্ণ গাইতে গাইতে ভাবে বিভোর অবস্থায় পাথড় উঁচিয়ে মাথা থেঁতলাতে আসছে দৃশ্যটি দেখে তামাম জনতা বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। পানিট্যাঙ্কি, নকশালবাড়িগামী প্রতিটি বাসের যাত্রীরা বাগডোগরা এলেই জানালায় ঝাঁপিয়ে পড়ত, এবং গোটা জেলায় তো বটেই, সূদুর আলিপুরদুয়ারেও ওই রকমই দেওয়ালচিত্র ডেসিক্রেট করে নালায়েক বাচ্চারা ভয়ানক আমোদ আহ্লাদে মেতেছে ইত্যাদি খবর লোকমুখে চাউর হতে লাগল।
দাসবাবু অনেকটাই বেশি বয়সে নাগপুর বা ওইরকম কোনও পশ্চিমা শহর থেকে রেল কোম্পানির কাজে ইস্তফা দিয়ে পাড়ায় থাকতে এলেন– মিনতি কাকিমা ওঁরই মেজবোন। অকৃতদার ভদ্র গোছের মানুষ, তবে ‘কী করা হয়’ জানতে চাইলে নাকি বলেছিলেন, ‘হান্টার।’ এরপর ওঁর নানা রকম বাঘ-শিকারের গল্প লোকের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। স্টোনম্যানের হাতেই সকলের অবধারিত মৃত্যু ইত্যাদি বিশ্বাস যখন প্রতিষ্ঠিত সত্যের ন্যায় আমাদের সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করে ফেলেছে, সে সময় উনি দেখলাম আর রিস্ক নিচ্ছেন না, সন্ধের পর একটা লাঠি হাতে ব্রিজ খেলতে বেরচ্ছেন– দেখাদেখি তারপর অনেকেই। আমাদের মধ্যে জোর জল্পনা শুরু হল বন্দুকটা কোথায় সে নিয়ে। বেশিরভাগই মেনে নিল ওটা লুকনো আছে, সকলকে দেখাতে নেই এবং দরকার পড়লে ঝট করে বের করা কোনও ব্যাপারই না। আমাদের এলাকার আবহাওয়া এর ফলে বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠল। হাতের নাগালে একখানা জলজ্যান্ত বন্দুক চালানোর লোক গোটা একটা বন্দুক সহ থাকায় স্টোনম্যানের পক্ষে যে আমাদের কেশাগ্র স্পর্শ করা সম্ভব নয়, সে বিষয়ে আমরা সকলেই নিঃসন্দেহ ছিলাম। তবে কিছু ওপরচালাক ইঁচড়ে-পাকা গোছের বেয়াদবকে সবসময় সব সমাজেই হাতে-পায়ে বেড়ি না পড়িয়ে এমনি ছেড়ে রাখা থাকে– রেশন দোকানের নিমাই সামন্ত ছিল সেইরকম একজন। নিমাইদাই প্রথম ওকে ব্রিজ খেলতে যাওয়ার সময় কথা নেই, বার্তা নেই জিজ্ঞেস করে বসে, ‘তা আপনার বন্দুকটা কই?’ উনি গোড়ায় খানিকটা ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও সামলে নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘কীসের বন্দুক?’
‘কেন, বাঘ মারার বন্দুক!’
‘কোন বাঘ?’
‘কেন, রয়াল বেঙ্গল টাইগার?’
‘সে আবার কী?’
‘সে আবার কী মানে? লোকজনকে বলে বেড়াচ্ছেন হাজার হাজার বাঘ মেরেছেন, এদিকে বন্দুকের কোনও খোঁজ নেই! সকাল বিকেল রাইফেল কাঁধে এলাকায় দু’-এক চক্কর ঘুরে বেড়ালেও তো পারেন ছেলেছোকরাদের সঙ্গে তাস খেলে সময় নষ্ট না করে।’
ব্যাপারটা এখানেই থেমে গেলে ভালো হত, তবে এর দ্বিমাত্রিক এফেক্ট আমাদের সকলকেই যথাবিধ সচকিত করে তোলে। প্রথমত ‘ছেলেছোকরা’ বলায় নিমাইদার জেঠামশাই ওকে আগাপাস্তলা জুতোপেটা করেন– ভদ্রলোক ওই তাসের আড্ডার নিয়মিত সদস্য ছিলেন। জুতোটা বাড়ি বয়ে দিয়ে এসেছিলেন কমলাহরিণী বালিকা বিদ্যালয়ের নারান স্যর এবং ফেরত নেওয়ার সময় সেটি আর একেবারেই ব্যবহারযোগ্য নেই দেখে সর্বসমক্ষে আনন্দাশ্রু বর্ষণ করেন। দ্বিতীয়ত, থানার বড়বাবু অচিরেই দাসবাবুকে যাকে বলে পথিমধ্যে পাকড়াও করে ভয়ানক কড়া গলায় শুধান, ‘কী ব্যাপার মশাই, শুনলাম বন্দুক কাঁধে এলাকায় টহল দিয়ে বেড়াচ্ছেন আজকাল! সুযোগ পেলে বাঘ, হরিণ, বুনো শুয়োরও মারছেন দেদার! ওবেলা থানায় গিয়ে লাইসেন্সটা দেখিয়ে আসবেন।’
অতঃপর দাসবাবু মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে গলায় দড়ি দেওয়ার, এবং অকৃতকার্য হলে নিজেই পাথড় জোগাড় করে সকলের মাথা থেঁতলে জেলে যাওয়ার হুমকি দেন। বন্দুক নিয়ে সবটা সন্দেহ দূর না হলেও আমরা সেদিনের পর মোটামুটি মেনেই নিয়েছিলাম যে ওর কাছে কষ্মিনকালেও কোনও ধরনের বন্দুক ছিল না। অতএব স্টোনম্যানের ভয় আবার ফিরে আসে, এবং দাসবাবুকে দেখলে প্রায় সকলকেই কেন যে আলগোছে ‘আহা, কারও কাছে একটা ছোট্ট বন্দুক থাকলেও যে কী ভালো হত’ গোছের মন্তব্য করত, সে বলতে পারব না। এইসব গোলযোগের মধ্যে গয়েরকাটার হাটে বলাকা নাট্যসমিতির কমলের সঙ্গে ওই সুকান্ত সাজা লোকটার দেখা হলে কমলের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়। ও সুকান্তকে চা বিস্কুট খাইয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তোকে মিনতি কাকিমা চড়িয়েছিল না? ভুলে গেছিস?’ লোকটা স্থির চোখে ওর দিকে ফিরে বলেছিল, ‘না।’