কুমোরটুলি বলতে যে ঠিক কী বোঝায়, সেই ছবিটা আমাদের অনেকেরই মনে বেশ ভাসা-ভাসা। তার একটাই কারণ যে, কুমোরটুলির মানচিত্র আমাদের কাছে দূরের পৃথিবী। পুজো নিয়ে আমাদের এত আনন্দ-আবেগ, এত উৎসাহের ঘনঘটা, বাঙালির এত নস্টালজিয়া– এর অনেকটাই কিন্তু প্রতিমার অন্দরমহল থেকে দূরে।
পুজোর কথায় কথায় এবার প্রতিমা আনার সময় হয়ে এল। আগের পর্বেই পুজোর জোগাড়ের সাতকাহন শুনিয়েছি আপনাদের। তবে, সেখানে মস্ত একটা কথা বলা বাকি থেকে গিয়েছে। তা হল প্রতিমার কথা। পাঁচদিন যে মৃন্ময়ীকে চিন্ময়ী রূপে পুজো করা হবে, তাঁর বায়না দেওয়াটাও কিন্তু পুজো-প্রস্তুতির একান্ত অঙ্গ। অতএব চলো মন কুমোরটুলি।
কুমোরটুলি বলতে যে ঠিক কী বোঝায়, সেই ছবিটা আমাদের অনেকেরই মনে বেশ ভাসা-ভাসা। তার একটাই কারণ যে, কুমোরটুলির মানচিত্র আমাদের কাছে দূরের পৃথিবী। পুজো নিয়ে আমাদের এত আনন্দ-আবেগ, এত উৎসাহের ঘনঘটা, বাঙালির এত নস্টালজিয়া– এর অনেকটাই কিন্তু প্রতিমার অন্দরমহল থেকে দূরে। সত্যি বলতে, শৈশবে রবি ঠাকুরের ‘কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি’… পড়েই আমাদের বড় হওয়া। তবে পড়লেও কুমোরপাড়ায় গিয়েছেন আর ক’জন! অতএব যে বাংলা মুখের প্রতিমা দেখে আমাদের মনে শরতের সোনা-রোদ খেলে যায়, সেই প্রতিমা তৈরির পাঠশালা আমাদের কাছে ততটা পরিচিত নয়। আজকাল অবশ্য ইনস্টাগ্রাম রিল্স আর ফেসবুকে ফোটোগ্রাফারদের ছবিতেই অধিকাংশের কুমোরটুলি দর্শন। তবে ভার্চুয়াল সেই প্রতিমা-পদাবলিতে আর মাটির গন্ধ কই!
আমি কুমোরটুলি যাচ্ছি অনেক ছোটবেলা থেকেই। ঠাকুমার হাত ধরেই আমার যাওয়া। তখন যেতাম কী হচ্ছে না হচ্ছে, তা বুঝে নিতে। আমাদের বাড়ির ঠাকুর যে বেদিতে বসে, তাঁর মাপটা ঠিকঠাক রাখতে হয়। বড় হলে আবার সিংহাসনে মূর্তি বসানো যাবে না। তারপর ঠাকুরের হাত ঠিকঠাক হয়েছে কি না, বা চোখ লেখার পর্ব কেমন চলছে, এগুলোরই খোঁজ নিতেন ঠাকুমা। হ্যাঁ, থমকে যাবেন না। প্রতিমায় চোখ আঁকাকে চোখ লেখা-ই বলে কুমোরপাড়া। চক্ষুদান বলে না, চক্ষুদান হয় মহাসপ্তমীর সকালবেলা। আসলে প্রতিটা অঞ্চলের কিছু নিজস্ব ভাষা থাকে, যা মিশে থাকে সেই এলাকার জল-হাওয়ায়। কুমোরটুলির ছবি দেখে তা আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। এই যে প্রতিমার হয়ে-ওঠা তার সাক্ষী না থাকলে পুজোর আমেজ যেন সম্পূর্ণ হয় না। সত্যি বলতে, পুজো যে মাত্র পাঁচদিনের নয়, তা সবথেকে ভাল জানে বোধহয় কুমোরটুলি।
সেই ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত– কুমোরটুলির ওই সরু গলি ধরে যে কতবার হেঁটে গেছি তাঁর হিসাব নেই। দু’-পাশে দেবতাদের অধিষ্ঠান। বিশ্বাস করুন মনে হয়, মাটিতে স্বর্গ যদি কিছু থাকে, তবে তা এই কুমোরটুলিতেই। আর শিল্পের এমন উন্মুক্ত প্রদর্শশালাই বা আর কোথায়! বাংলার যে স্বাভাবিক সৌন্দর্যপ্রীতি, আর তাঁর নেপথ্যে মিশে থাকা শিল্পীদের অক্লান্ত পরিশ্রম, সবই যেন ভাস্বর হয়ে ওঠে কুমোরটুলির পরতে পরতে। দেখতে দেখতে প্রায় দেড় দশক হয়ে গেল যে, কুমোরটুলি আর পুজো আমার কাছে সমার্থক হয়ে গিয়েছে। ছোটবেলায় যে কুমোরটুলি দেখেছি, তা অন্যরকম। তখন ভিড়, ঠেলাঠেলি ছিল অনেক কম। এত ঠাকুর তৈরি হতে দেখার বিস্ময়ও ছিল। গত তিন বছরে পুজোর একমাস আগে থেকে প্রায় রোজই কুমোরটুলি যাই। বাড়ির প্রতিমার জন্য যা তদারকি, তা তো করতেই হয়। সেই সঙ্গে আছে ছবি তোলার ঝোঁক। ছবি তুলতে শেখার পর থেকে পুজো ব্যতিরেকেও অন্য সময় কুমোরটুলি যাতায়াত আরও বেড়েছে। কত মানুষের সঙ্গে যে আলাপ হয়েছে এই পর্বে! প্রতিমাশিল্পের ছোট থেকে ছোটতর জিনিসের ভিতরও যে এত রোমাঞ্চ লুকিয়ে আছে, তা এই শিল্পীদের সঙ্গে না মিশলে বোঝা যায় না। বাড়ির পুজো বাদ দিলেও কুমোরটুলির নেশা আমাকে যিনি ধরিয়েছিলেন তিনি সকলের প্রিয় শিল্পী ভোলাদা। মানুষটার বুকের ভিতর যেন আস্ত একখানা আকাশ লুকিয়ে রাখা ছিল। গল্পে-কথায়, আদরে-আপ্যায়নে, ভালবাসা-আন্তরিকতায় সেই আকাশের আলোয় আমি অনুভব করতাম অনবদ্য শরৎ। আজও কুমোরটুলি যাই, তবে ভোলাদা আর নেই। বিশ্বাস যেন হয় না, ভোলাও যায় না। আর কুমোরটুলির আনাচ-কানাচ আমাকে যিনি চিনিয়েছেন, তিনি অধুনা আমারই সহকর্মী শুভ্ররূপ বন্দ্যোপাধ্যায়, আমরা বলি ‘টয়দা’। দেখে মনে হয়, কুমোরটুলির যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই ছবি। বাস্তবটা তা নয়। ক্যামেরা তাক করলেই ছবি হয় না, বরং তাঁর মধ্যেও প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে হয়। কুমোরটুলির অলি-গলি ছুঁয়েই এই সহজপাঠ আমায় শিখিয়ে দিয়েছেন টয়দা। বলতে গেলে এই দু’জনের হাত ধরেই কুমোরটুলি ঢুকে পড়েছে আমার ব্যক্তিগত পুজোর পাঁচালিতে।
এখন শরৎ আসতে না-আসতেই ফোটোগ্রাফার আর ব্লগারদের তাণ্ডব! ট্রাম দোকানের চা, ঢাকেশ্বরী মন্দির, কুমোরটুলি ঘাটের পাড়ে বসা আর জ্যান্ত দুর্গার ফোটোশুট– সব মিলিয়েই দুর্গাপুজোর কুমোরটুলি। তবে দিন যাচ্ছে যত, নিজেকে বদলাচ্ছে কুমোরটুলি। যাদের দেখে বড় হয়েছি, কুমোরপাড়ার গলির ধারে নিজেদের ঘরের দরজায় বসে মা দুর্গার মুখ সারছেন, তাঁরাই আজ হারিয়ে যাচ্ছেন। কাকে দেখে মানুষ আর কুমোরটুলির টানে ছুটবে! জানি না। ফোটোগ্রাফারদের কাছেও আর নতুন কোনও ‘ক্যারেক্টার’ নেই, যাকে ঘিরে একটা ভাল ছবি হবে। এক জিনিসের ছবি তুলতে মানুষের কতদিন আর ভাল লাগে!
কিন্তু যত পরিবর্তনই আসুক পটুয়াপাড়ার গলিতে, আমার কুমোরটুলি বদলায় না। আমি যে ঠাকুরদালানকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরি বছরভর, সেখানে অনেকটা অংশ জুড়ে আছে কুমোরটুলি। আপন জৌলুসে তা চিরউজ্জ্বল। ইনস্টাগ্রাম রিলস তার কতটুকুই আর ধরতে পারে!