কোন উপায়ে লুপ্ত বৃন্দাবনকে ভরিয়ে তুললেন রূপ-সনাতন?
Published by: Robbar Digital
Posted on: March 10, 2024 7:51 pm
Updated: March 10, 2024 7:51 pm
ভারত সম্রাট আকবর এসেছিলেন সনাতনের কাছে বৈষ্ণব ধর্মের সার জানতে, জয়পুরের রাজা মানসিংহ এসে সনাতনের পাণ্ডিত্য আর ঈশ্বরানুরাগে মুগ্ধ হয়ে বৈষ্ণব ধর্মে শরণ নিয়েছিলেন। গড়ে দিয়েছিলেন বেশ কিছু মন্দির। আবার আকবরের পৌত্র ঔরঙ্গজেবের বৃন্দাবন আক্রমণের আগেভাগে রাজপুতরা বিভিন্ন মন্দির থেকে বিগ্রহগুলো তুলে নিয়ে যায় জয়পুরে, সেগুলির পবিত্রতা রক্ষার্থে।
কৌশিক দত্ত
৪.
মাত্র ২৪ বছর বয়সে সন্ন্যাস নিয়ে নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে বৃন্দাবন যেতে মনস্থ করলেন নিমাই পণ্ডিত। সঙ্গীরা চাইলেন অন্তত একবার মায়ের সঙ্গে, এতদিনের সকল বন্ধু, অনুচরদের সঙ্গে দেখাটুকু করে যান, যদি কোনওভাবে সিদ্ধান্তের বদল হয়। বাসভূমি থেকে খানিক দূরেই ভুলিয়ে নিয়ে এলেন সঙ্গীরা, দেখা হল মা ও অন্যান্য প্রিয়জনদের সঙ্গে। মায়ের আদেশে গন্তব্য বদলে বৃন্দাবনের বদলে চললেন শ্রীক্ষেত্রের পানে। কিন্তু বৃন্দাবনের টান, যার মরমে কৃষ্ণের বংশীর ডাক আসে, সে কি আর ভোলে? তাই জগন্নাথের টান, রাজার আনুগত্য, সঙ্গী সেবকদের ভক্তি আতিশয্য উপেক্ষা করেই আবার চললেন বৃন্দাবনের পথে। ভক্তদের আশ্বস্ত করে বললেন,
‘বৃন্দাবন যাব আমি গৌড়দেশ দিয়া।
নিজ মাতা আর গঙ্গার চরণ দেখিয়া।।’
তারপর একজনকে সঙ্গী করে চললেন বৃন্দাবনে। পথে পড়ল কাশী, প্রয়াগ আর যে যে দেশ ও তীর্থ, সেখানে কৃষ্ণনামের পুণ্যধারা বইয়ে দিলেন। শেষে বৃন্দবনে এসে শ্রীকৃষ্ণের সকল লীলাস্থল দর্শন করতে রইলেন। গজনীর সুলতান মামুদ ১৭ বার ভারত আক্রমণ ও ব্যাপক লুটতরাজের সঙ্গে সঙ্গে বহু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেন। বৃন্দাবনের কৃষ্ণলীলা স্থলগুলিও অব্যাহতি পায়নি। বৃন্দাবনের অবস্থা দেখে স্থির করলেন বৃন্দাবনের হৃতরূপ পুনরুদ্ধার করতে হবে। তাই প্রাক্তন রাজকর্মচারী– দুই ভাই রূপ আর সনাতনকে দীক্ষা দিয়ে সেই দায়িত্ব অর্পণ করলেন শ্রীচৈতন্য।
রূপ আর সনাতন দুইভাই অবিলম্বে গুরুর আদিষ্ট কর্মে আত্মনিয়োগ করলেন। না ছিল আশ্রয় বা ভোজনের নিরাপত্তা, কিভাবে আরাধ্য কর্ম পালন করবেন, সেইসব না ভেবে মাধুকরী করে জীবননির্বাহ করতে করতে একে একে লুপ্ত বৃন্দাবনকে ভরিয়ে তুললেন তার পূর্বস্মৃতি মাধুর্যে। আজকের বৃন্দাবন সেই বঙ্গসন্তানদেরই নির্মিতি। হরিলাল চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘শ্রীশ্রী বৈষ্ণব ইতিহাস’। ওই বইতে বৃন্দাবনে অবস্থিত বিভিন্ন দেব ও দেবীর মূর্তি ও মন্দির সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন তিনি। তাঁর তথ্য অনুযায়ী, সেখানে বহু বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা চৈতন্য পরিকরবৃন্দ নানা সময়ে গড়ে তোলেন। রূপ গোস্বামী প্রতিষ্ঠা করেন গোবিন্দদেবের মূর্তি, রাধাদামোদরের মূর্তিখানি নাকি তিনি নিজে হাতে গড়ে ছিলেন। সনাতন গোস্বামী প্রতিষ্ঠা করেন মদনগোপাল মূর্তি।
‘বৃন্দাবন আচার্য শ্রীরূপ সনাতন
প্রভুর মনোবৃত্তি প্রকাশিলা দুইজন।।
লুপ্ততীর্থ ব্যক্ত করি শাস্ত্র প্রমাণেতে।’
সনাতন গোস্বামী তখন বৃন্দাবনে পথের পাশে এক ঝুপড়িতে বাস করেন, আহার বলতে সামান্য মাধুকরীতে যা মেলে। প্রায়শই সামান্য আটা জুটত, আর সেইদিয়ে ক’টি পোড়ারুটি বানিয়ে ঠাকুরকে নিবেদন করে নিজে সেই প্রসাদ নিতেন। একরাতে ঠাকুর স্বপ্ন দিয়ে অনুযোগ করলেন, শুধু রুটি খেতে তাঁর ভারী অসুবিধে হয়, সামান্য একটু নুন না হলেই নয়। সনাতন ক্ষুব্ধ হয়ে ঠাকুরকেই তিরষ্কার করে বসলেন। এখন নুন, পরে আরও ভালো ভালো খাবার দাবার, কাপড়, গয়না, আর কি না কী চাইবেন। সেইসব জোগাড় করতে গেলে গুরু আদিষ্ট কাজ করবেন কখন সনাতন! এরপরেই নাকি এক বণিকের পসরা ভরা নৌকা যমুনায় আটকে গেলে তিনি সনাতনের কাছে প্রার্থনা করতে যান। সনাতন তাঁকে মদনগোপালের কাছে আর্জি জানাতে বলেন। সেই মতো প্রার্থনা করে বণিক উদ্ধার পেয়ে বাণিজ্যে প্রভূত লাভ করেন। সেই লাভের টাকা দিয়ে তিনি মদনগোপালের মন্দির ও ভোগের ব্যবস্থা করে যান।
বৃন্দাবনের অন্যতম সেরা মন্দির ও বিখ্যাত বিগ্রহ হল বাঁকে বিহারীর বিগ্রহ। সারস্বত ব্রাহ্মণ হরিদাস স্বামীর প্রতিষ্ঠিত। এই হরিদাস স্বামীরই শিষ্য ছিলেন রামতনু মিশ্র, ইতিহাস যাঁকে চেনে মিঞা তানসেন নামে। অতি উচ্চকোটির সাধক ও সঙ্গীতের দিকপাল ছিলেন এই হরিদাস স্বামী। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাঁকে বিহারী, যাঁকে তিনি কুঞ্জবিহারী নামে ডাকতেন, অলৌকিক কাহিনির খনি বলা যায়। প্রথমত নিত্যদিনে তাঁকে দইবড়া দিয়ে ভোগ দিতে হয়। অনেক কাল আগে তিনি নাকি দইবড়া খেতে গিয়ে দোকানীকে তাঁর হাতের বালা দিয়ে দাম মিটিয়ে ছিলেন। আরেকবার এক সাধিকা তাঁর দিকে অপলক দৃষ্টিতে প্রতিদিন চেয়ে চেয়ে তাঁর সঙ্গ কামনা করতেন বলে একদিন তাঁর সঙ্গে মন্দির ছেড়ে যাত্রা করেছিলেন। হরিদাস স্বামী বুঝতে পেরে সেই থেকে অল্প সময় পর পরেই বিগ্রহের সামনে পর্দা টেনে আড়াল করে দেন, যাতে কোন ভক্তই বেশীক্ষণ বিগ্রহের দিকে তাকিয়ে থাকতে না পারে।
বৃন্দাবনের অন্যতম সেরা মন্দির ও বিখ্যাত বিগ্রহ হল বাঁকে বিহারীর বিগ্রহ। সারস্বত ব্রাহ্মণ হরিদাস স্বামীর প্রতিষ্ঠিত। এই হরিদাস স্বামীরই শিষ্য ছিলেন রামতনু মিশ্র, ইতিহাস যাঁকে চেনে মিঞা তানসেন নামে। অতি উচ্চকোটির সাধক ও সঙ্গীতের দিকপাল ছিলেন এই হরিদাস স্বামী। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাঁকে বিহারী, যাঁকে তিনি কুঞ্জবিহারী নামে ডাকতেন, অলৌকিক কাহিনির খনি বলা যায়। প্রথমত নিত্যদিনে তাঁকে দইবড়া দিয়ে ভোগ দিতে হয়। অনেক কাল আগে তিনি নাকি দইবড়া খেতে গিয়ে দোকানীকে তাঁর হাতের বালা দিয়ে দাম মিটিয়ে ছিলেন।
‘The Travel of a Hindoo’ নামের এক অনন্য ভ্রমণ কাহিনি লেখেন ভোলানাথ চন্দ্র। বইটি লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর মথুরা ও বৃন্দবন ভ্রমণকথায় উঠে আসে ফা-হিয়েনের দেখা মথুরার ছবি, তখনও সেখানে নাকি ছিল সাতটি স্তুপ, যার মধ্যে রক্ষিত হত বুদ্ধদেব ও তাঁর প্রধান শিষ্যদের কোনও না কোনও স্মৃতিচিহ্ন। ২০টি মঠ আর ৩০০০ সন্ন্যাসীর উপস্থিতির কথাও জানা যায়। তুলনায় মাত্র ৫টি হিন্দু মন্দিরের কথা পাওয়া যায় সেই বিবরণে। ক্রমে বৌদ্ধদের হটিয়ে হিন্দুরা দখল নেয়, গড়ে ওঠে অজস্র হিন্দু মন্দির। সুলতান মামুদ লুট আর ধ্বংসলীলা চালিয়ে তছনছ করে দিলে, ক্রমে আবার ধীরে ধীরে কৃষ্ণজন্মভূমি বলে কথিত মথুরা ও কৃষ্ণলীলাস্থল বৃন্দাবন রূপ সনাতনের সঙ্গে গৌড়ীয় বৈষ্ণবেরা সম্মিলিতভাবে গড়ে তোলেন। ভারত সম্রাট আকবর এসেছিলেন সনাতনের কাছে বৈষ্ণব ধর্মের সার জানতে, জয়পুরের রাজা মানসিংহ এসে সনাতনের পাণ্ডিত্য আর ঈশ্বরানুরাগে মুগ্ধ হয়ে বৈষ্ণব ধর্মে শরণ নিয়েছিলেন। গড়ে দিয়েছিলেন বেশ কিছু মন্দির। আবার আকবরের পৌত্র ঔরঙ্গজেবের বৃন্দাবন আক্রমণের আগেভাগে রাজপুতরা বিভিন্ন মন্দির থেকে বিগ্রহগুলো তুলে নিয়ে যায় জয়পুরে, সেগুলির পবিত্রতা রক্ষার্থে।
একটা কথা প্রায়ই মনে হয়, এই যে এক ধর্মকে হটিয়ে অন্য ধর্মের প্রতিষ্ঠা, এক সম্প্রদায়ের পরিবর্তে অন্য সম্প্রদায়ের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা, এও কি সেই রাজা সুলভ আগ্রাসী মনোভাবেরই প্রকাশ নয়? ভারতের নানা তীর্থে জৈন, বৌদ্ধদের মঠ মন্দির ধূলিস্যাৎ করে সেখানে হিন্দু মন্দির, আবার সেগুলিকে ধ্বংস করে মুসলমানদের মসজিদ গড়া, এ যেন ভারতীয় ভারতীয় ইতিহাসের নিয়মিত ঘটনা। এই যেমন আদ্যাস্তোত্রে রয়েছে,
‘বারাণস্যাং অন্নপূর্ণা গয়াক্ষেত্রে গয়েশ্বরী
কুরুক্ষেত্রে ভদ্রকালী ব্রজে কাত্যায়ণী পরা।
দ্বারকায়াং মহামায়া মথুরায়াং মাহেশ্বরী।’
শাক্তপীঠ বা সতী ক্ষেত্র হওয়া সত্ত্বেও উপরোক্ত তীর্থগুলি কিন্তু মূলত শৈব ও বৈষ্ণব তীর্থরূপেই অধিক পরিচিত। ঠিক যেমন শ্রীক্ষেত্র বা পুরীধাম জগন্নাথের জন্য যত প্রসিদ্ধ, বিমলাদেবীর জন্য কি ততটা? বৃন্দাবন কি আদৌ সতীপীঠের কারণে কখনও পরিচিতি পেয়েছিল? শুধুমাত্র এইটুকু জানা যায় গোপকন্যারা সক্কলে মিলে ব্রজধামে কাত্যায়ণীর ব্রত পালন করতেন। প্রার্থনা করতেন, যাতে নন্দগোপের পুত্রকে পতিরূপে লাভ করতে পারেন। সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতেই নাকি শ্রীকৃষ্ণ ব্রজধামে রাসলীলার আয়োজন করেছিলেন। সেই রাসমণ্ডলে সকল গোপিনীর মনে হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সঙ্গে, শুধু তাঁরই সঙ্গে আলিঙ্গনে আবদ্ধ। কৃষ্ণের এই রাসলীলা বৈষ্ণব পণ্ডিতরা নানাভাবে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন আদতে রাধা ও কৃষ্ণ এবং গোপিনীরা, কেউই কৃষ্ণের বাইরের কেউ নয়, তাই পদকর্তা বলেছেন,
‘রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি
অনন্যে বিলসয় রস আস্বাদন করি।’
আর এই লীলাই বৃন্দাবনের সর্বশ্রেষ্ঠ লীলারূপে মান্য করা হয়। কথিত, এই লীলা দেখতে ছদ্মবেশে ব্রজে এসেছিলেন শিব, ধরা পড়ে গিয়েছিলেন কৃষ্ণের চোখে। এও বলা হয়, আজও নিধুবনে প্রতি রাতে রাধা-কৃষ্ণ নিত্য লীলা করেন, যারা কেউ সেই লীলা দর্শনের জন্য গোপনে সেই বনের গা-ঢাকা দিয়ে থেকেছেন, তাঁরা সেই রাতেই হয় মারা গেছেন নতুবা বোবা ও বোধশূন্য হয়ে গেছেন, ফলে ব্যক্ত করতে পারেননি, কী দেখেছিলেন!
মথুরা ও বৃন্দাবন দর্শন প্রসঙ্গে বলে নয়, যেকোনও তীর্থ দর্শন নাকি তখনই সম্ভব হয় যখন তীর্থপতি সেই অধিকার কাউকে দান করেন, কাউকে কাছে টানেন। বৃন্দাবন আগাগোড়াই নানা অলৌকিক কাহিনিতে মোড়া, তবে কি না হনুমান আর পান্ডাদের বড় উৎপাত!
‘কাল আবার বিপ্লব জেগে উঠবে, আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকব’ রোজা লুক্সেমবার্গ
আজ যখন আমরা মার্কস ও এঙ্গেলসের বন্ধুত্বকে নতুন চোখে দেখে কমিউনিস্ট ইতিহাস রচনার কথা ভাবি, তখন একই সঙ্গে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নারীবাদী ইতিহাস খুঁজতে গেলে আমাদের মেয়েদের এই বিপ্লবী কমরেডশিপের সম্ভাবনার, নারীবাদী বন্ধুত্বের রাজনীতির দিকেও নজর দিতে হবে।
সাদা মানুষদের চোখে চন্দননগরের নাগরিকেরা ছিলেন অবজ্ঞার পাত্র
১৭৯৩-তে ফরাসি বিপ্লবের সূত্র ধরে আবার ফরাসিদের হাতছাড়া হয় চন্দননগর। মোট চারবার ইংরেজদের অধীনে থাকার পর ১৮১৬ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত শহরটি ছিল ফরাসিদের দখলে।
সস্তায় ‘সাংস্কৃতিক’ হতে চাওয়া পণ্ডিতদের সুন্দরম্ পড়তে বারণ করেছিলেন সুভো ঠাকুর
হাতে করে পুথির পাত না উল্টে পায়ে করে পৃথিবীর পাতা ওল্টানোর দম্ভ ছিল সুভো ঠাকুর। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ‘ছাপাখানার ছারপোকা’। সুভো ঠাকুরের মৃত্যুদিনে ‘সুন্দরম্’ পত্রিকাকে ফিরে দেখা।