সামোসা আমাদের ভারতে আসে আজ থেকে হাজার বছর আগে আরবি ব্যবসাদারদের মাধ্যমে। সারাদিন পথে চলা এই ব্যবসায়ীরা সন্ধেবেলায় কোনও সরাইখানায় আশ্রয় নিত। সেখানেই পরের দিন পথ চলার খাবার হিসেবে সামোসা বানিয়ে নিত মাংসের পুর দিয়ে– পথ চলতে চলতেই দ্বিপ্রাহরিক ভোজন হয়ে যেত তাতে, রাস্তায় খাবার খুঁজতে হত না।
পিনাকী ভট্টাচার্য
সরস্বতী পুজোর দিন এম্ব্যাঙ্কমেন্ট রোডের অপর পাড়ে অঞ্জলি দিয়ে ইউনিভার্সিটিতে ফিরে ক্যান্টিনে এক প্লেট সামোসা অর্ডার দিতে ক্যান্টিনের মাসিমা আস্তে করে বললেন, ‘অঞ্জলি দিয়ে এসে মাংস খাবেন?’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা তো সামোসা! এ আবার আমিষ কোথা থেকে হল!’ কড়া জবাব এল– ‘কোন দেশ থেকে এসেছ? সত্যিই বাঙালি তো? সামুচাতে গোশ্ত থাকে জানো না!’ মরিয়া হয়ে বললাম, ‘আমাদের ওখানে সামোসা নিরামিষ হয়।’ উত্তর এল– ‘ওটা সামুচা নয়, ওটা শিঙাড়া! সে তো তুমি এখানেও পাবে।’
মাসিমার কথায় মনে পড়ল, সত্যিই তো সামোসার জন্ম দশম শতাব্দীর মধ্য এশিয়ায়, যখন তার নাম ছিল ‘সামোসা’। রুক্ষ প্রকৃতির সঙ্গে আর নিজের অস্তিত্বরক্ষায় প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যে দেশের মানুষ বেঁচে থাকে, সেখানে মুখরোচক, কিন্তু প্রখর দাবদাহেও নষ্ট হচ্ছে না– এমন খাবার সাধারণ মানুষের পছন্দ হবেই। সামোসা জন্মলগ্ন থেকে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, বাগদাদের নামী ঐতিহাসিক আবোল ফাজাল বেহাকি গজনাভি সাম্রাজ্যের ওপর লেখা তাঁর ‘তারিখ-এ-বেয়হাকি’-তে এর জনপ্রিয়তার কথা লিখেছেন। এই সামোসা আমাদের ভারতে আসে আজ থেকে হাজার বছর আগে আরবি ব্যবসাদারদের মাধ্যমে। সারাদিন পথে চলা এই ব্যবসায়ীরা সন্ধেবেলায় কোনও সরাইখানায় আশ্রয় নিত। সেখানেই পরের দিন পথ চলার খাবার হিসেবে সামোসা বানিয়ে নিত মাংসের পুর দিয়ে– পথ চলতে চলতেই দ্বিপ্রাহরিক ভোজন হয়ে যেত তাতে, রাস্তায় খাবার খুঁজতে হত না। খিলজি সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের সাক্ষী আমির খুসরু থেকে শুরু করে তুঘলক আমলে এদেশে আসা ইব্ন বাতুতা– প্রত্যেকের লেখাতেই বাদশা আর তাঁদের উমরাহ্দের সামোসার প্রীতির কথা উল্লেখ আছে। ইব্ন বাতুতার ‘সফরনামা’-তে মহম্মদ বিন তুঘলকের দরবারের এক ভোজে পরিবেশিত মাংসের কিমা, পেস্তা, কাঠবাদাম আর মশলা দিয়ে পুর তৈরি করে পাতলা ময়দার চাদরে মুড়ে ঘি-তে ভাজা ‘সামুশাক’ বা ‘সাম্বুসাক’-এর কথা লেখা আছে, যা পোলাও পরিবেশনের আগে দেওয়া হত পাতে। এর দুশো বছর বাদে লেখা আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’-তে ‘কুতাব’-এর রেসিপির বর্ণনায় ‘হিন্দুস্থানের লোকে একে সামবুসা বলে’ লেখা থেকে বোঝা যায় বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে সাম্বুসা/সামোসা দিল্লির দরবারে দরবারি বাজিয়েছে। শুধু দিল্লি নয়, দেশের যে সমস্ত অঞ্চলে সুলতানি রাজত্ব কায়েম হয়েছিল, প্রায় সব জায়গাতেই সাম্বুসা পৌঁছে গিয়েছিল। পূর্বাঞ্চল বাদে সুলতানি শাসনের আওতায় পড়া অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে নিরামিষাশীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দেশের মানুষ ময়দার খোলের মধ্যে মাংসের বদলে নিরামিষ পুর দিল আর সেই সামোসা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল।
১৫০০ শতকের পুঁথিতে সামোসার চিত্রায়ণ। ঋণ: ব্রিটিশ লাইব্রেরি
সুলতানি আমলে বাংলায় পৌঁছনো সাম্বুসা বাংলায় এসে হিন্দু হেঁশেলে আবির্ভূত হল, কিন্তু সামোসা হিসেবে নয়– শিঙাড়া হিসেবে। আর এই আবির্ভাব নিয়ে যে গল্প তৈরি হয়েছে, সেখানে সাম্বুসার ছায়া অবধি রাখা হয়নি। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের মধুমেহ রোগের জন্যে মিষ্টি খাওয়া বারণ সত্ত্বেও তাঁর প্রধান পাচক একদিন তাঁকে লুচি পরিবেশন করলে রাজা প্রচণ্ড রেগে যান আর সেই পাচককে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। পাচকের স্ত্রী রাজার কাছে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লে রাজা পাচককে আর একটা সুযোগ দেওয়ার মনস্থ করেন, কিন্তু শর্ত রাখেন খুব কম সময়ের মধ্যে তাঁর জন্য গরম গরম কোনও খাবার নিয়ে আসতে– সেটা তাঁর মনপসন্দ হলে তবেই তিনি পাচককে পুনর্বহাল করবেন। পাচকের স্ত্রী এত কম সময়ের মধ্যে কী করবে বুঝে উঠতে না পেরে লুচির জন্য বেলা লেচি তিন কোনা করে ভাঁজ করে তাতে লুচির সঙ্গে পরিবেশন করার তরকারি পুর দিয়ে কড়াইয়ে গরম ঘি-তে ভেজে পরিবেশন করল। মহারাজ তা খেয়ে এতই খুশি হলেন যে, পাচককে শুধু পুনর্বহালই করলেন না, পাচক-গৃহিণীকে পুরস্কার অবধি দিলেন। রাজাকে দেখে অমাত্যরা খেল, আর তাদের দেখে প্রজারা। সবাই খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে উঠল আর শিঙাড়াকে আপন করে নিল।
আসল গল্প বোধহয় অন্য, কারণ সাম্বুসার ভারতে আসার অনেক পরে এই গল্প তৈরি। ততদিনে পর্তুগিজরা বাংলায় পৌঁছে গিয়েছে। আর পর্তুগিজদের সঙ্গে আলু এসেছে আর সেই আলুর সঙ্গে এসেছে শিঙাড়া বাঙালির গল্পকথায়। কারণ আলু ছাড়া সামোসা হতে পারে, কিন্তু শিঙাড়া হতে পারে না!
পুনশ্চ আমিষ খাবারে যাদের অনীহা, তাদের অনেকের প্রিয় সামোসার জন্ম কিন্তু সেই আমিষ শিঙাড়ার অনুপ্রেরণায়।
শান্তিনিকেতনে পলাশ-শিমুলের আগুন লেগেছে ডালে ডালে, তখন শক্তিদা আমাদের প্রথম ক্লাসটা নিয়েছিলেন
শান্তিনিকেতন কবিতা লেখার জায়গাই নয়। শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিশ্বভারতীতে বাংলা বিভাগে পড়াতেন যখন, বলেছিলেন একথা। সে নিয়ে নানা উষ্মাও তৈরি হয়েছিল। এই লেখা অধ্যাপক শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শান্তিনিকেতন পর্ব। কবির মৃত্যুদিনে রোববার.ইন-এর প্রণতি।
ব্রাহ্মণ মেয়ের হাতে অনশন ভাঙবেন– দুকড়িবালাকে জেলের অত্যাচার থেকে বাঁচাতে শর্ত দিয়েছিলেন ননীবালা
কখনও ইশারায়, চিরকুটে অন্য বন্দিদের সঙ্গে কথা বলে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে, কখনও পুলিশি নির্যাতনের আহত কমরেডকে নজরদারি এড়িয়ে গার্ডদের ফাঁকি দিয়ে কোনও কমরেডের মন ভালো করতে রুটিতে কিছুটা চিনি মাখিয়ে চমকে দেওয়ার মাধ্যমে, তো কখনও একসঙ্গে বসে সুখ দুঃখ বৃষ্টি বজ্রপাত ভাগ করে এই নিরন্তর অপেক্ষা কাটানোর মাধ্যমে, প্রতিদিন নানাভাবে সংগঠিত হতে থাকে প্রতিরোধ, প্রতিবাদ।
আমাদের ছবি আঁকার জায়গা হিসেবে জুটল কলকাতা আর্ট কলেজের বারান্দা
হঠাৎ একদিন সকালে গান্ধী মেমোরিয়ালের হোস্টেলে এলেন বিখ্যাত গণসংগীত শিল্পী জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। আমাদের জন্য নতুন একটা গান লিখে দিলেন এবং সুর করে শিখিয়ে দিলেন।