কোল-ভিল-নাগা-মুণ্ডা-সাঁওতাল– আমি এঁদের সন্তান। এঁদের সবাইকে নিয়ে কাজ করি। সে সার্বজনীন পুজো হোক বা স্ট্রিট আর্ট ফেস্টিভ্যাল। হয়তো ধীরে ধীরে জানতে পারবে এমন একটা প্রদর্শনীর কথাও, হোয়াইট কিউবে হচ্ছে যা, দু’-তিনজন শিল্পী যৌথভাবে করছে। তা পেইন্টিং, স্কাল্পচার– যে কোনও শিল্পের আঙ্গিকেই হতে পারে। একটাই শিল্প, গড়ে তুলবেন অনেকে। একলা চলো রে নীতিতে কাজ করাটা এখন অন্তত আমার পক্ষে চাপের। যৌথতা ছাড়া শিল্পের কোনও সত্যি গড়ে উঠছে না। আমি খুব কমফোর্ট জোন থেকে আমার শিল্প গড়ে তুলতে পারব না।
১৬.
দুর্গা যদি মানবী হয়ে ওঠেন, মানুষে রূপান্তরিত হন, তাঁকে কেউ কথাকথিত ‘সুন্দরী’ বলবে না। কারণ দুর্গা যুদ্ধে যাচ্ছেন, তাঁর চোয়াল শক্ত, তাঁর হাতের পেশি শক্ত। দুর্গার মধ্যে আসলে নেই কোনও নমনীয়তা। যে-নমনীয়তা সমাজ ভালোবাসে, আশা করে মেয়েদের থেকে– সে নমনীয়তার থেকে বহুদূরে এই দুর্গারূপ। যে রূপে মোহিত হয় বাঙালি প্রেমিক, সেই রূপে কাঠিন্য থাকে না। সমাজ যে দুর্গাকে পুজো করে, সেই দুর্গার কঠিন রূপকে সমাজ ততটা মেনে নেয় না নিজেদের জীবনে। কিন্তু আমার শিল্প, আমার শিল্পচিন্তা তা মেনে নিয়েছে। দুর্গার যে কাঠিন্য, তাকে জায়গা দিয়েছি ক্যানভাসে।
আমার ছবিতে ঘুরে-ফিরে কাঠিন্যময় মুখ আসে। এক প্রতিবাদীর ভাষ্য সেই মুখে ফুটে ওঠে। সেই মুখ আমাদের ততটা চেনা নয়। সেই মুখ আমরা রাজনৈতিকভাবেই চিনতে চাইনি। আমাদের সুবিধার জন্য সরিয়ে রেখেছি। আমি ছবিতে সেই মুখই নিয়ে এসেছি। বারবার। মুখোমুখি এক অস্বস্তি তৈরি করেছি। চাউনিরও তো ভাষা আছে, সেই ভাষা পড়তে পারুক দর্শকরা। ছবি-দেখিয়েরা। আমি চাই বা না চাই, এখন সেই মুখ নানা সময় ফিরে আসে। অতর্কিতে। আশ্চর্যভাবেই। ছবি আমাকে আঁকে, না আমি ছবিকে?
কথা বলার সময় কমে আসছে, বুঝতে পারি এখন। যা বলার, বলে ফেলতে হবে দ্রুতই। সময়টা ভালো না। শিল্প করে কতদিন যে বেঁচে থাকব! টিকে থাকাটা এখন দায়। একথা বলছি আমার একার কথা ভেবে, তা নয়। আমি কোনও দিনই একার কথা ভাবিনি। নিজের আনন্দ-উল্লাসের জন্য শিল্পের হাত ধরিনি। আমি সবাইকে নিয়ে আমার মতো করে চলব। ভেবে বসবেন না, আমি বামপন্থার কথা ভেবে বলছি। কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরেই এই বোধটা আমার তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমার পদবি দিন্দা। আমার পদবির রেওয়াজই এটা। দীনেদের দাদা যিনি, তিনি হচ্ছেন দিন্দা। এক্কেরে ভারতীয় আমি, দেশজ। কোল-ভিল-নাগা-মুণ্ডা-সাঁওতাল– আমি এঁদের সন্তান। এঁদের সবাইকে নিয়ে কাজ করি। সে সার্বজনীন পুজো হোক বা স্ট্রিট আর্ট ফেস্টিভ্যাল। হয়তো ধীরে ধীরে জানতে পারবে এমন একটা প্রদর্শনীর কথাও, হোয়াইট কিউবে হচ্ছে যা, দু’-তিনজন শিল্পী যৌথভাবে করছে। তা পেইন্টিং, স্কাল্পচার– যে কোনও শিল্পের আঙ্গিকেই হতে পারে। একটাই শিল্প, গড়ে তুলবেন অনেকে। একলা চলো রে নীতিতে কাজ করাটা এখন অন্তত আমার পক্ষে চাপের। যৌথতা ছাড়া শিল্পের কোনও সত্যি গড়ে উঠছে না। আমি খুব কমফোর্ট জোন থেকে আমার শিল্প গড়ে তুলতে পারব না।
সময় খুব দ্রুত বদলাচ্ছে। ‘মেটা’ এসে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। চ্যালেঞ্জ এআই-এর সঙ্গেও। মানবিকতার হাতে-কলমে কাজ করার বিরুদ্ধে সেই চ্যালেঞ্জ। এআই কী করছে, তা শিল্পীদের ভাবার কথা নয়। বিজ্ঞানের অগ্রগতি দেখা যায়, শিল্পের অগ্রগতি দুম করে চোখে দেখা যায় না। শিল্প ইতিহাস টেনে কথা বলে। তাই ইতিহাস একদিন কথা বলবে আজকের শিল্প নিয়ে। আসলে যে সময় শিল্পটা হচ্ছে, সেই বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে শিল্প নিয়ে কথা বলা যায় না। তবে, হ্যাঁ ব্যতিক্রম রয়েছে। সবটাই সময়ের বদল, তাকে গ্রহণ করাও তো শিল্পের অংশ।
……………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………….
(চলবে)
লেখায় সঙ্গে ব্যবহৃত প্রতিটি ছবিই সনাতন দিন্দার।
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
পর্ব ১৫: রাষ্ট্র যদি রামের কথা বলে, শিল্পীর দায় সীতার কথাও বলা
পর্ব ১৪: মানচিত্র মোছার ইরেজার শিল্পীর কাছে আছে
পর্ব ১৩: তৃতীয় নয়নকে গুরুত্ব দিই, তৃতীয় লিঙ্গকেও
পর্ব ১২: লাখ লাখ টাকা কামানোর জন্য দুর্গাপুজো করিনি, করব না
পর্ব ১১: বাদল সরকারের থিয়েটার পথে নেমেছিল, আমার শিল্পও তাই
পর্ব ১০: যে কারণে এখন দুর্গাপুজো শিল্প করছি না
পর্ব ৯: এদেশে শিল্প সেক্যুলার হবে না
পর্ব ৮: শুধু শিল্প নিয়ে যারা বাঁচতে চায়, তারা যেন বাঁচতে পারে
পর্ব ৭: ক্যালেন্ডারের দেবদেবীর হুবহু নকল আমি করতে চাইনি কখনও
পর্ব ৬: সাধারণ মানুষকে অগ্রাহ্য করে শিল্প হয় না
পর্ব ৫: দেওয়ালে যামিনী রায়ের ছবি টাঙালে শিল্পের উন্নতি হয় না
পর্ব ৪: দেবীঘটও শিল্প, আমরা তা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না
পর্ব ৩: জীবনের প্রথম ইনকাম শ্মশানের দেওয়ালে মৃত মানুষের নাম লিখে
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved