সৃষ্টির পর পৃথিবী দীর্ঘদিন নিজের তাপের বেগে বিশ্লিষ্ট হয়ে ঘুরেছে, প্রাণ পায়নি, কিছুকেই জন্ম দিতে পারেনি। তার সৌন্দর্য ছিল না, সার্থকতা ছিল না, ছিল শুধু তাপ আর বেগ। আমাদের আপন চিত্ত, সেই অপরিণত পৃথিবীর মতো প্রবৃত্তির তাপে আর বেগে যতদিন কেবলই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, ততদিন আমরা যথার্থভাবে কিছু পেতেও পারি না, দিতেও পারি না।
৯.
একজন বাউলের কাছে রবীন্দ্রনাথ একবার জানতে চেয়েছিলেন ‘তোমাদের ধর্মের বিশেষত্বটি কী আমাকে বলতে পার?’ উত্তর পেয়েছিলেন, ‘গুরুর উপদেশে গোড়ায় আপনাকে জানতে হয়। যখন আপনাকে জানি তখন সেই আপনার মধ্যে তাঁকে পাওয়া যায়।’ রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন ছিল প্রচারের ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহের অভাব নিয়ে, উত্তর ছিল, ‘যার পিপাসা হবে সে গঙ্গার কাছে আপনি আসবে।’ ‘আসছে কি কেউ?’ জানতে চেয়ে হাসিমুখের উত্তর পেয়েছিলেন, ‘সবাই আসবে। সবাইকে আসতে হবে।’
তপোবনে ভারতবর্ষের ঋষি যে কথা বলেছেন, পল্লিগ্রামের বৈরাগী বাউলের মুখেও সেই একই কথার সুর শুনলেন রবীন্দ্রনাথ। মানুষ আপনাকে পাওয়া জন্য বেরিয়েছে। আপনাকে না পেলে, তার আপনার চেয়ে যিনি বড় আপন, তাঁকে যে পাওয়ার উপায় নেই। আপনাকেই শুদ্ধ করে পাওয়ার জন্য মানুষের তপস্যা। শিশুকাল থেকে আপনার প্রবৃত্তিকে, ছোট ছোট বাসনাকে সংযত নিয়মিত করে তোলার চেষ্টা করছে মানুষ। এই চেষ্টাকে সজাগ রাখার জন্য কতরকম আচার অনুষ্ঠানের সৃষ্টি করছে, যাতে নিয়মিত মনে পড়তে থাকে প্রতিদিনের ছোট অস্তিত্বের সীমা ছাড়িয়ে অনেক দূরে অনেক বড় লক্ষ্যে তার জীবনের যাত্রা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
প্রাণশক্তির রহস্য ভেদ করা আজও মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। একটার পর একটা পর্দা সরিয়েও প্রাণের পরিচয় আজও অচিন্ত্য অনন্ত অনির্বচনীয়। কিন্তু যত বড় রহস্যেই আবৃত থাকুক না কেন, আমরা কত সহজে তাকে প্রতিনিয়ত বহন করে চলেছি। সে আমার আপন প্রাণ। পৃথিবীর সমস্ত লোকালয় অরণ্য প্রান্তর ব্যাপ্ত করে প্রতি মুহূর্তে সেই প্রাণের ধারা কত অনায়াসে প্রবাহিত হয়ে চলেছে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
‘আমাদের বৈরাগী বাংলাদেশের একটি ছোট নদীর ধারে এক সামান্য কুটিরে বসে এই আপনির খোঁজ করছে এবং নিশ্চিন্ত হাস্যে বলছে, সবাইকেই আসতে হবে এই আপনির খোঁজ করতে। কেননা, এ তো কোনও বিশেষ মতের বিশেষ সম্প্রদায়ের ডাক নয়; সমস্ত মানবের মধ্যে যে চিরন্তন সত্য আছে, এ যে তারই ডাক। কলরবের তো অন্ত নেই– কত কল-কারখানা, কত যুদ্ধবিগ্রহ, কত বাণিজ্য-ব্যবসায়ের কোলাহল আকাশকে মথিত করছে; কিন্তু মানুষের ভিতর থেকে সেই সত্যের ডাককে কিছুতেই আচ্ছন্ন করতে পারছে না। মানুষের সমস্ত ক্ষুধাতৃষ্ণা সমস্ত অর্জন-বর্জনের মাঝখানে সে রয়েছে। কত ভাষায় সে কথা কইছে, কত কালে কত দেশে কত রূপে কত ভাবে সমস্ত আশুপ্রয়োজনের ওপর সে জাগ্রত হয়ে আছে। কত তর্ক তাকে আঘাত করছে, কত সংশয় তাকে অস্বীকার করছে, কত বিকৃতি তাকে আক্রমণ করছে, কিন্তু সে বেঁচেই আছে। সে কেবলই বলছে, তোমার আপনিকে পাও: আত্মানং বিদ্ধি।’
প্রাণশক্তির রহস্যভেদ করা আজও মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। একটার পর একটা পর্দা সরিয়েও প্রাণের পরিচয় আজও অচিন্ত্য অনন্ত অনির্বচনীয়। কিন্তু যত বড় রহস্যেই আবৃত থাকুক না কেন, আমরা কত সহজে তাকে প্রতিনিয়ত বহন করে চলেছি। সে আমার আপন প্রাণ। পৃথিবীর সমস্ত লোকালয় অরণ্য প্রান্তর ব্যাপ্ত করে প্রতি মুহূর্তে সেই প্রাণের ধারা কত অনায়াসে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। অভাবনীয় এক প্রচণ্ড তেজে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষের দেহের তরঙ্গে সেই শক্তি প্রসারিত হচ্ছে শাখা-প্রশাখায়। কত দুর্ভেদ্য নির্জনতাকে সে স্বজন করে তুলেছে, কত নতুন নতুন বৈচিত্রে সে নিজেকে বিস্তীর্ণ করেছে। একদিকে যেখানে অতলস্পর্শ গভীরতার মধ্যে প্রাণের রহস্য চিরকাল লুকিয়ে আছে, সেখানে এখনও আমাদের প্রবেশাধিকার নেই। অন্যদিকে সর্বত্র কত সহজে সে আমারই হয়ে আছে। দৃশ্য অথচ অদৃশ্য, বদ্ধ অথচ মুক্ত, এক অথচ বহু। অতীত ভবিষ্যৎকে স্পর্শ করে, সেই বিরাট মানবপ্রাণ পৃথিবীজোড়া ক্ষুধাতৃষ্ণা, নিশ্বাসপ্রশ্বাসে, শিরা-উপশিরায় রক্তস্রোতের জোয়ার-ভাঁটায়, দেশ-দেশান্তরে বংশে-বংশান্তরে কত সহজে সে প্রকাশিত হয়ে আছে। সদ্যোজাত শিশুর মধ্যেও সে অনায়াসে আপন হয়ে ধরা দিয়েছে। সেই সহজ প্রাণময় জগৎকে আমরা যে শুধু সহজে ব্যবহার করছি তা নয়, ভালোবাসছি। এতটাই ভালোবাসছি, তাকে আর ছাড়তে চাইছি না।
আমার ‘আপনি’টাকে এমন সহজে আমরা পেতে পারছি না। অথচ আপনাকেই আমাদের সবচেয়ে দরকার। আমাদের অবস্থা পৃথিবীর গোড়াকার অবস্থার মতো। সৃষ্টির পর পৃথিবী দীর্ঘদিন নিজের তাপের বেগে বিশ্লিষ্ট হয়ে ঘুরেছে, প্রাণ পায়নি, কিছুকেই জন্ম দিতে পারেনি। তার সৌন্দর্য ছিল না, সার্থকতা ছিল না, ছিল শুধু তাপ আর বেগ। আমাদের আপন চিত্ত, সেই অপরিণত পৃথিবীর মতো প্রবৃত্তির তাপে আর বেগে যতদিন কেবলই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, ততদিন আমরা যথার্থভাবে কিছু পেতেও পারি না, দিতেও পারি না। যখন আমরা সমস্তকে সংহত করে, সংযত করে, আপনার সত্যটিকে জানি, তখন আমাদের সমস্ত বিচ্ছিন্ন জানা একটি প্রজ্ঞায় ঘনীভূত হয়, সমস্ত বিচ্ছিন্ন বাসনা একটি প্রেমে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে, জীবনের ছোট বড় সমস্তই নিবিড় আনন্দে সুন্দর হয়ে প্রকাশ পায়।
রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘আমার ভিতরকার এই অখণ্ড সামঞ্জস্যটি কেবল জগতের নিয়মের দ্বারা ঘটবে না, আমার ইচ্ছার দ্বারা ঘটে উঠবে।’ সেইখানেই আমাদের সাধনা। সেইজন্যই আমাদের চেতনা, সেইজন্যই আমাদের অসম্পূর্ণতার বেদনাবোধ। সেইজন্যই মানুষের সামঞ্জস্য বিশ্বজগতের সামঞ্জস্যের মতো সহজ নয়। অসংখ্যের ভিড় ঠেলে আমার সহজ সমগ্রতাকে, আমার সত্য আপনাটিকে সহজ করে পেতে হবে আমার নিজের ইচ্ছের জোরেই। আমার সকল ইচ্ছার অভিমুখটি সেই লক্ষ্যে অবিচল স্থির রাখার সাধনা, আমাদের প্রতিদিনের সাধনা। ‘আত্মানং বিদ্ধি’।
…পড়ুন উপাসনাগৃহ-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৮। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি, মানুষকে ত্যাগ করা মানুষের ধর্ম নয়
পর্ব ৭। সমগ্র অখণ্ড সৃষ্টির সৌন্দর্য একটি গানের মতো পূর্ণ
পর্ব ৬। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন উপনিষদ ভারতবর্ষের ব্রহ্মজ্ঞানের বনস্পতি
পর্ব ৫। ‘ঈশ্বর সর্বত্র আছেন’ কথাটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেলে তার মধ্যে আর প্রাণ থাকে না
পর্ব ৪। আনন্দের ভাষা শেখাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মুক্তির পথ
পর্ব ৩। সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল
পর্ব ২। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই
পর্ব ১। ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব