আমি ক্যালকাটা ক্লাবে নীরদচন্দ্রের ব্যক্তিগত গ্রন্থ সংগ্রহের একটি অমূল্য অংশ দেখেছি। কিন্তু দেখিনি তাঁর লেখার টেবিল-চেয়ার। আহা! যদি সম্ভব হত তাদের একবার দেখতে পাওয়া, তাদের প্রণাম করা। তাদের গায়ে একটিবার আদরের হাত বলানো। সেই টেবিল তো নীরদবাবুর ‘বাঙালী জীবনে রমণী’ বইটির সমস্ত গভীর বৈদগ্ধ আর সুবর্ণ অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর! সেই বইয়েই তো লিখেছেন নীরদচন্দ্র, যুবতী মেয়ের বুকে বাঙালি যুবকের কুড়কুড়ি দেওয়ার প্রগলভ সরণি উপাখ্যান। ফুটিয়ে তুলেছেন ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ গ্রন্থে বাঙালির আত্মবিন্যাসের মর্ম বেদন। আর ‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন, প্রবল প্রত্যয়ে রবীন্দ্রজীবনে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির অভিশাপ ও যন্ত্রণা।
২৩.
একটি মারাত্মক উদ্ধৃতি দিয়ে এই দুঃসাহসী লেখা শুরু করছি: ‘এই বইটাতে আমি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক ও অন্য কীর্তির এবং তাঁহার জীবনের সত্যরূপ বুঝিবার চেষ্টা করিব। এই দুই ব্যাপারেই তাঁহার সম্বন্ধে সত্য আবিষ্কারের চেষ্টা আজ পর্যন্ত হয় নাই। আমি সারা জীবন সেই রূপটি ধরিবার চেষ্টা করিয়াছি, মনে হয় অবশেষে হয়তো ধরিতেও পারিয়াছি। তবে আমার ধারণায় তাঁহার যে রূপ আসিয়াছে উহা এক নয়, দ্বিধাবিভক্ত। উহা একদিকে আত্মসমাহিত রবীন্দ্রনাথের, অন্য দিক আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথের। এই দুই রূপের অবিচ্ছিন্নতাই তাঁহার জীবনের বৈশিষ্ট্য। তিনি স্বজাতির দিক হইতে যে বিদ্বেষ ও যে আক্রমণের লক্ষ্য হইয়া ছিলেন তাহা তিনি নিজের আত্মসমাহিত প্রতিভার শক্তিতে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিতে পারিতেন। কিন্তু তিনি তাহা না করিয়া এই দুইটির উত্তরে যে পথ ধরিলেন, তাহাতে তাঁহার জীবনে বিরামবিহীন দুঃখ আসিল। এই দুঃখ তিনি নিজেই টানিয়া আনিলেন, সেজন্য উহাকে শুধু আত্মনিপীড়ন নয়, আত্মহত্যাই বলা চলে।’
বলে দিতে হবে না সুবিদ পাঠককে, এই বাংলা ভাষার লেখক এবং এই ভাবনার জনক নীরদচন্দ্র চৌধুরী ছাড়া আর কেউই হতে পারেন না। বইটির নামও যে ‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ’– তাও বলে দিতে হবে না। কারণ, এই বই রবীন্দ্রভক্ত, রবীন্দ্রন্যাকা, রবীন্দ্রমূর্খ বাঙালি চেটেপুটে পড়েছে। তবে একেবারে একালের বাঙালি, যাদের গর্বিত বাবা-মায়েরা সভ্য সমাজে নির্লজ্জ সাংস্কৃতিক ন্যাংটা হওয়ার অপমান মেনে নিয়েও বলে, আমাদের ছেলেমেয়েরা কিন্তু ইংরেজিতেই রবীন্দ্রনাথ পড়ে বেশি আরাম পায়, তারা, মানে সেসব কবুতর ইংরেজি জানা বাঙালিরা নীরদ চৌধুরীর নামও শোনেনি, তাঁর মেধা, বৈদগ্ধ, এবং লেখার রস গ্রহণ তো আলোকবর্ষ দূরের ব্যাপার। এই সব সাংস্কৃতিক বাঙালি ন্যাংটার দল যেন মনে রাখেন এই পরম সত্যটি, এখন অন্তত বাঙালি হয়ে জন্মানোর একটিই গৌরব টিমটিম করছে। তা হল, বাঙালি জন্মের সৌজন্যে মূল ভাষায় আমরা রবীন্দ্রনাথ পড়তে পারি! এই অহং ও গৌরব যেন অতীব আহাম্মক আধুনিক বাঙালিও তার বক্ষে ধারণ করতে শেখে আমৃত্যু।
তবে একটি জরুরি কথা সেই সব বাঙালি বাবা-মাকে জানিয়ে রাখি, যারা তাদের ছেলেমেদের ইংরেজির ছটায় অন্ধ, নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মতো ধ্রুপদী ইংরেজি জানা বাঙালি ডোডো পাখির মতো বাঙালির সংসারে, সমাজে, সভ্যতায় নিখোঁজ! যদিও আমাদের কলকাতা জুড়ে গজিয়ে উঠছে নিত্য নতুন ইংরেজি মাধ্যম ইশকুল! একটা অনুরোধ, অতি আধুনিক পায়রা ইংরেজির আঠায় আটকে যাওয়া বাবা-মায়েদের, এবারের জন্মদিনে ছেলেমেয়েকে কিনে দিন নীরদ চৌধুরীর আত্মজীবনী, ‘The Autobiography of an Unknown Indian’, এই হল বাঙালির লেখা– খাস কিংস ইংলিশ!
……………..
সাংস্কৃতিক বাঙালি ন্যাংটার দল যেন মনে রাখেন এই পরম সত্যটি, এখন অন্তত বাঙালি হয়ে জন্মানোর একটিই গৌরব টিমটিম করছে। তা হল, বাঙালি জন্মের সৌজন্যে মূল ভাষায় আমরা রবীন্দ্রনাথ পড়তে পারি! এই অহং ও গৌরব যেন অতীব আহাম্মক আধুনিক বাঙালিও তার বক্ষে ধারণ করতে শেখে আমৃত্যু।
……………..
যেহেতু আমার লেখায় হামেশাই আড্ডার মেজাজে আমি পুরে দিই এই রকম রঙিন প্রক্ষিপ্তি, কোনওরকম ‘সরি’ না বলেই আমি ফিরে যাচ্ছি নীরদ চৌধুরীর অমল অনন্য বাংলায়: ‘কোনো ব্যাপার হইতে অনিষ্ট হইবেই মনে করিবার পর পরিণামে যদি ইষ্ট হয়, তাহা হইলে বাংলা প্রবাদে উহাকে শাপে বর বলা হয়। কিন্তু বরে শাপ হইল, এইরূপ কোনো প্রবাদ নাই। সুতরাং উহার ধারণাও নাই। তবে আমার মতে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে নোবেল পুরস্কার প্রথমে বর হইলেও শেষে পাপ হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল। নোবেল পুরস্কার যেন ১৯১৩ সন হইতে মৃত্যু পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের জীবনযাত্রায় তাঁহাকে প্রেতের মতো অনুসরণ করিয়াছিল। পুরস্কারটা পাওয়ার ফলে ১৯১৩ সন হইতেই তাঁহার আত্মঘাতী রূপ দেখা দিল দুই দিকে:
১। তখন পর্যন্ত অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালীর মধ্যে তাঁহার সম্বন্ধে যে মনোভাব বিরূপতা মাত্র ছিল, তাহা পুরস্কারের পর বিদ্বেষে পরিণত হইল ও এই বিদ্বেষ ক্রমশ বাড়িয়াই চলিল।
২। তিনিও পাশ্চাত্য জগতে সম্মানলাভ করিবার আসল মূল্য কী মনে মনে বুঝিতে পারিয়াও কার্যত না বুঝিয়া দেশবাসীর প্রতি বিমুখ হইয়া বিদেশীদের মুখাপেক্ষী হইলেন। পরিণামে, বিদেশীদের সম্মান স্থায়ী হইল না, অথচ দেশীয়দের বিরাগ বাড়িল।
এর পর যাওয়া যাক ১৯১৩ সালের ১৩ নভেম্বর রাত ৮ টায় শান্তিনিকেতন। সেই সময় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একজন ইংরেজ, যিনি রবীন্দ্র জীবনের প্রথম গবেষক ও লেখক, এডওয়ার্ড টমসন, তিনি রবীন্দ্রনাথকে বিরল বিহ্বল আনন্দে চিৎকার করে বললেন, Rabi Babu let me have the honour of being the first Englishman to congratulate you. Earth has nothing more for you now. You must commit suicide this night!
এরপর রবীন্দ্রনাথের পরম বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসু একটি মুক্ত সভায় রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কারের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে একটি লজ্জাবতী লতা উপহার দিলেন। রবীন্দ্রনাথের গোলাপি গাল লাল হল। তিনি সভার শেষে তাঁর ভাষণে বললেন, আজ আমাকে সমস্ত দেশের নামে আপনারা যে সম্মান দিতে এখানে উপস্থিত হয়েছেন, তা অসংকোচে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করি এমন সাধ্য আমার নেই। দেশের লোকের হাত থেকে যে অপযশ ও অপমান আমার ভাগ্যে পৌঁছেছে তার পরিমাণ নিতান্ত অল্প হয়নি, এবং এতকাল তা আমি নিঃশব্দে বহন করে এসেছি। যে কারণেই হোক আজ ইওরোপে আমাকে সম্মানের বরমাল্য দান করেছেন। তার যদি কোনও মূল্য থাকে সে কেবল সেখানকার গুণীজনের রসবোধের মধ্যেই আছে।’
রবীন্দ্রনাথের এই কথায় ঈর্ষাকাতর বাঙালি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। লিখছেন নীরদচন্দ্র, ‘রবীন্দ্রনাথের অসংযমের ফল তিক্ত হইল। বাঙালীরা তখন বলিতে লাগিল, ওকে আমরা খুন করব, খুন করব। আর সুইডেনের রাজার প্রতিভূ হিসেবে যিনি রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার দিলেন, তাঁর ভাষণে জানালেন, He must endure the penalty of greatness!’
এইবার আমার মনের মধ্যে যে প্রশ্নটি জারিত হয়েছে এই লেখাটি লিখতে লিখতে তা হল, কেমন সেই টেবিল, কেমন সেই টেবিলের মন, প্রাণ, চেতনা, ভাবনা-স্রোত, যে টেবিলে বসে, তাঁর অক্সফোর্ডের বাড়িতে নীরদচন্দ্র লিখে ফেলেন ‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ’, ‘আত্মঘাতী বাঙালী’, ‘বাঙালী জীবনে রমণী’র মতো তিনটি দুর্বার দরবারি গ্রন্থ, যাদের পাতায় পাতায় চমকে ওঠে বিদ্যুৎবাহী মেধা, মৌলিক মনন, আর বাংলা গদ্যের সাবেকি কৌলিন্য, আভিজাত্য, ধ্রুপদী ধৈবত!
আমি ক্যালকাটা ক্লাবে নীরদচন্দ্রের ব্যক্তিগত গ্রন্থ সংগ্রহের একটি অমূল্য অংশ দেখেছি। কিন্তু দেখিনি তাঁর লেখার টেবিল-চেয়ার। আহা! যদি সম্ভব হত তাদের একবার দেখতে পাওয়া, তাদের প্রণাম করা। তাদের গায়ে একটিবার আদরের হাত বলানো। সেই টেবিল তো নীরদবাবুর ‘বাঙালী জীবনে রমণী’ বইটির সমস্ত গভীর বৈদগ্ধ আর সুবর্ণ অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর! সেই বইয়েই তো লিখেছেন নীরদচন্দ্র, যুবতী মেয়ের বুকে বাঙালি যুবকের কুড়কুড়ি দেওয়ার প্রগলভ সরণি উপাখ্যান। ফুটিয়ে তুলেছেন ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ গ্রন্থে বাঙালির আত্মবিন্যাসের মর্ম বেদন। আর ‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন, প্রবল প্রত্যয়ে রবীন্দ্রজীবনে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির অভিশাপ ও যন্ত্রণা। যে যন্ত্রণার অনেকটাই তিনি নিজেই ডেকে এনেছিলেন তাঁর জীবনে আত্মঘাতী প্রবণতায়!
একটিবার যদি ছুঁতে পারতাম সেই টেবিল! তার চারটি পায়ের খুরে খুরে পৌঁছে দিতে পারতাম হৃদয়নতি!
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ২২: মহাবিশ্বের রহস্য নেমে এসেছিল যে টেবিলে
পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে
পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি
পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল
পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল
পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল
পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে
পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে
পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা
পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল