ভাবি বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে হয়তো। মুস্তফা/মনজুর/মমিন কেউ বাসায় নাই। বয়স্কা একজন দুই কাপ চা রেখে গেলেন। লেখার সময় স্যর ঘন ঘন চা খান, সিগারেট টানেন। লিখছিলেন। ‘তুমি একটু বসো।’ বলে উঠলেন। আমি বসে থাকলাম। কী লিখছেন? বলপয়েন্ট কলমে লেখেন। ছোট ছোট সুস্পষ্ট অক্ষর। পড়ে ফেলতে পারি। চুরি করে পড়ব না। লেখকের লেখা ভূতে পড়তে নাই।
যায় চলে যায় হেমন্তের দিন।
কোথাও শীতের জন্ম হয়ে গেছে। আর কিছুদিন পর শীতকাল।
হুমায়ূন আহমেদ লেখেন সকালে।
আমি তাঁর কাছে যাই সন্ধ্যায়। মোবাইল ফোনে মেসেজ দিয়ে যাই। যদি না থাকেন!
–স্যর আমি কাল আসব?
–স্যর প্রচ্ছদ দেখাতে আসব?
–স্যর আমি কি আজ আসব?
কমন মেসেজ। কিছু রিপ্লাই আমার মোবাইল ফোনে আছে।
–ইয়েস ইয়োর টাকিলা রেডি
–ইয়েস ইয়োর টাকিলা রেডি
–ইয়েস ইয়োর টাকিলা রেডি
আরও পড়ুন: ‘ইন্টেলেকচুয়াল’দের অসফল সমালোচনায় সমরেশদার পাঠক কমেনি
আমার টাকিলা। সবসময় আমার জন্য থাকে তাঁর কাছে। ‘রুমিংহাউস’ বইয়ের প্রচ্ছদ করেছি। দেখাতে যাব।
–স্যর…?
–ইয়েস…। টাকিলা প্রস্তুত।
হেমন্তকালের সন্ধ্যা পার হয়ে গেছি। একবার মনে হল, দখিন হাওয়ায় গেছি, একবার মনে হল ধানমন্ডি ১০ নাম্বার রোডের ‘গুলতাকিন’ বিল্ডিং-এ, একবার মনে হলো শহীদুল্লাহ হলে। হতে পারে আর কোনওখানে।
স্যর প্রচ্ছদ দেখলেন, পছন্দ করলেন।
‘টাকিলা খাও। মুস্তফা…।’
মুস্তফা হাজির তৎক্ষণাৎ। তার নাম মুস্তফা, না মনজুর, না মমিন– সে হাজির।
‘দাদার বোতল এনে দাও। লেবু কেটে আনো কুচিকুচি করে। প্লেটে লবণ দাও।’
দুই শট, চার শট, আট শট টাকিলা। আমি ভালো থাকি, ভালো লাগে। দশ শট বারো শটে কিছু বেগড়বাই। উৎপাত হই, উৎপাত করি।
–বাটারফ্লাই এফেক্ট কী স্যর?
–শ্রোয়েডিংগারের বেড়াল কী স্যর?
–ফিবোনাচ্চি নাম্বার কী স্যর?
উৎপাত বলে উৎপাত, সহ্য করা মুশকিল এতটা। কেন সহ্য করেন? ‘তুচ্ছ কথামালা’র প্রচ্ছদ করেছি। দেখাতে যাব।
–স্যর…?
–ইয়েস…?
প্রচ্ছদ ভালো হয়েছে। টাকিলা আছে।
–‘ধ্রুবদা আপনি হুমায়ূন সাহেবকে কী ম্যাজিক করেছেন বলেন তো?’
–‘আমি কী ম্যাজিক করব ভাবি?’
–‘আরে সে টাকিলা পছন্দ করে না, সেদিন ঢাকা ক্লাবে গিয়ে দেখি কাউন্টারে টাকিলার বোতল খুঁজছে। ক্যামিনো কিনল। আমি বললাম তুমি তো টাকিলা পছন্দ করো না তবে এই বোতল দিয়ে কী করবে? বলে কী, ধ্রুব খাবে। আপনাকে যে কী পছন্দ করে সে!’
ম্যাজিক।
টাকিলা নিবিড় কীসব আশ্চর্য সন্ধ্যা।
হুমায়ূন আহমেদ আমার জন্য টাকিলা কিনে রাখেন।
মিসির আলি সিরিজের নতুন বই লিখছেন– ‘সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া’। প্রচ্ছদ করেছি। দেখাতে যাব।
–স্যর আমি কি কাল আসব?
–সকালে আসো।
সকালে যাই না, কিন্তু বলেছেন। প্রচ্ছদ দেখলেন।
–ভালো হয়েছে, তবে আরেকটা কি করে দেখবে?
তার মানে প্রচ্ছদ পছন্দ হয় নাই। আগে হলে সোজা বলে দিতেন, আরেকটা করো, এটা হয় নাই।
–আরেকটা প্রচ্ছদ করব?
–অবশ্যই।
সেটাও যদি পছন্দ না হয়? আরেকটা করব। সেটাও যদি…?
ভাবি বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে হয়তো। মুস্তফা/মনজুর/মমিন কেউ বাসায় নাই। বয়স্কা একজন দুই কাপ চা রেখে গেলেন। লেখার সময় স্যর ঘন ঘন চা খান, সিগারেট টানেন।
লিখছিলেন।
‘তুমি একটু বসো।’ বলে উঠলেন।
আমি বসে থাকলাম। কী লিখছেন? বলপয়েন্ট কলমে লেখেন। ছোট ছোট সুস্পষ্ট অক্ষর। পড়ে ফেলতে পারি। চুরি করে পড়ব না। লেখকের লেখা ভূতে পড়তে নাই।
স্যর একটা বোতল হাতে করে ফিরলেন।
–টাকিলা! এই সকালে!
না। বোতল দিয়ে বললেন, ‘এটা নিয়ে যাও।’
সাতশো পঞ্চাশ এমএলের বোতল।
নিয়ে যাব? না।
–‘কেন?’
–পুলিশ ভয় পাই। বোতলসহ রাস্তায় পুলিশ ধরলে বিপদ। হেনস্তার একশেষ দুইশেষ না এক হাজার একশেষ করে ছাড়বে।
–‘অ।’
চায়ে চুমুক দিলেন। সিগারেট ধরালেন। আবার উঠে ভেতরে গেলেন। টাকিলার বোতল থাকল। টাকিলা গোল্ড। সোনালি টাকিলা।
ফিরলেন একটা শূন্য পানির বোতল নিয়ে। না, কোকের। টাকিলার বোতল খুলে সব টাকিলা সেই বোতলে ঢাললেন। ‘মুখা’ আর পান না কোকের বোতলের। পানির বোতলের মুখা নিলেন। কোকের বোতলের মুখা লাল, পানির বোতলের মুখা নীল রঙের। এখন এটা টাকিলার বোতল।
দেখছি।
টাকিলার বোতল কাগজে মুড়লেন। বাটার জুতার বাক্সে ভরলেন। বাক্স শপিং ব্যাগে।
–‘এখন নিতে পারবে?’
–‘জি।’
আমার কাছে এখনও আছে সেই বোতলটা। শূন্য। খালি বোতল ঘরে রাখি না। ও-এ নিয়ে যায়।
এটা থেকে গেছে। সোনালি হূমায়ূন টাকিলার বোতল।
সে কোন এক হেমন্তের দিন?
কবেকার?
আজকের?
যায় চলে যায় হেমন্তের দিন।
কোথাও শীতের জন্ম হয়ে গেছে। আর কিছুদিন পর শীতকাল।
হুমায়ূন আহমেদ লেখেন সকালে।
আমি আর টাকিলা খাই না।
রিয়েঙ্কা ইউক্রেনের স্থানীয় ফুটবল দল নাইভা-র হয়ে গলা ফাটাত মাঠে গিয়ে। যুদ্ধের সময় চার মাস রুশ সেনার অধীনে বন্দিত্ব এবং ছাড়া পেয়ে ফ্রন্টলাইনে রাইফেল নিয়ে থাকা। গত ২১ মে মাত্র ২১ ছোঁয়া রিয়েঙ্কা চলে যায় গানশটে! গ্যালারিতে সেই মুখ, টিফো– লেখা– ‘পিস হ্যাজ আ প্রাইস’।