সংসার সমাজ ইতিহাস, সবেরই অনুকূল-প্রতিকূলকে বহন করেছে প্রতিভা বসুর জীবন। দাঙ্গা-দেশভাগ-স্বাধীনতার বালাই বড় বেশি বুঝতে হয়েছে তাঁর পিতৃপরিবারটিকে। সে বর্ণনার অনুপুঙ্খ ‘জীবনের জলছবি’-র পরতে পরতে। গত শতকের তিন-চারের দশকে বিশিষ্ট বাঙালি সাহিত্যিকের সপরিবার দিনাতিপাতের চিত্রও সামাজিক-অর্থনৈতিক ইতিহাসের উপমা। বিদেশের আমন্ত্রণ আর বিদেশবাসের গল্পে ইতিহাসের উপাদান কম নেই, যদি যথার্থ মনোযোগে তার অন্বেষণ করেন পাঠক।
স্মৃতিকথায়, বিশেষত শিক্ষিত বাঙালি মেয়েদের কথকতায় বেশ পোক্ত আড়াল থাকে। সে আড়াল নিজের জীবনের সব থেকে মর্মান্তিক বেদনাকে ঘিরে, নিজের সব থেকে বড় সত্যিকে ঘিরে। ‘জীবনের জলছবি’ (আনন্দ, ১৪০০ ব) নামকরণে প্রতিভা বসু কি সেই আড়ালের স্বীকারোক্তি শুরুতেই করে রেখেছিলেন? প্রত্যক্ষে অবশ্য বলেছেন, প্রায় মুছে যাওয়া যে দিনগুলির স্মৃতি এ-বই লেখবার সময়ে আর বাস্তব নয় তাঁর কাছে, তারা জলছবির মতোই এসেছে তাঁর কথকতার বয়ানে, তাই এই নাম। লেখক হিসেবে উপার্জন যে তাঁকে দৈনন্দিনের বহনে সাহায্য করেছে, সে-কথাটা ফিরে-ফিরেই এসেছে। কিন্তু যাপনের কোন বাস্তব অথবা কোন জলছবি যে তার সৃজনের কোন উপাদানে কিংবা কোন প্রেরণায় চিহ্নিত, তার কোনও হদিশ তিনি নিজে দেননি, কেবল একটি উল্লেখ ছাড়া। বাল্যের সেই স্মৃতিও জলছবি শিরোনামে ধুয়ো দিয়ে যায়। অতি শৈশবে মুকুন্দ দাসের যাত্রা পালা দেখেছিলেন, পালাটি ছিল, মেয়ের বিয়েতে পাত্রপক্ষের পণ নেওয়ার বিরুদ্ধে, পালার গান ছিল ‘ভাই রে মানুষ নাই আর দেশে। মেয়ের বাপের ভাঙা কপাল চোখের জলে ভাসে’। ‘জীবনের জলছবি’-তে আছে, ‘মেয়েদের বিষয়ে ভবিষ্যৎ জীবনে আমি যে এতো স্পর্শকাতর, আমার সমস্ত গল্প উপন্যাস যে মেয়েদের জিতিয়ে দেবার সপক্ষে এতো সোচ্চার, সম্ভবত তার দীক্ষাদাতা… মুকুন্দ দাস’ (পৃ-১৯)। পাঠের এক নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়; প্রতিভা বসুর এই স্মৃতিকথায় বিন্যস্ত বিচিত্র মেয়েদের আলেখ্যকে ভাঙা-গড়ার রেশ কেমন করে পড়া যায় প্রতিভা বসুর সাহিত্যিক বয়ানে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কিন্তু রানু সোম যে তাঁর সাংগীতিক পরিচয়টি বিসর্জন দিলেন, সে কি পুরোপুরি এই কারণে যে “গান করা বিষয়ে আমার নিজেরই কোনো ইচ্ছে বা ঊৎসাহ বাল্যকাল থেকেই নেই… সেই যে ছেলেবেলায় ‘খুকি একটা গান করো’ বলে যে-কোনও সময়ে যে-কোনও ভদ্রলোক এসে অর্ডার দিয়ে গান না শুনে অন্য গল্পে মত্ত থাকতেন এবং গান শেষ হওয়া মাত্রই ‘আর একখানা করো’ বলে আবার অর্ডার দিতেন, সেই বিরক্তি অথবা অচেতন অহংকার গান করাটাকেই আমার কাছে একটা যন্ত্রণার পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল। বিবাহের পরে গান বন্ধ করার সুযোগ নেওয়াটা আমার পক্ষে হয়তো তারই প্রতিক্রিয়া”? (পৃ-১৪৯)
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মামীমার চরিত্রটি অনবদ্য ফুটেছে এই স্মৃতিকথায়। যেমন দুঃখী, তেমনই অসহায়। স্বামীর অবিবেচনা সয়ে সয়ে বিপর্যস্ত, তবু আত্মীয়মহলে কারও প্রতি স্বামীর অন্যায্য আচরণে স্বামীকেই সমর্থন করেন । স্মৃতিকথার নিরুক্ত নীরবতায় যেন শোনা যায় কথাকারের আক্ষেপ– বহু চেষ্টা করেও গল্পে-উপন্যাসে মামীমার তুল্য মানুষের জন্য ছিটেফোঁটা জয়ও অর্জন করা অসম্ভব! পাশাপাশি মজাও কম নেই। একদিকে বিবাহে দ্বিধাগ্রস্ত পাত্রদের দ্বিধা ভাঙতে আগ্রহী পাত্রীদের অনশন (পৃ-৯১), অন্যদিকে আমেরিকান শাশুড়ি ছেলেকে বাঙালি মেয়ে বিয়ে করা থেকে থামাতে না-পেরে শেষমেশ ফরমান দেন, ছেলেপুলে যেন কদাপি না-হয় (পৃ-২২২)। মশকরাও প্রচুর, যেমন, ‘মেয়েদের যে পরের বাড়ি এসে কত হিপোক্রিসি করতে হয় তা কী করে একজন পুরুষ মানুষ বুঝবেন’(পৃ-১২৫)। এমন অবোধ পুরুষের উদাহরণ কিন্তু স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু; যাঁর পর পর দু’দিন একরকম খাবার রোচে না (পৃ-১৩৭), বাড়ির ঠিকানা ‘লেন’ হলে চলে না, রোড কিংবা স্ট্রিট চাই (পৃ-১৪০), অথচ সাংসারিক যাপনের নিরিখে আজ তিনি আগামীকালের কথা ভাবেন না। চার দশক ধরে এই অসামান্য সৃজনশীল মানুষটিকে লালন করার অভিজ্ঞতা স্মৃতিকথায় মূর্ত হয়েছে। এ-ও একরকমের আড়াল ভাঙা নিশ্চয়ই। কিন্তু রানু সোম যে তাঁর সাংগীতিক পরিচয়টি বিসর্জন দিলেন, সে কি পুরোপুরি এই কারণে যে “গান করা বিষয়ে আমার নিজেরই কোনো ইচ্ছে বা ঊৎসাহ বাল্যকাল থেকেই নেই… সেই যে ছেলেবেলায় ‘খুকি একটা গান করো’ বলে যে-কোনও সময়ে যে-কোনও ভদ্রলোক এসে অর্ডার দিয়ে গান না শুনে অন্য গল্পে মত্ত থাকতেন এবং গান শেষ হওয়া মাত্রই ‘আর একখানা করো’ বলে আবার অর্ডার দিতেন, সেই বিরক্তি অথবা অচেতন অহংকার গান করাটাকেই আমার কাছে একটা যন্ত্রণার পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল। বিবাহের পরে গান বন্ধ করার সুযোগ নেওয়াটা আমার পক্ষে হয়তো তারই প্রতিক্রিয়া”? (পৃ-১৪৯)
প্রায় একই সঙ্গে বলেছেন প্রতিভা বসু, সংগীতচর্চার আয়োজন আর অবকাশ বুদ্ধদেব বসুর পরিবেশে ছিল না। সাহিত্যে কারও ভিতরে সামান্যতম সম্ভাবনা দেখলে, তাকে যে যত্নে লালন করতেন বুদ্ধদেব, তার এক শতাংশ আগ্রহও যদি সংগীত প্রসঙ্গে তাঁর থাকত, তবে গানের চর্চা ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হত না রানুর পক্ষে। বিখ্যাত ঠুংরি গায়ক মঞ্জুসাহেবের কাছে স্ত্রীর প্রশিক্ষণের যোগাযোগ বুদ্ধদেবই করে দিয়েছিলেন, বেশিদিন শেখা হয়নি, কারণ, প্রতিভা বসুর কথায়, ‘আমার প্রথমা কন্যাটি অপেক্ষাকৃত একটু তাড়াতাড়িই এসে গেল আমাদের সংসারে’ (পৃ-১৪৯-৫০)। ‘বসুমতী সাহিত্য মন্দির’ বুদ্ধদেব-প্রতিভাকে একত্রে একটি প্রেমের উপন্যাস লেখার আমন্ত্রণ জানায়। সেই প্রসঙ্গে স্মৃতিকথায় আছে, ‘…বিবাহের পরে কখনোই কিছু লিখিনি… ওরকম একজন ডাকাবুকো সাহিত্যিককে বিবাহ করে কিছু লিখবো এমন দুঃসাহস আমার ছিল না’(পৃ-১৪৯)। তবু যে লিখতে শুরু করেন প্রতিভা, সেটা স্বামীর অনুরোধে, প্রকাশকের অনুরোধে নয়, আর প্রায়-সমাপ্ত তাঁর প্রথম উপন্যাস বুদ্ধদেবের এতটাই ভালো লাগে যে, নিজের লেখা ওতে তিনি ঢোকাতে চাননি। এই হল ‘কবিতা ভবন’ থেকে প্রকাশিত প্রতিভা বসুর প্রথম উপন্যাস মনোলীনা। ‘জীবনের জলছবি’-র রচয়িতা বলেন, ‘…বসুমতী সাহিত্য মন্দির আমাকে যে লিখতে বলেছে তার কারণ আমি কখনো লিখেছি বলে নয়, বুদ্ধদেবের স্ত্রী বলে… ভেবেছেন লিখে দেবেন বুদ্ধদেবই… আমার নামটাও ঢোকানো হবে’ (পৃ-১৫০)। এই প্রক্রিয়া মানার মানুষ বুদ্ধদেব নন, সেটা প্রতিভা জানতেন, প্রকাশক নয়। আস্থা ভরে লিখতে বলেছিলেন বুদ্ধদেব, তাই লেখা। পরে যখন প্রতিভার কাছে বই চেয়েছেন কোনও প্রকাশক, প্রতিভার মনে হয়েছে, ‘যে কোনও কর্মই প্রফেশন হিসেবে না নিলে সেটা বেঁচে থাকে না। মেয়েদের জীবনেই এটা খুব বেশি করে দেখা যায়’(পৃ-১৭৪)। সাহিত্য যে তার স্বাধীন রুজির উপায় হল, সে-কথাটাই বলছেন, কিন্তু আড়ালে কি নিহিত আছে হারিয়ে যাওয়া কোকিলকণ্ঠি রানু সোমের জন্য কোনও বিরহের বোধ? নিজের জীবনের আড়াল-আবডালগুলো কর্মব্যস্ত ঘটনাবহুল প্রাত্যহিকে শনাক্ত করা না-ও যেতে পারে। সেখানেই স্মৃতিকথার পাঠকের দায়।
সংসার-সমাজ-ইতিহাস, সবেরই অনুকূল-প্রতিকূলকে বহন করেছে প্রতিভা বসুর জীবন। দাঙ্গা-দেশভাগ-স্বাধীনতার বালাই বড় বেশি বুঝতে হয়েছে তাঁর পিতৃপরিবারটিকে। সে বর্ণনার অনুপুঙ্খ ‘জীবনের জলছবি’-র পরতে পরতে। গত শতকের তিন-চারের দশকে বিশিষ্ট বাঙালি সাহিত্যিকের সপরিবার দিনাতিপাতের চিত্রও সামাজিক-অর্থনৈতিক ইতিহাসের উপমা। বিদেশের আমন্ত্রণ আর বিদেশবাসের গল্পে ইতিহাসের উপাদান কম নেই, যদি যথার্থ মনোযোগে তার অন্বেষণ করেন পাঠক। স্বামীর আকস্মিক অকালমৃত্যু, নিজের চলচ্ছক্তিতে বৈকল্য, সংসার-সমাজের বিভিন্ন বন্ধনে প্রসাদ-বিষাদের বিচিত্র উভটান, এত কিছুর সহনে-বহনেও মানুষটির ইতিবাচকতা ব্যাহত হয় না। এমনকী, একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর আঁধারেও স্নেহাষ্পদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের অনিশ্চিতিতে তিনি সহায় হয়ে ওঠেন। এক শতকেরও বেশি পুরনো মানুষটির মন আর মনন আজও এ-স্মৃতিকথার পাঠককে সম্পন্ন করে।