শিল্পের জন্য শুধু শিল্প, মানুষের জন্য নয়? জনহিতেই যদি তা কাজে না লাগে তাহলে শিল্পের সার্থকতা কি রক্ষা হয়? হয় না। শিল্প তো আসলে অভিব্যক্তি প্রকাশের মাধ্যম। মনের যন্ত্রণা উপশমের মহৌষধি। সেই ভাবনা থেকেই সমাজ ও পরিবারবিচ্ছিন্ন মানুষের সঙ্গে সংযোগস্থাপনের প্রয়াস ‘নিমগ্ন ভুবন’-এর উদ্যোক্তাদের। শিল্পী তারক গড়াইয়ের কথায়, ‘আর্ট থেরাপি’। যার মাধ্যমে যন্ত্রণাক্লীষ্ট একঘেয়ে যাপন থেকে সাময়িক মুক্তি ঘটবে জীবনের উপান্তে পৌঁছে যাওয়া মানুষদের।
প্রচ্ছদ শিল্পী: সোমোশ্রী দাস
হাতে ধরা সাদা আর্ট পেপার, অন্য হাতে পেনসিল। আঁকতে হবে কিছু। তবু পেনসিল আরও স্থবির হয়ে আসে। মনের জানালায় ভিড় করে আসে নানা অম্লমধুর স্মৃতি। দীর্ঘশ্বাস ঠেলে মন বলে ওঠে– ‘না, না। পারব না। ছবি আঁকা আমার দ্বারা হবে না।’
মুকুল মুখোপাধ্যায়ের কথা শুনে পাশে বসা কৃষ্ণা নাহা বলে ওঠেন, ‘কেন পারবে না? যা পারবে আঁকো– পাখি আঁকো, গাছ আঁকো। এই তো আমি আঁকছি। তুমিও পারবে। ছোটবেলায় ছেলেকে আঁকার স্কুলে নিয়ে গিয়েছি। ও আঁকত, আর আমি দেখতাম। এখন সেই ছেলে পঞ্চান্ন।’ কথা এরপর চুপ করে আসে। শুধু সাদা ক্যানভাসে খসখস করে এগিয়ে যায় পেনসিলের কালো রেখা। ভরসা পেয়ে অশীতিপর মুকুলও পেনসিল ধরেন। শুধু একবার মুখ তুলে বলেন, ‘আমার তো ছেলে-মেয়ে কেউ-ই নেই। আমি একা।’
এ বক্তব্য কল্পনাজাত নয়। নয় কোনও বইয়ের পাতা থেকে তুলে আনা। বরং ঘোরবাস্তবের এই ছবি শহরতলির এক বৃদ্ধাশ্রমের, যার নাম– ‘স্বপ্ননীড়’। বিশ্ব আর্ট দিবস উপলক্ষে সোমবার সেই ‘স্বপ্ননীড় বৃদ্ধাশ্রম’-এ ‘নিমগ্ন ভুবন’-এর উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছিল এক বিশেষ শিল্প কর্মশালা। যার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন শিল্পী তারক গড়াই।
কথায় আছে, ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’। সত্যিই কি তাই? শিল্পের জন্য শুধু শিল্প, মানুষের জন্য নয়? জনহিতেই যদি তা কাজে না লাগে তাহলে শিল্পের সার্থকতা কি রক্ষা হয়? হয় না। শিল্প তো আসলে অভিব্যক্তি প্রকাশের মাধ্যম। মনের যন্ত্রণা উপশমের মহৌষধি। সেই ভাবনা থেকেই সমাজ ও পরিবারবিচ্ছিন্ন মানুষের সঙ্গে সংযোগস্থাপনের প্রয়াস ‘নিমগ্ন ভুবন’-এর উদ্যোক্তাদের। শিল্পী তারক গড়াইয়ের কথায়, ‘আর্ট থেরাপি’। যার মাধ্যমে যন্ত্রণাক্লীষ্ট একঘেয়ে যাপন থেকে সাময়িক মুক্তি ঘটবে জীবনের উপান্তে পৌঁছে যাওয়া মানুষদের।
শিল্প কর্মশালায় বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিকদের সঙ্গে একান্ত আলোচনার ফাঁকে শিল্পী তারক গড়াইয়ের যা বললেন তাতে শিল্পীভাবনার একটা বিশেষ দিক উন্মোচিত হয়, ‘আর্ট নিয়ে চর্চা হলেও শিল্পকলার মাধ্যমে বৃদ্ধাশ্রমে থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা, যারা সমাজের চোখে আজ মূল্যহীন, অপাঙক্তেয়, তাদের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলার ভাবনা সেভানে দানা বাঁধেনি। সেই ভাবনা থেকে নিমগ্ন ভুবনের তরফে একটা বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এবং সেই ভাবনাটা আমাকেও আকৃষ্ট করেছে। শিল্প হয়তো এই উপেক্ষিতদের দুঃখ হরণ করতে পারবে না। বা ফেলে আসা দিন ফেরত দিতে পারবে না। শুধু পারবে নির্ভেজাল আনন্দ দিতে। তাই শিল্পের মাধ্যমে আমরা একটা মেলবন্ধন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যন্ত্রণাকে প্রশমিত করতে উদ্যোগ নিয়েছি। প্রতিদিনের যে একঘেয়েমিতে ভরা জীবন, সেটা থেকে যদি তাদের বের করে আনা যায়, তাহলেই আজকের দিনটার সার্থকতা প্রমাণিত হবে।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
শিল্পীর চোখে আশার আলো, ‘আর্ট কালচার’– এই বয়স্ক মানুষদের কাছে অপরিচিত কোনও শব্দ নয়। হয়তো তাঁরা চর্চা করেননি কিংবা করেন না। কিন্তু এটা ভালো মাধ্যম হতে পারে, তাঁদের তরতাজা রাখার জন্য। আমি এই শিল্পের সঙ্গে ৬৫ বছর ধরে যুক্ত। পনেরো-ষোলো বছর বয়স থেকে ছবি আঁকছি। সেই উদ্যমটা এই ৮০ বছর বয়সেও আমি টের পাই। ক্রিয়েটিভিটির জন্য আমি কাজ করি। তার যে আনন্দ, যে আত্মতৃপ্তি সেটা বলে বোঝানো যাবে না।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
শৈল্পিকভাবনা মানুষের মনের বিশেষ দিককে উন্মোচিত করে। অবসাদের দুনিয়া থেকে মুক্তি ঘটিয়ে মনোলোককে ফিরিয়ে দেয় প্রাণবন্ত জীবন। তার সেতুবন্ধন কি করতে পারে ‘আর্ট থেরাপি’? শিল্পীর চোখে আশার আলো, ‘আর্ট কালচার’– এই বয়স্ক মানুষদের কাছে অপরিচিত কোনও শব্দ নয়। হয়তো তাঁরা চর্চা করেননি কিংবা করেন না। কিন্তু এটা ভালো মাধ্যম হতে পারে, তাঁদের তরতাজা রাখার জন্য। আমি এই শিল্পের সঙ্গে ৬৫ বছর ধরে যুক্ত। পনেরো-ষোলো বছর বয়স থেকে ছবি আঁকছি। সেই উদ্যমটা এই ৮০ বছর বয়সেও আমি টের পাই। ক্রিয়েটিভিটির জন্য আমি কাজ করি। তার যে আনন্দ, যে আত্মতৃপ্তি সেটা বলে বোঝানো যাবে না। এই সৃষ্টিশীল ভাবনা যদি অন্যদের মধ্যে সঞ্চার করতে পারি, তার আনন্দ আরও বেশি। শিল্পচর্চা যে কোনও মানুষের মনে আলাদা এক জগৎ তৈরি করে। মনটাকে প্রাণবন্ত করে। আমাদের সেই পরিস্থিতি তৈরি করা দরকার।’
শিল্পের ভাষ্য ছেড়ে আবার ‘স্বপ্ননীড়’-এর কথায় ফেরা যাক। ফেরা যাক, জ্যোৎস্না নন্দী, প্রতিমা চট্টোপাধ্যায়, কল্পনা কর্মকারদের মতো ব্রাত্যজনের কথায়। যারা সন্তান-পরিজন থেকে বহুদূরে, একাকিত্বের জীবনকে না-চেয়েও বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এবারের বিশ্ব আর্ট দিবস, তাদের কাছে একটু আলাদা, একটু জীবনমুখী। তাই তো বেলাশেষে কৃষ্ণা-মুকুলরা গলা মেলান, ‘কী গাব আমি, কী শোনাব, আজি আনন্দধামে…’ খুঁজে নেন নির্জীব যাপনের মধ্যে বেঁচে থাকার নতুন মানে।