গসিপ যখন লেখা হয়, সেটা ফ্যাক্টের চেয়েও বেশি জল্পনা-নির্ভর হয়। সত্যি যাচাই করা বা ক্ল্যারিফিকেশনের জন্য অপেক্ষা করে না কেউ। ফ্যাক্ট আর ফিকশনের মধ্যেকার ছায়াময় জগৎটা খোঁজে। সব গসিপ তাই ছায়ার মতোই আধো অন্ধকার নিয়ে আলগা হয়ে গায়ে লেগে থাকে যেন। সেটার সঙ্গে ছায়াযুদ্ধে না নেমে তাই নিজের আলো জোরালো করতে হয়, আর এই যুদ্ধ জেতা যায় একমাত্র নিজের কাজ দিয়ে । ওয়ান্স ইউ ফেস ইওর বিগেস্ট ফিয়ার, ইউ জাস্ট ডোন্ট কেয়ার ফর এনিথিং, এনিমোর। কিছুই ম্যাটার করে না। মা চলে যাওয়ার পর একটাই লোক ছিল যে ফ্লাইটে ওঠার আগে পরে খবর নিত, খেলাম কি না, বাড়ি পৌঁছলাম কি না জানতে চাইত নিয়ম করে , রোজ– সেই মানুষটাই যখন আর থাকে না, তখন কি কিছু এসে যায়? এই একাকিত্ব পাঁচশোটা প্রেম করেও ভরানো যাবে না। তো এটা যদি সহ্য করে বেঁচে থাকি, বাকিটাও পারব। আর যারা গসিপ লেখে বা বুঁকের আঁচল সরে গেল বলে ট্রোল করে– তাদের আমার জীবন নিয়ে, যন্ত্রণা নিয়ে, রোজগার নিয়ে, ভালো থাকা নিয়ে কোনও ধারণাই নেই। তাদের কিছু যায় আসে না। তাহলে আমার কেন যাবে আসবে!
মেরিলিন মনরো। এই নামটা শুনলে এখনও শিহরণ লাগে। শুধু কি বিশ্বসুন্দরী বলে? অমন শরীরী বাঁধন বলে? ওই অহংকারের জন্য? অমন বিপজ্জনক হওয়ার জন্য? না, মেরিলিন মনরো নামটা শুনলে এখনও মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার ইচ্ছে হয়। এই নামটা শুনলে মনে হয় ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যায় সব উড়ো কথা। না, মনরো নিজেও পুরোটা পারেননি। একটা জিতে যাওয়া লড়াইয়ের শেষ প্রান্তে এসে ময়দান ত্যাগ করেছেন। কিন্তু তবুও মনরো আমাদের শক্তি দেন, উঠে দাঁড়ানোর ভরসা দেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ‘গসিপ’ সেদিনও কম হয়নি, আজও বহাল তবিয়তে। আর তা থেকেই বুঝতে পারি যে, গসিপ, উড়ো কথা, পরনিন্দা– পর্দায় নায়িকাদের নিয়ে এসব চলতেই থাকবে। যেমন আমিও এখনও সংবাদ মাধ্যমের গসিপ বিভাগের কেন্দ্রে রয়েছি। তাতে যদিও আমার কিছু এসে যায় না। অন্যান্য অনেক নারীর পাশাপাশি এই এসে না-যাওয়ার কারণ হয়তো আমাদের আজও জোগান দিয়ে চলেছেন মনরো। মেরিলিন মনরো।
ফিল্ম জগতের সঙ্গে যুক্ত হলে ব্যক্তিগত জীবন কতরকমভাবে প্রভাবিত হতে পারে তার একটা ধারণা আমার অল্পবয়স থেকেই ছিল। কারণ আমার বাবা সন্তু মুখোপাধ্যায় এই জগতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন। আমাদের বাড়িতে সেই সময়ের অনেক অভিনেতাদের যাতায়াত ছিল। শমিত ভঞ্জ, তরুণ কুমার, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়– এঁদের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা ছিল। তখন অবশ্য ওঁরা কত বড় অভিনেতা বুঝতাম না, বাবার বন্ধু হিসেবেই জানতাম। আর তখন এর-ওর বাড়িতে এমনিই আড্ডা মারতে যাওয়ার চল ছিল। সন্ধেবেলা বাবা তাড়াতাড়ি ফিরলে সবাই মিলে পরিচিতদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া হত। শমিত ভঞ্জ তখন আমার কাছে কেবলই বুবুজ্যেঠু। সিনেমা জগতের সব কিছু আমি ভালো করে বুঝিও না তখন।
খুবই মধ্যবিত্ত পরিবার ছিল আমাদের। পরে মায়ের কাছে নানা গল্প শুনেছি, যেটাকে অন্যরা ‘গসিপ’ বলবে। তেমন একটা গল্প শেয়ার করতে চাই। এবং সেই গসিপ নিয়ে খুব মজা করা হয়েছিল। এই হিউমারটা আমাদের বাড়ির সকলের মধ্যেই রয়েছে। বাইরের বিষয় নিয়ে আমরা কোনও দিনই খুব একটা গায়ে মাখি না। আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করে এই ডোন্ট কেয়ার ব্যাপারটা আমার মধ্যে কী করে এসেছে! আসলে এটা আমি আমার বাবা-মায়ের থেকে পেয়েছি। গল্পটা বলি।
একটি নাম করা ফিল্ম ম্যাগাজিনে সেই সময় বাবা আর মহুয়া রায়চৌধুরীকে নিয়ে খুব বড় করে একটা গসিপ বেরিয়েছিল। বাবার সঙ্গে কাজের সূত্রেই মহুয়া রায়চৌধুরির সঙ্গে আমার বাবা-মায়ের ঘনিষ্ঠতা এমন ছিল, যে কাজের ফাঁকে, নানা সময়ে মহুয়া আমাদের বাড়িতেই থাকতেন। ওঁকে নিয়ে আমার যেটুকু স্মৃতি আছে, ওঁকে আমি আমাদের বাড়িতেই দেখেছি। এবং মৃত্যুর পর ওঁর নামটা আমাদের বাড়িতে আর উচ্চারিত হয়নি। টিভিতে খবর দেখালে মা এসে ঝাঁপিয়ে টিভি বন্ধ করে দিত। বড় হয়ে বুঝেছি, মা আসলে ওই শোকটা থেকে বাবাকে প্রোটেক্ট করতে চাইত। এতটাই গভীর সম্পর্ক ছিল মহুয়ার, আমার মা আর বাবার সঙ্গে। তো যেদিন মহুয়াকে নিয়ে খবরটা বেরোয়, ভোরবেলায় ম্যাগাজিনে খবরটা পড়ে দাদু চিন্তিত হয়ে হন্তদন্ত হয়ে আমাদের বাড়িতে আসেন। আর মজার ব্যাপার হল মহুয়াই দরজা খোলে। এবং মাকে আসতে বারণ করে দেন। মহুয়া খুবই ইয়ার্কি মারতে ভালোবাসতেন। দাদুকে মজা করে, ভীষণ সিরিয়াস মুখ করে বলে, ‘হ্যাঁ, আমি তো এখন এখানেই থাকি, কেন আপনার মেয়ের চেয়ে আমি কম কীসে…!’ পরে মা এসে দাদুকে বুঝিয়ে বলে। আর দাদুর তো হৃদপিণ্ড বেরিয়ে হাতে চলে আসার জোগাড়। আমি এই ধরনের গল্প শুনে বড় হয়েছি। দেখেছি, বাবাকে নিয়ে কোনও গসিপ আমার মাকে কেউ বলতে এলে মা গায়ে মাখত না। বাড়িতে বাবা-মায়ের অনেক ঝগড়া দেখেছি কিন্তু সেটা কখনই গসিপ-সংক্রান্ত বা কোনও তৃতীয় ব্যক্তি নিয়ে নয়। ওদের পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাসের জায়গাটা খুব জোরালো ছিল। মা যখন ক্লাস সেভেনে আর বাবা নাইনে– সেই সময় থেকে ওদের প্রেম। অপ্রস্তুত করবে বলে কেউ কখনও কিছু বলতে এলে মায়ের সবচেয়ে প্রিয় ডায়লগ ছিল, ‘ঠিক আছে বাইরে যা পারে করুক, বাড়িতে এলে ডেটল জলে চান করিয়ে দেব।’ তারপর তারা আর কথা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারত না।
এটা দেখে আমার বড় হওয়া, ফলে সিনেমা করতে গিয়ে ইন্ডাস্ট্রির নানা প্রভাব সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম, মানসিকভাবে তৈরি ছিলাম। অপ্রত্যাশিতভাবে কিছু ঘটেনি। তবে অফকোর্স যখন নিজের সঙ্গে ঘটে, মুখে যাই বলি, একটা প্রভাব তো পড়ে। বাড়িতে এসে কথা হলে বাবা বলত, “এই তো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে নেমেছ, এসব তো হবেই, আর এই জন্যই তো বলে যে, লোকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ‘নামে’। কারণ গসিপ হোক বা নেগেটিভ কথাই হোক– পরস্পরকে টেনে নামানোর একটা প্রচেষ্টা থাকে।” এই পেশায় এলে, একশোটা লোক থাকবে যে তোমাকে টেনে নামাতে চাইবে। তারপর আসলে সবটাই অভ্যেস হয়ে যায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অভ্যেসটা গাঢ় হতে থাকে। খুব ডিস্টার্বিং কিছু না হলে আমি অতটা নড়ে যাই না। প্রথমদিকে গসিপের চেয়ে যেটা আমার সম্পর্কে বেশি লেখা হত এবং আমাকে এফেক্টও করেছিল সেটা হল– আমি অভিনয় করতে পারি না, অভিনয় করতে এসে বাবার নাম ডোবাবে। আমি তো বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে অভিনয় আমি পারব না। এই ধরনের কথাবার্তা এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে, সিরিয়াসলি অভিনয়টা মন দিয়ে করতে হবে– এই তাগিদটাও তৈরি হয়। সব ক্রিটিসিজম হয়তো খারাপ না।
প্রি-কোভিড আমাকে নিয়ে একটা বাংলা কাগজে খবর বেরোয় যেটাতে লেখা হয় আমি নাকি আমার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন বদলে ফেলেছি, এবং আরব সাগরের তীরে এক মহিলার সঙ্গে থাকছি। অফকোর্স ছিলাম। কারণ ও আমার ছোটবেলার বন্ধু। ক্যুইয়ার রাইট নিয়ে যখন সারা বিশ্বজুড়ে নানাভাবে বিপ্লব চলছে, তখন প্রান্তিক যৌনতা নিয়ে এই ধরনের কুরুচিকর খবরের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় খুব রাগ হয়। এলজিবিটিকিউপ্লাস মানুষদের বেঁচে থাকার লড়াইটা তো খুব কঠিন, সেটা নিয়ে ছ্যাবলামো করে গসিপ কলামে খবর করা, বোধহয় যায় না। সব কিছু যে গসিপের আওতায় ফেলা যায় না সেটা বুঝতে হবে। আবার অন্যদিকে যেহেতু আমার ছবির বিষয় সবসময়ই খুব বোল্ড, চরিত্রগুলো সমাজের নিয়ম ভাঙে, ফলে বোল্ড সিন, ফিজিক্যাল ইন্টিমেসি– এমন দৃশ্য প্রায়শই থাকে। তাই আমাকে যেন প্রথম থেকেই একটা ‘সেক্স সিম্বল’ হিসেবে দেখতে শুরু করে মিডিয়া। কিন্তু ‘টেক ওয়ান’, ‘শাজাহান রিজেন্সি’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর পাশে ‘অনুব্রত ভালো আছো’, ‘গুলদস্তা’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ও করেছি। কিন্তু এগুলো নিয়ে তেমন কথা হয় না। এগুলো পাশে সরিয়ে রেখে, কেবল একজন নায়িকার শরীরের উপর ফোকাস করলে বিক্রি করতে সুবিধে হয় যে।
আমার বাবা-মা চলে যাওয়ার পর যেন এই ধরনের গসিপ, ট্রোল– কিছুই এখন আর সেভাবে গায়ে লাগে না। মা চলে যাওয়ার পর গায়ে না লাগার ব্যাপারটা ফিফটি পারসেন্ট হয়েছিল। আর বাবা চলে যাওয়ার পর পুরোপুরি উবে গেল। বাবা, মা না-থাকাটা সবচেয়ে বড় ভীতি, সবচেয়ে বড় ক্ষতি বা ফাঁক। এরপর কে কী বলল, লিখল, তাতে আমার আর কী ক্ষতি হবে, আর আমি কী-ই বা হারাব! ওয়ান্স ইউ ফেস ইওর বিগেস্ট ফিয়ার, ইউ জাস্ট ডোন্ট কেয়ার ফর এনিথিং, এনিমোর। কিছুই ম্যাটার করে না। মা চলে যাওয়ার পর একটাই লোক ছিল যে ফ্লাইটে ওঠার আগে পরে খবর নিত, খেলাম কি না, বাড়ি পৌঁছলাম কি না জানতে চাইত নিয়ম করে, রোজ– সেই মানুষটাই যখন আর থাকে না, তখন কি কিছু এসে যায়? এই একাকিত্ব পাঁচশোটা প্রেম করেও ভরানো যাবে না। তো এটা যদি সহ্য করে বেঁচে থাকি, বাকিটাও পারব। আর যারা গসিপ লেখে বা বুঁকের আঁচল সরে গেল বলে ট্রোল করে– তাদের আমার জীবন নিয়ে, যন্ত্রণা নিয়ে, রোজগার নিয়ে, ভালো থাকা নিয়ে কোনও ধারণাই নেই। তাদের কিছু যায় আসে না। তাহলে আমার কেন যাবে আসবে! আজ আমাকে নিয়ে লিখছে, কাল আবার অন্য কাউকে নিয়ে লিখবে, যদি সেখানে বেশি মশলা পেয়ে যায়।
একটা জিনিস আমি প্র্যাকটিস করি, যারা গসিপ লেখে বা ট্রোল করে তারা ভুল, এটা প্রমাণ করার দায় আমার নেই; বা ওদের ভুলটাকে ঠিক করার দায়ও আমার নেই। আমি কেবল ঝাঁপিয়ে পড়ে মন-প্রাণ দিয়ে আমার কাজ করে গিয়েছি। বাবা চলে যাওয়ার পর কোভিডের সময় আমি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছি। সবচেয়ে বেশি রিলিজ, আর গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো মুক্তি পায়। এবং তার পরপরই ভালো ভালো কাজ করেছি বাংলা এবং হিন্দিতে। আসলে কেবলমাত্র কাজটাই ম্যাটার করে। এই কাজের জন্যই তো আমাকে নিয়ে এত কথা । তবে সোশ্যাল মিডিয়া এসে যাওয়াতে মানুষের আর কিছু বলতেই আটকায় না। আমার মনে আছে একটা পার্টিতে তোলা আমার আর সৃজিতের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট হলে নোংরা কমেন্টে ভরে গিয়েছিল। আমি সৃজিতকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলতে পারো মানুষের এত রাগ কেন! একজন মহিলা যে সেলফ মেড, নিজের মতো জীবনযাপন করে, প্রাক্তনের সঙ্গে সু-সম্পর্ক, জোরালোভাবে নিজের মতামত জানাতে পারে– সেটাই কি রাগের কারণ!
সোশ্যাল স্ট্যান্ডার্ড দিয়ে বিচার করলে তো আমার কোনও চরিত্রই নেই। আর মেয়েদের চরিত্রই সবসময় খারাপ হয়। এবং নায়িকা হয়ে সেই মহিলা যদি নিজের প্রেম, সেক্সুয়াল ডিজায়ার এবং জীবনের নানান চয়েস নিয়ে লুকোছাপা না করে তাহলে তো কথাই নেই। কেবল আমার জীবনের পাঁচটা-ছ’টা প্রেমিকের নামের বাইরে কোনও নতুন নাম কেউ পায়নি বলে সেগুলো নিয়েই জলঘোলা করে চলেছে। নতুন নাম তো নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সেটা গসিপের বাজারে এখনও পৌঁছয়নি বলে পুরনো গসিপ ভাতে বাড়ছে। কিন্তু কোনওদিন আমার বাবা, মা বা মেয়েকে এইসব এফেক্ট করেনি। কারণ বাড়িতে আমার সব সম্পর্কের কথা সবাই জানত। বাইরের লোকের কাছে নতুন করে কিছু জানতে হয়নি। হোটেলে গিয়ে কারও সঙ্গে সময় কাটাতে গেলেও, বাড়ির কেউ না কেউ জানে আমি কোথায় গিয়েছি। আর আমরা ‘পাবলিক ফিগার’ বলে, আমাদের যদি কারোর সঙ্গে সময় কাটাতেই হয়, তাহলে নিশ্চয়ই বনবিতান বা পার্কে যাব না! বেড়াতে গেলেও কাছের লোকদের জানিয়ে গিয়েছি। ফলে এই সমস্যাটা আমার কোনওদিন ছিল না।
এইদিক থেকে আমার বাড়ি সবসময়ই খুব সাপোর্টিভ ছিল। হাত কেটে যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে পরিমাণ লেখালেখি হয়েছিল– সেই সময়ও আমার বাবা এবং মায়ের সাপোর্ট আমাকে খুব সাহায্য করেছিল। এই গোটা বিষয় নিয়ে আমাদের কথোপকথনটা অনেক পরে হয়েছিল। ওই ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে– কী করলি, কেন করলি, কী হয়েছে, কে দোষী, কে ঠিক– এই কাঁটাছেড়া করতে যায়নি। মা-বাবা তক্ষুনি সব পরিষ্কার করে জানতেও চায়নি। ওরা আমাকে শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে সেরে ওঠার সময় দিয়েছিল। জানত যে একদিন নিজেই সমস্তটা বলব। ওই স্পেসটা সব সময়ই আমি পেয়েছি। ওরা বুঝেছিল কোনও এক আবেগজনিত ঘূর্ণির মধ্যে ছিলাম, যার শেষটা ভালো হয়নি। সেই সময় ১০-২০ দিন আমাদের বাড়িতে টিভি চলেনি। আমার ফোন বন্ধ ছিল। মা বাড়ি থেকে বেরোয়নি, পাশে পাশে ছিল। সাইকিয়াট্রিক সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। সেটা আমার জীবনের সত্যি খুব অন্ধকার সময়। তখন বাইরের লোক কী বলল, কী লেখা হল কিছু এসে যায় না। কারণ কোন তলানি থেকে আমি নিজেকে টেনে তুলেছি– সেই লড়াই সম্পর্কে আর কেউ কিছু জানে না।
এবার সেই ঘটনার সময় আমি হোটেলে ছিলাম বলে, নানা কথা বলা হয়েছে। আসলে হোটেলে দেখা করা মানেই যেন শুধুই যৌনতার গন্ধ! দুটো মানুষের ভালোবাসা দেখতে চায় না কেউ। দেখেওনি! কেবল নোংরামোটা খুঁজে বেরিয়েছে গসিপ-মুখর সমাজ। আর তাই গসিপ যখন লেখা হয়, সেটা ‘ফ্যাক্ট’-এর চেয়েও বেশি জল্পনা-নির্ভর হয়। সত্যি যাচাই করা বা ক্ল্যারিফিকেশনের জন্য অপেক্ষা করে না কেউ। ফ্যাক্ট আর ফিকশনের মধ্যেকার ছায়াময় জগৎটা খোঁজে। সব গসিপ তাই ছায়ার মতোই আধো অন্ধকার নিয়ে আলগা হয়ে গায়ে লেগে থাকে যেন। সেটার সঙ্গে ছায়াযুদ্ধে না নেমে বরং নিজের আলো জোরালো করতে হয়, আর এই যুদ্ধ জেতা যায় একমাত্র নিজের কাজ দিয়ে । ঠিক সেই কারণেই আমি বোম্বে গিয়ে অডিশন দেওয়ার জন্য পড়ে থেকেছি দিনের পর দিন। অনেকে অবাক হয়েছে তাতে। স্বস্তিকা তো কলকাতায় সফল, আবার বোম্বে যাওয়ার কী দরকার!
আমার কেরিয়ারের অনেক কিছুই আমি জেদের বশে করেছি। আমি দেখতে চাই– কতদিন আমার কাজ বাদ দিয়ে, কেবল আমার জীবনের গসিপ নিয়ে লিখতে পারে মিডিয়া! আর কতদিন আমার কাজে পুরো ফোকাস না করে থাকবে এই গসিপ-প্রবণ মিডিয়া! নিজেকে অপরিহার্য অভিনেত্রী হিসেবে তৈরি করব, এই জেদটা আমার কাজ করেছিল। সবসময়ই কাজ করে। সেই জায়গাটা তৈরি করার জন্য আমি এখনও পরিশ্রম করে চলেছি। বাংলা, হিন্দি ছবির পাশাপাশি আমি আরও একটা মারাঠি ছবি করলাম এই কিছুদিন আগে। আমি এখনও কাজের জন্য অডিশন দিই। কখনও অডিশনে উতরে যাই, বেশিরভাগ সময় পারি না– কিন্তু আমি দমে যাই না কখনও।
ষাট বছর বয়সে পৌঁছেও তো কাজই করব, তখন দেখতে চাই কী নিয়ে কথা বলে মিডিয়া! আমার ধারণা নারী কাজের জায়গায় সফল, সেটা একটা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মেনে নিতে অসুবিধে হয়। তাই অভিনেত্রীদের কাজ বাদ দিয়ে অন্য ন্যারেটিভে শিফট করতে থাকে ক্রমাগত। না হলে ডিউ ক্রেডিট দিতে হবে যে! আরও একটা কথা বারবার মনে হয়– পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীকে যতদিন সেক্সুয়ালাইজ করতে পারবে ততদিন তার কাজের জন্য তাকে সম্মান দেবে না। যেই তোমার যৌবন শেষ হবে, তুমি ষাট বা সত্তরে পৌঁছে যাবে, তখন তুমি সমাজের চোখে ‘দেবী’ হয়ে যাবে, তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে। কারণ তখন আর তোমাকে সমাজ ‘থ্রেট’ হিসেবে দেখছে না। একজন সক্রিয়, কর্মোদ্দীপক নারীকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে, সহযোদ্ধা নয়! আর তাই এই কঠিন যুদ্ধে টিকে থাকতে স্পর্ধাই আমাদের হাতিয়ার, কাজই আমাদের জবাব!