আমাদের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, বর্ধমানে নিজের গ্রামের বাড়িতে দুর্গাপুজোয় এসেছিলেন। অর্থাৎ, যেখানে বিস্ফোরণ ঘটে, তার মাত্র কিছু কিলোমিটার দূরেই ছিলেন ভারতের প্রথম নাগরিক। ভাবলেই বুক ছ্যাঁৎ করে ওঠে! কোনও একটি রিপোর্টে এ-ও পড়েছিলাম, এই নাশকতার পিছনে আরও একটি লক্ষ্য ছিল যে, কোনও প্রভাবশালীকে সরিয়ে দেওয়া! কিন্তু কে সেই প্রভাবশালী? কেনই বা সরাতে চাইছে তাঁকে? জঙ্গিরা নাকি ‘বদলা’ নিতে চায়।
২ অক্টোবর, ২০১৪। বিস্ফোরণ হয়েছিল খাগড়াগড়ে। আজ থেকে প্রায় ৯ বছর আগে। দুর্গাষ্টমীর দিন। সারা পশ্চিমবঙ্গকে নাড়িয়ে দিয়েছিল এই ঘটনা, আমাকেও। কেন জানি না, ওই বিস্ফোরণের পরেকার তদন্ত, কী রহস্য লুকিয়ে এর নেপথ্যে, যা যা রিপোর্ট বেরত কাগজে– তা আমি খুঁটিয়ে পড়তাম। যেহেতু অষ্টমীর দিন, তাই খবরের কাগজে প্রথম দু’-তিনদিন এ ঘটনা আসতে পারেনি। কারণ পুজোর সময় ওই অষ্টমী, নবমী, দশমী– এই তিনদিন কাগজ প্রকাশিত হয় না। কিন্তু অনলাইনে যেটুকু খবর পাচ্ছিলাম, যেটুকু পাচ্ছিলাম নিউজ চ্যানেলে, তাতে উত্তেজনার পারদ বেড়ে চলেছিল।
বিস্ফোরণের নেপথ্যে অনেক ধরনের তত্ত্ব আসছিল। নানা বিশেষজ্ঞর নানা মত। এই বিস্ফোরণ কি নিছকই একটা বিস্ফোরণ– না কি এর নেপথ্যে লুকিয়ে রয়েছে কোনও রহস্য? কোথাও পড়েছিলাম, কলকাতার অনেকগুলো পুজো প্যান্ডেলও নাকি উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আবার কোথাও পড়েছিলাম, বাংলাদেশের জঙ্গিরা এখানে এসে বোমা বানানো ও নাশকতার জন্য এ ধরনের নানা জিনিস তৈরি করছে। যার একটা উদ্দেশ্য হতে পারে বর্ডার পার করে ওপারে পৌঁছে দেওয়া। কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়ে দেওয়াও। কিংবা অন্য কোথাও, অন্য কোনও অভিপ্রায়ে।
স্পষ্টতই বুঝতে পারছিলাম, যে, এই চক্রটা মাকড়সার জালের মতো বিস্তৃত, ছয়লাপ। আর এরই মধ্যে, আমাদের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, বর্ধমানে নিজের গ্রামের বাড়িতে দুর্গাপুজোয় এসেছিলেন। অর্থাৎ, যেখানে বিস্ফোরণ ঘটে, তার মাত্র কিছু কিলোমিটার দূরেই ছিলেন ভারতের প্রথম নাগরিক। ভাবলেই বুক ছ্যাঁৎ করে ওঠে! কোনও একটি রিপোর্টে এ-ও পড়েছিলাম, এই নাশকতার পিছনে আরও একটি লক্ষ্য ছিল যে, কোনও প্রভাবশালীকে সরিয়ে দেওয়া! কিন্তু কে সেই প্রভাবশালী? কেনই বা সরাতে চাইছে তাঁকে? জঙ্গিরা নাকি ‘বদলা’ নিতে চায়। কিন্তু কীসের বদলা, কার বদলা? এই সবকিছুই অসংখ্য রিপোর্টের মধ্য দিয়ে আসছিল।
সেই সময় আমার স্ত্রী জিনিয়া একটি ইংরেজি দৈনিকে সাংবাদিকতা করতেন। দীর্ঘ ১৪ বছর তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। যদিও তিনি এন্টারটেনমেন্টে ছিলেন। কিন্তু ওই কাগজেরই বীরভূমের দিকটা যিনি দেখাশোনা করতেন, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। এ বিষয়ে আমাকে সাহায্য করেছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক সুমিত সেন। এই ঘটনা নিয়ে সিনেমা বানানোর ব্যাপারে সুমিতদাকেই নিজের আগ্রহের কথা বলি। সুমিতদা বলেছিলেন, ‘এক্ষুনি করা উচিত!’
কিন্তু সমস্যা হল, এই ছবির যা পরিসর এবং গভীরতা– তা আমার একার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। আর বাজেটও বিপুল। ফলে তখন ব্যাপারটা আর এগোয় না। লকডাউনের সময় ফের ভাবতে শুরু করি, এই খাগড়াগড় নিয়ে যদি ছবি করা যায়। জিনিয়া– এ পরিকল্পনার ব্যাপারে জানত। নন্দিতাদি, আমি ও জিনিয়া একসঙ্গে বসি। নতুন করে গল্পটা গড়তে শুরু করে জিনিয়া। একটা টিম ফর্ম হয়। টিমের নতুন সদস্য রূপে আসেন শর্বরী ঘোষাল। চিত্রনাট্যের কাজও শুরু হয়। গল্পের নাম হয় ‘রক্তবীজ’। আর এই রক্তবীজ-এর ভেতরে সবই রয়েছে, যা সেই সময় তদন্তে বেরিয়েছিল।
সত্যি সবসময় সত্যি হয় না। কিছু কিছু সত্যি স্বপ্নের মতো। আবার কিছু কল্পনাও সত্যি মনে হয়। সিনেমা আর সত্যির ভেতরে দূরত্বটা এরকমই। তাই যে-সত্যি পড়েছিলাম, আর যে-সত্যি কল্পনা করেছিলাম– তার সবটাই রয়েছে রক্তবীজ-এ। রিল আর রিয়েল কতটা মিলেছে, কতটা মিলে গেছে, তা সবই দেখা যাবে এই ছবিতে।
সাম্প্রতিক সময়ে দত্তপুকুরেও বেশ কয়েকটা বিস্ফোরণ ঘটে গিয়েছে। বেশ কিছু লোকও মারা গিয়েছে। জানতে পারলাম, ছোট ছোট বাচ্চাও দত্তপুকুরের ওই বাজি কারখানায় কাজ করত। তখন কেন জানি না, রক্তবীজের কথাই মনে পড়ল। বিস্ফোরণে যারা মারা যায়, তাদের রক্তের ফোঁটা যখন পড়ে… জানি না।
জানি না খাগড়াগড় থেকেই এই রক্তবীজের শুরু কি না। তার কারণ, মাঝে মাঝেই এই বাজি কারখানার কথা শুনি। এই বোম ব্লাস্ট হয়। কিছু মানুষ মারা যায়। তারপর আবার চুপচাপ। তারপর আবার বিস্ফোরণ। তখন আবার মনের ভেতর প্রশ্ন তৈরি হয়, এগুলি কি শুধুই বাজি কারখানার বিক্ষিপ্ত ঘটনা? না কি এর ভেতরে লুকিয়ে রয়েছে আরও কোনও বৃহৎ উদ্দেশ্য? মুখোশের আড়ালে কি রক্তবীজরাই রয়েছে?