চাঁদের বিভিন্ন রূপ দেখি। বুঝতে পারি না, কখন কোনটা হবে। কিন্তু অনেক সময়ই রাত্তিরবেলা এই বুড়ো বয়সে ঘুম আসে না। ফলে জেগে জেগে একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ি। আবার মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎ। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, একটা অদ্ভুত একাকিত্বময় নখের মতো চাঁদ এসে হাজির। এমনকী, খুব সকালেও দেখেছি চাঁদ। চাঁদ আমার স্বপ্নের সঙ্গে জড়িয়ে। যদিও আমার নিজের গানে, স্বপ্ন বা প্রেমের অনুষঙ্গে চাঁদ আসেনি। এসেছে পলিটিক্যাল শোধবোধের জন্য– ‘মাঝরাত্তিরে চাঁদের কাস্তে, ধারালো হচ্ছে আস্তে আস্তে’। চাঁদ বলতে আমি আজও যে দিকে ঝুঁকে আছি, তা হল মার্কসবাদ। মার্কসবাদী কবিই তো লিখছিলেন, ‘এ যুগের চাঁদ হল কাস্তে’! আমাকে যদি কেউ বলেন কবীর, আপনি কী মনে করেন? আমি বলব, একশোবার! আমিও এমনটাই মনে করি।
প্রত্যেকের জীবনে বোধহয় চাঁদের একটা বিশেষ জায়গা থাকে। মা আমাকে বলেছিলেন, আমি জন্মেছিলাম ১৯৪৯ সালে, দোলপূর্ণিমার তিথিতে। ফলত, আমি চন্দ্রাহত হতে বাধ্য। এখন শহরে এত উজ্জ্বল আলো, কিন্তু আমার ছেলেবেলায়, কটকে টিমটিম করত নিষ্প্রভ আলো। সে আলোর গোবেচারা ভাব। এইরকম একটা সময়ে যখন চাঁদ উঠত আকাশে, আর পূর্ণিমা হত, চাঁদ পুরোপুরি হাজির– সেই স্বপ্নময় উজ্জ্বল নিজস্বতাটা বিশিষ্ট হয়ে উঠত। ফলে চাঁদ যখন উঠত, তখন হইহই করে উঠত। এত আলো, এত বাড়িঘরদোর তখনও হয়নি কলকাতায়।
শুনেছি, পূর্ণিমার চাঁদ উঠলে মানুষ নাকি অস্থির হয়ে পড়ে। ঠিক যেমন, সমুদ্রে টান পড়ে, মানুষের অন্তরেও টান পড়ে। কত গান আছে চাঁদ নিয়ে। শুধু রবীন্দ্রনাথ ধরলে হবে না, তার বাইরেও কত কত গান। আধুনিক গান। আমার ছোটবেলায় আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া আকাশবাণী কলকাতার রম্যগীতি, ভি. বালসারার সুর– কথা কার মনে নেই। আমার সাত-আট বছর বয়সে শোনা সেই গান। ‘চাঁদ তুমি ঘুমাতে পারো/ যে আছে চেয়ে মোর পানে/ জেনো দু’টি নয়ন তারও/ জোছনা বিলাতে জানে।’ কী চমৎকার যে লেগেছিল, এখনও লাগে।
প্রেমের অনুষঙ্গে, ভালোবাসার অনুষঙ্গে, পারস্পরিক আকর্ষণের অনুষঙ্গে চাঁদ– এটা তো চাঁদের একটা বৈশিষ্ট্য। ভাগ্যিস আমাদের একটা উপগ্রহ আছে। রম্যগীতির আরেকটা গান মনে পড়ছে, ‘একেলা তুমি তো চাঁদ/ চেয়ে আছো মোর পানে/ আমার দু’খানি নয়ন জোছনা বিলাতে জানে।’ প্রথম গানের যে উদাহরণ দিলাম, সেখানে যে চেয়ে আছে, তার চোখ জোছনা ছড়াতে জানে। আর এই গানে, বলা হচ্ছে স্পষ্টতই যে, ‘‘আমার দু’খানি নয়ন জোছনা বিলাতে জানে।’’ চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকা এক অচেনা কাউকে প্রথমবার দেখতে পাচ্ছে শ্রোতা। আর দ্বিতীয় গানে, সেই তাকিয়ে থাকা মানুষটি হয়ে পড়ছে শ্রোতা নিজেই।
তালাত মাহমুদের গাওয়া, ‘চাঁদের এত আলো/ তবু সে আমায় ডাকে/ উতলা মাধবী রাতে/ মাগিছে মোর আঁখি।’ যদিও গুরুচণ্ডালী, কিন্তু কীরকম আশ্চর্য চাঁদের গান! “নিশিরাত বাঁকাচাঁদ আকাশে/ চুপিচুপি বাঁশি বাজে বাতাসে বাতাসে/ ভাঙাঘরে দু’দিনের খেলাঘর/ হোক ভাঙা তবু এলো জোছনা।” আহা! আজ এই ৭৬ বছর বয়সেও গানটি মনে হয় প্রেমকে এনে দিতে পারে এই বুড়োর কাছেও। এই গানেরই একটা জায়গা, ‘জীবনের পথে পথে চলিতে/ যত আশা গিয়েছিল ফুরায়ে/ গজমতি হারে যেন ধুলায়ে/ ভিখারিনী পেল আজ কুড়ায়ে।/ এ জীবনে যতটুকু চেয়েছি/ মন বলে তার বেশি পেয়েছি… পেয়েছি।/ নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে।’ এই বাঁকা চাঁদ কি ইদের চাঁদ না কি অন্য কিছু? এই চিহ্নিতকরণের ব্যাপারে আমার আগ্রহ নেই।
চাঁদের বিভিন্ন রূপ দেখি। বুঝতে পারি না, কখন কোনটা হবে। কিন্তু অনেক সময়ই রাত্তিরবেলা এই বুড়ো বয়সে ঘুম আসে না। ফলে জেগে জেগে একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ি। আবার মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎ। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, একটা অদ্ভুত একাকিত্বময় নখের মতো চাঁদ এসে হাজির। এমনকী, খুব সকালেও দেখেছি চাঁদ।
চাঁদ আমার স্বপ্নের সঙ্গে জড়িয়ে। যদিও আমার নিজের গানে, স্বপ্ন বা প্রেমের অনুষঙ্গে চাঁদ আসেনি। এসেছে পলিটিক্যাল শোধবোধের জন্য– ‘মাঝরাত্তিরে চাঁদের কাস্তে, ধারালো হচ্ছে আস্তে আস্তে’। চাঁদ বলতে আমি আজও যে দিকে ঝুঁকে আছি, তা হল মার্কসবাদ। মার্কসবাদী কবিই তো লিখছিলেন, ‘এ যুগের চাঁদ হল কাস্তে’! আমাকে যদি কেউ বলেন কবীর, আপনি কী মনে করেন? আমি বলব, একশোবার! আমিও এমনটাই মনে করি।
এখন আমি যে-মেয়েটিকে ভালোবাসি, তিনি যদি এই মুহূর্তে, এই অন্ধকারে এসে হাজির হন– যদিও সেই সৌভাগ্য আমার নেই– কিন্তু যদি আসেন, তাহলে আমার হৃদয় সম্প্রদান হবে। তখন আমার এই অদ্ভুত চন্দ্রিমা তিনি দখল করবেন। তখন আমি এ যুগের চাঁদ হল কাস্তে– একথা আর বলব না। আমি এই দখলিত হওয়ার জন্যই বসে আছি। যুগ যুগ ধরে। রাজনীতির ঊর্ধ্বে, মতবাদের ঊর্ধ্বে, ধর্মের ঊর্ধ্বে, সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে! তার আকাশ হল ভালোবাসা। তার আকাশ হল আকর্ষণ। তার আকাশ এই শপথ– তোমাকে কোনও দিন ছেড়ে যাব না, তুমিও আমাকে কোনও দিন ছেড়ে যেও না, তোমাকে চাঁদের দোহাই!
দোহাই ওই নখের মতো চাঁদের কিংবা পূর্ণাবয়ব চাঁদের! আমার এই ছিয়াত্তুরে বা সাতাত্তুরে জীবনে, এখনও এখানেই অবস্থান করে চাঁদ।
…………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………….
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved