আমি এখনও হজম করে উঠতে পারছি না যে প্রীতীশদা নেই। যাই বলছি তাঁকে নিয়ে, যাই লিখছি তাঁকে নিয়ে মনে হচ্ছে যেন প্রীতীশদা শুনছেন, দেখছেন। একমাত্র প্রীতীশদাকে নিয়েই আমার শুধুই ভালো কথাই বলার আছে। আর কাউকে নিয়েই হয়তো আমি এত প্রবলভাবে অনুভব করি না, এত ভালো কথা বলি না। প্রীতীশদা যদি শোনে এমন কথা আমি ওঁকে নিয়ে বলছি, তাহলে নিঃসন্দেহে এখন বলে উঠতেন ‘শাট দ্য ফাক আপ সুধীর’!
প্লেনে একসঙ্গে যাচ্ছি আমরা। আমি তাঁকে খুব অল্পই চিনি, সেভাবে আলাপও নেই। কথায় কথায় বলেছিলাম আমার একটা সিনেমা বানানোর ইচ্ছে। সিনেমাটার গল্পটা শুনতে চাইলেন অল্প কথায়। আমি বললাম। প্রীতীশদা শুনে বললেন, কাল অফিসে এসে টাকা নিয়ে যেও। তৈরি হল ‘হাজারো খোঁয়াইশে অ্যায়সি’।
হি ওয়াজ আ ব্রিলিয়ান্ট ম্যান, গ্রেট ম্যান অ্যান্ড টাফ ম্যান।
প্রীতীশ নন্দীর মতো সৃজনশীল মানুষ যখন সিনেমার প্রযোজক হন, তখন আশ্চর্য কিছু ঘটনা ঘটে। উনি শুধুমাত্র সিনেমাটার জন্য ভাবতেন, অন্য বিষয়গুলো গৌণ হয়ে যেত। প্রীতীশ নন্দীর জন্যই ভারতবর্ষ কিছু অসামান্য সিনেমা পরিচালক পেয়েছে। কারণ তিনি সিনেমা বানানোর শুরু করে দিয়ে পরিচালককে একা ফেলে চলে যেতেন। এরপর যা করার পরিচালককেই করতে হবে। উনি পরিচালকের সিনেমা-ভাবনায় ঢুকে পড়াকে অনধিকার চর্চা বলে মনে করতেন। আসলে প্রীতীশ নন্দী একজনই হন, কারও সঙ্গে তাঁর তুলনাই চলে না, এত ইউনিক একটা চরিত্র। ওঁর নিজের ভাবনার জগৎটা এতটাই বড় ছিল যে অন্য কারও ভাবনা-জগতে অনুপ্রবেশ করতেন না। তাই জন্যই ওঁর প্রযোজনায় কাজ করা ছিল বহু পরিচালকের স্বপ্ন। উনি কোনও দিন সেটে আসতেন না। আসলেও গল্প করে চলে যেতেন। আর তাছাড়া ওঁর প্রচুর কাজ ছিল, সম্পাদনা, লেখালেখি। ফলে প্রীতীশ নন্দীর কখনও প্রয়োজন পড়েনি পরিচালকের পাশে পাশে চলার। বরং আমরাই ওঁর পাশে পাশে চলতাম। সেই জন্যই বম্বের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কেন্দ্রস্থলে তাঁর অফিসটাও ছিল না। ওঁর অফিস ছিল নারিমান পয়েন্টে। তিনি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে একটু এড়িয়ে চলতেন, পাশ কাটিয়ে চলে যেতেন। তিনি সিনেমাকে ভালোবেসে ভারতীয় সিনেমার একটা অন্য জগৎ তৈরি করেছিলেন। গোটা বম্বেতে ওঁর মতো কেউ ছিল না।
হি ওয়াজ আ কিউরিয়াস ম্যান। হি ওয়াজ আ এক্সাইটিং ম্যান।
বহু কিছু শিখেছি তাঁর কাছে আমি। শুধু সাহস করে তাঁর কাছে আসতে হবে, শুনতে হবে তাঁর সমালোচনা, স্পষ্ট ভাষায় সমালোচনা। বহুবার আমাকে সমালোচনা করেছিলেন। মতবিরোধ জানিয়েছেন, শিখিয়েছেন। এতই আলাদা ছিল তাঁর ভাবনাচিন্তা যে আমার বারবার তাঁর কাছে যাওয়ার, তাঁর সঙ্গে গল্প করার ইচ্ছে করত। তাই তো এত ছুটে ছুটে যেতাম। ওঁর সঙ্গে আলোচনা মানেই সেটা ট্রিগারিং একটা ব্যাপার। যে কোনও আলোচনাতেই উনি কোনও না কোনও এমন সূত্রে চলে যেতেন, যেখান থেকে আরেকটা রাস্তা খুলে যায় বা আমার নিজের চিন্তা একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
একমাত্র ওঁরই সেই দৃষ্টি ছিল সেসময়ে ‘হাজারো…’ প্রযোজনা করার। কারণ আমরা সবাই ছিলাম নতুন। চিত্রাঙ্গদা সিং, কে কে মেনন, সাইনি আহুজা, শান্তনু মৈত্র– সবাই। আমাদের মতো নতুনদের একসঙ্গে ছেড়ে দিলেন সিনেমা করার জন্য়। ভাবলেও অবাক লাগে! আসলে প্রীতীশও তো ওই সময়টার মানুষ ছিলেন। আজীবন সেই সময়টাকে ভেতরে নিয়ে বয়ে বেরিয়েছেন তিনি। তাঁর ভেতরে সেই পুরনো দিনগুলো মজুত ছিল, মজুত ছিল একটা আস্ত কলকাতা।
একজন কবিই হয়তো পারেন ‘হাজারো খোয়াইশে অ্যায়সি’ সিনেমা করার কথা। শুরুতে এই সিনেমাটার নাম ছিল ‘ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’, কিন্তু ওঁর নামটা পছন্দ হয়নি, বলেছিলেন ‘গিভ মি আনাদার নেম’। আমি বলি কিছুক্ষণ বাদে ফোন করে জানাচ্ছি অন্য নাম। এদিকে আমি জানতাম ‘হাজারো খোয়াইশে অ্যায়সি’ গজলটি আমি ব্যবহার করব। সেই নামটাই মাথায় এল, ফোন করে বললাম, উনি বললেন ‘গ্রেট’!
একটা গোটা প্রজন্ম শেষ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। একটা প্রজন্মের বোধ নিয়ে প্রীতীশ নন্দী চলে গেলেন। সেই সময়টার আর কোনও প্রতিনিধি নেই আমাদের মধ্যে। এখন তো আমরা একটা হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলানোর সময়ে এসে গেছি। প্রীতীশ ঠিক উল্টোদিকের মানুষ। আমরা ছিলাম মতবিরোধে ও যৌথতায়, একসঙ্গে। আমরা বিরুদ্ধতায় একসঙ্গে পাশাপাশি হেঁটেছি। সেসময়ে আমরা মতবিরোধে সম্মতিতে ছিলাম। পরস্পরের প্রতি সম্মানই ছিল এক্ষেত্রে ম্যাজিক ইনগ্রেডিয়েন্ট। প্রীতীশের প্রজন্মের থেকে আমি এগুলো শিখেছি, আমি শ্রদ্ধা করি সেই সময়টাকে, সেই সময়ের মানুষগুলোকে। প্রীতীশ আমার বড়ভাই। প্রাণের বড়ভাই।
মোটে দুটো সিনেমা করেছি আমি ওঁর সঙ্গে– ‘হাজারো খোঁয়াইশে অ্যায়সি’ ও ‘চামেলি’। তৃতীয় সিনেমা ভাবা ছিল, কিন্তু করা হয়নি। সেই আপশোস থেকে গেল, এই যা।
আমি এখনও হজম করে উঠতে পারছি না যে প্রীতীশদা নেই। যাই বলছি তাঁকে নিয়ে, যাই লিখছি তাঁকে নিয়ে মনে হচ্ছে যেন প্রীতীশদা শুনছেন, দেখছেন। একমাত্র প্রীতীশদাকে নিয়েই আমার শুধুই ভালো কথাই বলার আছে। আর কাউকে নিয়েই হয়তো আমি এত প্রবলভাবে অনুভব করি না, এত ভালো কথা বলি না। প্রীতীশদা যদি শোনে এমন কথা আমি ওঁকে নিয়ে বলছি, তাহলে নিঃসন্দেহে এখন বলে উঠতেন ‘শাট দ্য ফাক আপ সুধীর’! বলতেন, ‘ইউ হ্যাভ মেট মি ওনলি ৫০ টাইমস, অ্যান্ড ইউ আর টকিং অ্যাবাউট মি? হাউ ডু ইউ নো অ্যাবাউট মি? ডু ইউ নো ইওরসেলফ। ফিগার আউট ইওরসেলফ অ্যান্ড কাম টু মি।’
প্রীতীশদা একজন অসাধারণ মানুষ, যিনি সামনের মানুষটাকে তাঁর নিজের সম্পর্কে সচেতন করে তুলতেন। ওঁর কাছ থেকে ফেরা মানে নিজের সম্পর্কে একটু বেশি জানা, জীবন সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানা। প্রতিবার এটাই হত প্রীতীশদার কাছ থেকে ফেরার সময়।
অনুলিখন: বিদিশা চট্টোপাধ্যায়