Robbar

তরুণ ফোটোগ্রাফারদের বর্ণপরিচয় রঘু রাইয়ের ছবি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 18, 2024 7:31 pm
  • Updated:December 18, 2024 8:13 pm  

ভারতের নবীন ফটোগ্রাফারদের কাছে বর্ণপরিচয় হল রঘু রাইয়ের কাজ। প্রথম যে ছবিটি আমাকে চমকে দিয়েছিল সেটি হল ওঁর চার্চ গেট স্টেশনে তোলা ছবিটি। কয়েকজন স্থির হয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন, আর আশেপাশে দিয়ে কাতারে কাতারে ভিড় ছুটে চলেছে।। বম্বে শহরের গতি এর চেয়ে আর সুন্দরভাবে কীভাবে বোঝানো যেত! এই ছবিটি যখন আমি প্রথম দেখি, তখনও অবধি বোম্বে যাইনি। এর পরে যখন প্রথমবার সেখানে গেলাম এবং স্টেশনের ভিড় দেখে মনে হল অবিকল ওই ছবিটি বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি। রঘু রাইয়ের জন্মদিনে বিশেষ লেখা

মাধবেন্দু হেঁস

জীবনে শিল্পের কি সত্যিই কোনও ভূমিকা আছে? শিল্প না হলে জীবনের কোন জিনিসটা আটকে থাকবে শুনি? এক কথায় শিল্প অপ্রয়োজনীয়। অন্তত আমাদের মতো দেশে, যেখানে বেঁচে থাকাটাই একটা লড়াই, সেখানে সংখ্যাগুরু নিম্নবর্গীয় মানুষের কাছে শিল্প অত্যন্ত বিলাসিতা। এই যে বিভিন্ন লেখায় পড়ি, বিদ্বজ্জনের আলোচনায় শুনি, অমুক সময়ে অমুক সিনেমা, তমুক গান জনমানসে বিরাট সাড়া ফেলেছিল। এই জনগণ কারা? এত দিনের অভিজ্ঞতা দিয়ে যা বুঝেছি, কলকাতার হিসেবে দেখলে, এই জনগণ গুটিকয়েক আর্থিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে উচ্চশ্রেণির মানুষ।

No photo description available.
রঘু রাই

আমার মনে হয়, সবচেয়ে শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম হল সিনেমা, যার মধ্যে সাহিত্য, সংগীত, অভিনয়, তথা ভিজুয়াল আর্টের সুন্দর মিশেল তৈরি হওয়া সম্ভব। জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য এর জুড়ি মেলা ভার। তবে সিনেমার সমস্যা হচ্ছে, মানুষের অনেকটা সময় এবং অর্থ দাবি করে, যা সর্বস্তরে পৌঁছনোর একটি বড় অন্তরায়। এবং ইদানীংকালে সিনেমা যেভাবে শহরকেন্দ্রিক এবং খরচ সাপেক্ষ হয়ে উঠেছে, তাতে করে মানুষ সিনেমা না দেখে মোবাইলে রিল দেখতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করবে।

এই সমস্ত অন্তরায় সহজেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব যে শিল্পমাধ্যমটির– তা হল সংগীত। এক সময় রেডিও-তে, এখন মোবাইলে খুব সহজেই, প্রায় বিনামূল্যেই, অনেক সময় কাজ করতে করতেই গান শোনা যায়। কিন্তু বিতর্ক অন্য জায়গায়। মানুষ কী ধরনের গান শুনবে এবং সেই গান শিল্পমাধ্যমটির কতটা উন্নতি সাধন করবে? তথাকথিত উচ্চাঙ্গ সংগীত মোটামুটি ভাবে সংখ্যাগুরুর প্লে-লিস্টের বাইরে। সংখ্যাগুরুর কাছে তাই লঘুসংগীতই জনপ্রিয়।

ভিজুয়াল আর্টের কথা বললে প্রথমেই আসে পেন্টিং। সাধারণ মানুষের কাছে ভূগোল, জীবন বিজ্ঞান ছাড়া ছবি আঁকা জিনিসটা পাড়ার ‘বসে আঁকো প্রতিযোগিতা’ অবধি। খুব জোর ছুটির দিনে মিউজিয়াম গিয়ে সন্তানকে বোঝানো– এই দেখ আকবর দেওয়ান-ই-আমে বসে আছে, ওই দেখ বাউল একতারা বাজাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিংবা সোনাঝুরির হাট থেকে কেনা বাঁশের কুচি দিয়ে বানানো রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি। পেন্টিং সংগ্রহ কোনও দিনই সাধারণ মানুষের শখ-আহ্লাদের মধ্যে ছিল না।

এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। ফোটোগ্রাফি। একটা সময় অবধি শিল্পীরাই ফোটোগ্রাফিকে ‘শিল্প’ বলে মানতে চাননি! আর সাধারণ মানুষের কাছে আগে ফোটোগ্রাফি বলতে পাসপোর্ট সাইজ ছবি, বাড়ির অনুষ্ঠানের ছবি, দার্জিলিঙে চা-পাতার ঝুড়ি কাঁধে ছবি, তাজমহলের চূড়ায় আঙুল দেওয়া ছবি ইত্যাদি বোধগম্য হত। স্মার্টফোন আসার সুবাদে সাধারণ মানুষ ভালো-মন্দ যেভাবেই হোক, নিজেদের পছন্দের মুহূর্তগুলি ডকুমেন্ট করে রাখতে পারে। আর ফোটোগ্রাফার বলতে পাড়ার মাম্পি স্টুডিও কিংবা ক্যামেরা হাতে পরেশকাকু। এককথায় ক্যামেরাম্যান। এর বাইরে ফোটোগ্রাফার বলতে মানুষ বুঝত– যাঁরা প্রেসে কাজ করেন, যাঁদের নাম আলাদা করে মনে রাখার প্রয়োজন নেই সাধারণ মানুষের। এতক্ষণ অবধি যা বললাম, তা আশপাশে দেখা, শোনা অভিজ্ঞতা মাত্র।

ভারতের এই সংখ্যাগুরু জনগণ পাড়ার কেউ কেউ পরেশকাকুর বাইরে যদি আর একজন ফটোগ্রাফারের নাম মনে রাখতে পারেন, তিনি এক এবং অদ্বিতীয় রঘু রাই।

This may contain: a black and white photo of a man holding his hand to his face

ভারতের নবীন ফোটোগ্রাফারদের কাছে বর্ণপরিচয় হল রঘু রাইয়ের কাজ। প্রথম যে ছবিটি আমাকে চমকে দিয়েছিল সেটি হল ওঁর চার্চ গেট স্টেশনে তোলা ছবিটি। কয়েকজন স্থির হয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন, আর আশপাশে দিয়ে কাতারে কাতারে ভিড় ছুটে চলেছে।। বম্বে শহরের গতি এর চেয়ে আর সুন্দরভাবে কীভাবে বোঝানো যেত! এই ছবিটি যখন আমি প্রথম দেখি, তখনও অবধি বোম্বে যাইনি। এর পরে যখন প্রথমবার সেখানে গেলাম এবং স্টেশনের ভিড় দেখে মনে হল অবিকল ওই ছবিটি বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি। রাইমশাইয়ের ছবি একসময়ের দলিল। ভোপালের ছবি হোক বা মাদারের।

রঘু রাইয়ের তোলা ছবি, মুম্বইয়ের চার্চ গেট স্টেশন। ছবিসূত্র: ইন্টারনেট

রাইমশায়ের ছবির উৎকর্ষ বিচারে ধৃষ্টতা আমার নেই। রঘু রাইকে কাছ থেকে দেখার খুব একটা সুযোগ হয়নি। একবারই একটি সেমিনারে ওঁর বক্তব্য শুনেছিলাম। একটি কথা আজও মনে আছে। আমরা– উঠতি ফোটোগ্রাফাররা, কোন ছবিকে ভালো বা খারাপ কীভাবে বিচার করি? আমরা নিজেরা যখন কোনও ছবি তুলি, সেই ছবি ভালো হয়েছে তখনই মনে হয়, যখন তা আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখা কোনও ভালো ছবির কাছাকাছি হয়। আমরা হয়তো এমন কোনও ছবি তুললাম, যেরকম ছবি আমাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলছে না, তখন আমরা ধরে নিলাম ছবিটি খারাপ হয়েছে। সমকালীন ফোটোগ্রাফির ধারা সম্পর্কে রাইমশায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেও, এই বক্তব্যটির সঙ্গে একমত না হয়ে কোনওভাবেই পারি না।

Raghu Rai's 'A Thousand Lives': a journey of 40 years - The ...

রঘু রাইয়ের বক্তব্যের সূত্র ধরেই এবার অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। রঘু রাইয়ের ছবি আমাদের সম্পদ, ইতিহাসের দলিল। সমস্যা হল, ওঁকে আমরা মাথায় করে রাখলাম এবং অনেক ক্ষেত্রে মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে নিলাম। সেই সঙ্গে নিজেদের নিজস্বতাকে ভাসিয়ে দিলাম গঙ্গায়। যার ফলে সাধারণ মানুষ রঘুবীর সিং, পুষ্পমালা এন, পাবলো বারথোলোমিউ-র নামই জানতে পারল না। আর আমরা, নবীন ফোটোগ্রাফাররা, ওঁকে নকল করতে থাকলাম। নকলনবিশি এমন পর্যায়ে গেল যে, আমরা ভুলেই গেলাম, তিনি ছবিগুলো কোন সময় তুলেছেন।

রঘু রাই এবং স্টিভ ম্যাকারি– এই দু’জনের ছবি আমাদের কাছে ভারতের এমন এক চিত্র তুলে ধরে, যাতে করে মনে হয়, ভারতের রাস্তায় শুধুমাত্র হাতির পিঠে চড়া মহারাজ, সাপুড়ে আর সাধু-সন্ন্যাসী দেখা যায়। ফলস্বরূপ কলকাতা থেকে ফোটোগ্রাফাররা দলে দলে পুরুলিয়া দৌড়াচ্ছেন আদিবাসী শিশুর কোলে ছাগল নিয়ে ছবি তুলতে। সেই ছবি এমনভাবে তোলা হবে, যাতে দেখা না যায় যে, রাস্তাটা আর লাল মাটির নেই, কংক্রিটের হয়ে গিয়েছে। ইলেকট্রিক তারও দেখা যাবে না। মোবাইলের টাওয়ারও দেখা যাবে না। ক’দিন আগে এরকম ছবিও দেখলাম যে, একটি লোক হ্যারিকেন হাতে জলে নেমে মাছ ধরছে! ফটোগ্রাফারদের বোধহয় ধারণা নেই যে, এখন কেরোসিন কতটা দামি এবং কেরোসিন পাওয়াও কতটা কঠিন।

Raghu Rai: In His Own Words - India Art Fair
আত্মমগ্ন উস্তাদ আকবর আলি খাঁ, রঘু রাইয়ের ক্যামেরায়

দারিদ্র্রর প্রতি এই অসম্ভব আকর্ষণ বাস্তব থেকে ফোটোগ্রাফিকে কতটা দূরে সরিয়ে দিয়েছে তার হিসেব নেই। একজন ফোটোগ্রাফার তো দেখলাম মন্দারমণিতে বাঁশ পুঁতে শ্রীলঙ্কার অনুকরণে মাছ ধরা ফোটোগ্রাফির কর্মশালা আয়োজন করেছেন! এসবের ফলে শুধু মিথ্যা পরিবেশিত হচ্ছে– তাই নয়, সত্যি সমস্যাগুলিও এড়িয়ে যাচ্ছি আমরা।

২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে ফোটোগ্রাফি যেখানে আর শুধুমাত্র ক্যামেরাভিত্তিক নেই, যেখানে শব্দ, লেখা, আঁকা ইত্যাদি অনেক কিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, সেখানে ইতিহাসের অনুকরণ অত্যন্ত অনভিপ্রেত। ইতিহাস থেকে যেমন শিখতে হয়, তেমনই সামনের দিকে এগিয়ে চলাও সমান জরুরি।

…………………………………..

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

…………………………………..