
গবেষক সোমা মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘বন জঙ্গলের মধ্যেই রাসযাত্রা সূচনা। সেখানে পশু, পাখি, জলজ প্রাণী, ফল-সহ জীববৈচিত্রের এক অপরূপ নিদর্শন লক্ষ করা যায়। জীববৈচিত্রের সেই মহৎ ঐক্যই শোলার পুতুলের প্রতীকী হয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও রাধিকার পাশে বিরাজ করছে। মূলত এই সকল পুতুল বিগ্রহের সিংহাসনে সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তাই এগুলো শোলা দিয়ে তৈরি করা হয়।মাটি আদতে ভারী বস্তু। ঝুলিয়ে রাখাটা কঠিন হওয়ার কারণে মাটির পুতুল ব্যবহার করা হয় না।’
মহানগরের কংক্রিটের পাষাণ দেওয়ালে হেমন্তের বিকেলে কান পাতলে শোনা যায় শুক ও সারি পাখির সুমিষ্ট তরজা। ফাইভ-জি গতি নিয়ে এই শহর যখন ছুটে চলে সাফল্যকে খুঁজতে তখন তারই গর্ভে লালমোহন ও হীরামন পাখিরা আপন ছন্দে নেচে চলে। এখানে পানকৌড়ি ডাঙায় ওঠার জন্য ব্যস্ততা দেখায় না। কাকাতুয়া, পায়রা, ময়ূর আর বকেরা নিজেদের শারীরিক শৈল্পিক ছটায় মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে শিল্পরসিকদের। কার্তিক মাসের হেমন্তের হিমেল হাওয়ায় মাখা নরম রোদের তলায় উত্তর কলকাতার নতুন বাজারের ফুলপট্টিতে এভাবেই শ্রীকৃষ্ণের রাস উৎসব উপলক্ষে দশকের পর দশক ধরে শোলার পুতুল বানিয়ে চলেছেন শিল্পী গৌতম দাস। হুগলি জেলার পুরশুড়া ব্লকের সুন্দরুষ গ্রাম শোলার পুতুলের জন্য খ্যাত। সেই গ্রামেরই সুযোগ্য সন্তান শিল্পী গৌতম দাস (৫৭) রাসের সময় কলকাতার বুকে নিয়ে বসেন শোলার পুতুলের অনিন্দ্যসুন্দর সম্ভার। নতুন বাজারের মধ্যে তাঁর ছোট্ট ঘরের মধ্যেই চলতে থাকে একটার পর একটা শোলার পুতুল তৈরির কাজ। এই বিপুল কর্মযজ্ঞের জন্য তিনি তাঁর গ্রাম থেকে নিয়ে আসেন অন্যান্য শিল্পীকে। সমবেত শিল্পীদের হাতেই বিমূর্ত শৈলীতে গড়ে ওঠে শ্রীকৃষ্ণের রাধা, সখী, কদম গাছ, হনুমান, পায়রা, চিংড়ি, কাতলা মাছ, আনারস, আতা ফল, কলার কাঁদি, কাঁঠাল, কুমির, মকর, কল্পবৃক্ষ।

শিল্পী গৌতম দাসের কথায় তার দাদু কালিপদ দাস ও পিতা গৌড়মোহন দাস শোলার পুতুল তৈরি করতেন। বর্তমানে বংশপরম্পরা মেনে তিনি এবং তার দুই ভাই গিরীন্দ্র দাস ও গণেন্দ্রনাথ দাস এই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। শ্রীকৃষ্ণের রাসযাত্রার জন্য বিপুল পরিমাণে শোলার পুতুল তৈরি করা হয়। রাসযাত্রায় ১৪ রকমের পুতুল দিয়ে ইন্দ্রজাল তৈরি করতে হয়। বৈশাখ মাস থেকেই রাসের পুতুল তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়। কাত দিয়ে শোলার ছাল ছাড়াতে হয়। তারপর সেটিকে পুতুলের আকৃতিতে রূপদান করা হয়। পুতুলের গায়ে গুঁড়ো রং ব্যবহার করা হয়। পুতুল নির্মাণের ক্ষেত্রে যে আঠা ব্যবহার করা হয় তাতে ময়দা, তেঁতুল বীজের গুঁড়ো আর তুঁতে মেশানো হয়। কিছু পুতুল তৈরি করতে মাটির ছাঁচের ব্যবহার করা হয়। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে কাকাতুয়া পাখি পুতুল। প্রথমে মাটির ছাঁচের ওপর পাতলা খবরের কাগজের আস্তরণ দেওয়া হয়। তারপর শোলা পেঁচিয়ে লাগিয়ে রোদে শুকোতে দেওয়া হয়। কাকাতুয়ার বাস্তবধর্মী অভিব্যক্তিকে স্পষ্ট করার জন্য পাতুরি দিয়ে শোলার গায়ে খাঁজ তৈরি করা হয়। সত্যিকারের পাখির গায়ের লোম যেরকম দেখতে হয়– তেমনই ভাব কাকাতুয়ার পুতুলের গায়ে তৈরি করা হয়। তারপর রুটি করার বেলুন দিয়ে হালকা করে সমান করে মাটির ছাঁচটিকে সতর্কতার সঙ্গে বের করে নেওয়া হয়। এইভাবেই গড়ে ওঠে কাকাতুয়া। অন্যদিকে রাধা, সখী, আনারস, হনুমান, ময়ূর পুতুল তৈরিতে বিমূর্ত ভাব লক্ষ করা যায়। সেখানে বাস্তবধর্মী রূপ দেখা যায় না। কষ্টসাধ্য এই কাজে মজুরি সেভাবে নেই। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এই শিল্প শেখার প্রতি এক অনীহা কাজ করে। অন্যদিকে হুগলি জেলার গ্রামাঞ্চলগুলি ক্রমাগত শহুরে আদব-কায়দায় নিজেদেরকে রূপান্তর করার দৌড়ে এগিয়ে চলেছে। ফলে এই কুটির শিল্পের প্রতি জন্মেছে অনীহা। স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে শিল্পী জানিয়েছেন, ১৯৮৪-’৮৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন শহরে বাংলার কুটির শিল্প নিয়ে একটি প্রদর্শনী হয়েছিল। সেখানে তার স্বর্গত পিতা শিল্পী গৌড়মোহন দাসের তৈরি শোলার পুতুলের সম্ভার প্রদর্শিত হয়েছিল।

লোকসংস্কৃতি গবেষক তারাপদ সাঁতরা ‘পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পীসমাজ’ বইতে শোলার মতন অবহেলিত জলজ উদ্ভিদ দিয়ে এমন সুষমামণ্ডিত শিল্পবস্তু সৃষ্টির প্রতি বিস্ময় প্রকাশ করে লিখেছেন বঙ্গদেশের মালাকার সম্প্রদায়ের শিল্পীরা এই শোলাশিল্পের ধারক ও বাহক। পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া, হুগলি, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদিয়া, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম জেলার নানা স্থানে মালাকার সম্প্রদায়ের তৈরি শোলার বিভিন্ন দ্রব্যসম্ভার বেশ উচ্চ প্রশংসিত। দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গের মালাকার সম্প্রদায়ের শিল্পীরা এ রাজ্যের কোচবিহার এবং জলপাইগুড়িতে বসতি স্থাপন করেন। শোলার তৈরি শিল্পসম্ভার মূলত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। রাসযাত্রার সময় রাধা-কৃষ্ণ লীলা প্রদর্শন উপলক্ষে তৈরি করা হয় শোলার তৈরি গাছপালা, ফুল, লতাপাতা, কাকাতুয়া, কুমির, হাতি, ঘোড়ার প্রতিকৃতি। শোলার তৈরি কলাগাছ থেকে ঝুলতে থাকে কলার কাঁদি আর সেটি ভক্ষণ করে শোলার তৈরি হনুমান। ‘বাংলার পুতুল’ গ্রন্থে গবেষক দীপঙ্কর ঘোষ ও ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী দেখিয়েছেন যে, এই সকল রাস উৎসবের উপকরণ খেলনা পুতুল হিসেবেও পরিচিত। রাসের সময় পুতুল হিসেবে সখী, আনারস, কাঁঠাল, পায়রা, ময়ূর, চিংড়ি, কাতলা মাছ, হনুমান, মাছরাঙা ইত্যাদি প্রায় ১৫ ধরনের শিল্পবস্তু তৈরি হয়। পুতুল তৈরির সময় শোলার সঙ্গে মার্বেল কাগজও ব্যবহার করা হয়।

কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের রাসযাত্রায় এমন জীববৈচিত্রের প্রতীক হিসেবে এই সকল পুতুলকে কেন ব্যবহার করা হয়? এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লোকসংস্কৃতি গবেষক ড. সোমা মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘বন জঙ্গলের মধ্যেই রাসযাত্রা সূচনা। সেখানে পশু, পাখি, জলজ প্রাণী, ফল-সহ জীববৈচিত্রের এক অপরূপ নিদর্শন লক্ষ করা যায়। জীববৈচিত্রের সেই মহৎ ঐক্যই শোলার পুতুলের প্রতীকী হয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও রাধিকার পাশে বিরাজ করছে। মূলত এই সকল পুতুল বিগ্রহের সিংহাসনে সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তাই এগুলো শোলা দিয়ে তৈরি করা হয়।মাটি আদতে ভারী বস্তু। ঝুলিয়ে রাখাটা কঠিন হওয়ার কারণে মাটির পুতুল ব্যবহার করা হয় না।’

‘বাংলার দেবদেবী ও পূজাপার্বণ: পৌরাণিক উৎস ও লোকভাবনা’ গ্রন্থে গবেষক দেবাশিস ভৌমিক দেখিয়েছেন যে, বৈষ্ণব অলংকারিকদের মতে, ‘রাস’ শব্দটির জন্ম রস থেকে। মধুরভাব থেকে জেগে ওঠা শৃঙ্গাররস। সেখান থেকে রাস উৎসবের জন্ম। হেমন্তকালের পূর্ণ জ্যোৎস্নায় বৃন্দাবনে শ্রীরাধার সঙ্গে রাসলীলা মত্ত হয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। যদিও সমাজতাত্ত্বিকরা মনে করেন আদিম আরণ্যক যৌবন উৎসবের বিবর্তিত রূপ হল ‘রাস উৎসব’। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ভক্তি আন্দোলনের প্রভাবে বাংলা জুড়ে ভক্তিরসের জোয়ার সঞ্চারিত হতে থাকে। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছিল নবদ্বীপ ও শান্তিপুরে।

উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রকৃতির প্রতি আদিম গুহামানবের অকৃত্রিম সমীহ করার প্রবণতার উপাদান লক্ষ করা যায় রাস উৎসবে ব্যবহৃত এই সকল শোলার পুতুলে। আদিম পৃথিবী গুহার মধ্যেই মাতৃজঠরের উষ্ণতাকে খুঁজে পেয়ে তার মধ্যেই পশু-পাখিকে অঙ্কিত করে কুর্নিশ জানিয়েছিল। পশু, পাখি, জলজ প্রাণী, গাছ, ফুল, লতাপাতা সবই জীববৈচিত্রকে ঐক্যবদ্ধ করে পৃথিবীর নির্মাণ করেছে। আর মানুষ এসবের মধ্যে থেকেই বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে পেয়েছে। সেই প্রাণের রসদ জুগিয়ে চলা প্রকৃতির প্রতি পরম শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে চলেছে মানবজাতি। কল্পবৃক্ষের ফল-প্রসাদ হয়ে মানব হৃদয়ের স্পন্দনকে টিকিয়ে রেখেছে। আর রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম জীবনের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কথা বলে চলে। কৃষ্ণ নিজেও হয়ে ওঠে প্রকৃতির রক্ষক। তাই তো দেবরাজ ইন্দ্রের বিরুদ্ধে গিয়ে সে গোবর্ধন পর্বত পুজোর করার পক্ষে সওয়াল করে। প্রকৃতিপুজোর মাধ্যমে তার নরতাত্ত্বিক ধর্মের প্রতি আস্থা এখানে প্রস্ফুটিত হয়েছে। হস্তিনাপুরের রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মুহূর্তে ত্রাতা হিসেবে শ্রীকৃষ্ণকে আমরা পাই। নারীকেন্দ্রিক আদিম পৃথিবীর দর্শন শ্রীকৃষ্ণের এই পদক্ষেপে লক্ষ করা যায়। যশোদা শিশু কৃষ্ণের অন্ধকার মুখগহ্বরে পৃথিবীকে দেখেছিলেন। আসলে আদিম পৃথিবী অন্ধকারের কালো রঙের মধ্যেই পবিত্রতাকে খুঁজে পেয়েছিল। জীবনদায়ী মাতৃগর্ভের অন্ধকারে যে প্রাণের স্পন্দন থাকে, তারই প্রতীক হয়ে উঠেছিল কৃষ্ণ। যদিও পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দর্শন কৃষ্ণচেতনায় প্রবেশ করানোর চেষ্টা হয়েছে। তবুও তার প্রকৃতির প্রতি শাশ্বত চিরন্তন প্রেমরসে এখনও মোহিত প্রান্তিক মানুষ। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের যে ঢক্কানিনাদ জৈব তেল ও খনিজ দ্রব্য আরোহণ করা কোম্পানিগুলো দেখিয়ে চলেছে। তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থেকে প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা করার পাঠ দিয়ে চলেছে রাস উৎসবের শোলার পুতুল। আর সেই কারণে হালকা টিয়া, কাকাতুয়া, কদমগাছ, হনুমান পুতুলেরা হয়ে উঠেছে বিশ্বমাতৃকার একেকটি প্রতীক।
………………… পড়ুন শুভঙ্কর দাস-এর অন্যান্য লেখা …………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved