বিবর্তনের পথে পা বাড়িয়ে ছোটবেলার বোকাবাক্স ঘরে ঘরে এক থেকে একাধিক হয়েছে, যেমনভাবে একান্নবর্তী ভেঙে গড়ে উঠেছে সাড়ে বত্রিশভাজা সংসার। ফেলে আসা সেই সিআরটি কিংবা পোর্টেবল পেরিয়ে টিভি এখন দেওয়ালে শোভাবর্ধক সামগ্রী। সিরিয়াস কিংবা সিনেমা দেখার জন্য তার প্রয়োজন আর পড়ে না, ট্যাব কিংবা মোবাইলে স্বচ্ছন্দে সে-কাজ সেড়ে ফেলা এখন বাঁয়ে হাত কা খেল। তবে খোলস বদলানো গুটিপোকার মতোই টিভি আমাদের আটপৌঢ়ে জীবনকে শিখিয়ে গিয়েছে যৌথ জীবনের সার্থকতা।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
ঝিরঝির করছিল টেলিভিশন। এখন মনে সেই ঝিরঝিরটাই স্পষ্ট মনে আছে। ছাদের অ্যান্টিনা– কাকেদের ইজিচেয়ার, বসলেই শুরু হত ঝিরঝিরখানি। এ ছাড়াও মাঝে মাঝে, অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটনায় দুঃখিত। সেসব ঢের আগের, ভীষণ ভিশন ধারাবাহিক দিনকাল। একটা চৌকো খোপ থেকে কথা বলছে লোকে। সে কি পূর্বজন্মের ঘটনা? তা তো নয়। নয়ের দশক আজকের মতো শকপ্রুফ, বিস্ময়প্রুফ ছিল না।
আরেকটু পরের কথা বলি। বয়ঃসন্ধিকাল যাকে বলে, তার আদি পর্ব কাটিয়ে জীবনে তখন মধ্যযুগ। উচ্চ-মাধ্যমিকের উঁচু বেড়া টপকেছি। রেজাল্ট বেরতে ঢের দেরি। কলেজ কী বস্তু, সে ভাবনা কিলবিলিয়ে ওঠেনি। এমনই এক শুভক্ষণে বিশ্বজিৎ-এর পকেট থেকে ফস্ করে বের হল জিনিসটা। আরেক বন্ধু– অনির্বাণের বাড়িতে তখন আমাদের নিয়মিত আড্ডা। ভরদুপুরে তেমনই এক আড্ডায় আমাদের ‘সারপ্রাইজ’ দিল বিশু। না, দামি সিগারেট কিংবা চায়না লাইটার নয়। একখান মোবাইল। স্লিম গড়ন, ফ্লিপ চলন।
ইশকুলে ইংরেজির বিজয় স্যরকে এমন একটা পিস নিয়ে ঘুরতে দেখতাম বটে। নিয়ন আলোয় সে তার উপস্থিতি জানান দিত। স্যরের ব্যারিটোনে ‘হ্যালো’ আরও বুঝিয়ে দিত, ওসব চাঁদ, আমরা বামন– তাই ধরার কল্পনা করতে নেই। কিন্তু সেই বামনকুলে চাঁদ হয়ে আমাদের বিশু আজ মোবাইল এনেছে। আমরা, এই অভাগারা তার স্পর্শসুখ লাভ করছি, এ কম কী! ফলে আমাদের আসরে বিশুর দাম বাড়ল।
কিন্তু বিশুর মোবাইলটা মোটেই সেদিনের সারপ্রাইজ ছিল না!
সারপ্রাইজ ছিল মোবাইলের গোপন ফোল্ডারে লুকিয়ে থাকা ‘হিডেন জিম’, ছোট ছোট ভিডিও-ক্লিপের কোনটায় টেবিল জুড়ে ক্যাটরিনা কাইফের ‘বুম’ বিচরণ, আবার কোনটায় অনামা, অজানা রাশিয়ান আর দুষ্টু আমেরিকার দৌরাত্ম্য। আর পাশ থেকে বিশুর লাইভ কমেন্ট্রি– কীভাবে সেলিম আলি হয়ে উঠতে হয়েছে ওকে, এইসব দুষ্প্রাপ্য দুর্যোগময় ভিডিও সংগ্রহে!
…………………………………….
খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার– তার বাইরের যে জগৎ, তাকে এক ছাতার তলায় এনেছিল ওই সাদা-কালো বোকাবাক্স। ভরসন্ধেয় জননী কিংবা জন্মভূমি– টিভির পর্দায় শুরু হওয়া মাত্র পাড়ার মাসিমা-পিসিমা-কাকিমাদের চেনা ডাক ভেসে আসত উঠোন দিয়ে। গমগমে হয়ে উঠত বসার ঘর। পড়ার টেবিল থেকে মন তখন ভেসে যেত সেই পাঁচকথার মজলিশে। মনের মতোই পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকে পড়তে দেখেছি ছোটকাকার বন্ধুদের– ওই টিভি নামক বাক্সের অমোঘ আকর্ষণে।
…………………………………….
মৃগয়ায় আচমকা যেমন রাজকুমারীর দেখা পেয়ে মন-কেমন হয়ে ওঠে পড়শি যুবরাজের, তেমনই চন্দ্রাহত মন নিয়ে ফিরে এসেছিলাম বাড়ি। একাকী সম্ভোগের গোপন-সুখে বিশুকে সেদিন মনে হয়েছিল, বড়লোক! হাম গরিব আদমি আছি। আর সেই গরিবের আর কিছু না থাক, একটা টিভি আছে। যে টিভি শয়নে-স্বপনে-জাগরণে আমাদের মতো একান্নবর্তীর দুনিয়ায় পি.সি. সরকার!
ল্যাজ ও ডানা-গজানো আমাদের বাউন্ডুলে জীবনটাকে একসুতোয় বেঁধেছিল টিভি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার সামনে কেটে যেত অজস্র মুগ্ধ-বিকেল, ফাঁকি-মারা সন্ধে। শচীনের স্লিপে খোঁচার আফসোস আমাদের টেনে নিয়ে যেত ভেঙ্কটেশের লড়খড়ে ব্যাটিং পর্যন্ত। এক নাগাড়ে। গুরুজনের রক্তচক্ষু ভুলে মন মজে যেত ‘কহোনা পেয়ার হ্যায়’-এর দুলকি চালে। রক্তমাংসহীন অ্যান্টেনার তার জড়ানো ওই চৌখুপিই যেন আমাদের গেরস্তবাড়ির ধনঞ্জয়। বড়বাবুর ‘দিল কা ভ্রমর করে পুকার’ থেকে গিন্নিমার ‘পৌষ ফাগুনের পালা’– সবই তার নখদর্পণে।
…………………………………
আরও পড়ুন সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: দিবাস্বপ্ন সফল করুন ছোট্ট ভাতঘুমে
…………………………………
খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার– তার বাইরের যে জগৎ, তাকে এক ছাতার তলায় এনেছিল ওই সাদা-কালো বোকাবাক্স। ভরসন্ধেয় জননী কিংবা জন্মভূমি– টিভির পর্দায় শুরু হওয়া মাত্র পাড়ার মাসিমা-পিসিমা-কাকিমাদের চেনা ডাক ভেসে আসত উঠোন দিয়ে। গমগমে হয়ে উঠত বসার ঘর। পড়ার টেবিল থেকে মন তখন ভেসে যেত সেই পাঁচকথার মজলিশে। মনের মতোই পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকে পড়তে দেখেছি ছোটকাকার বন্ধুদের– ওই টিভি নামক বাক্সের অমোঘ আকর্ষণে। তাদের বিড়ির কটু গন্ধের সঙ্গে মিলেমিশে যেত সাদা-কালো পর্দায় ভেসে ওঠা বিশ্বকাপ ফুটবল। সাদা-কালোর দুনিয়া ছেড়ে টেলিভিশন ক্রমশ রঙিন হয়েছে। যেমন ভাবে রঙিন হয়েছে আমাদের দুনিয়া। ইংলিশ কেবল থেকে ভিক্টোরিয়া সিক্রেট, আমাদের ছোটবেলাকে বড়বেলায় হাতেখড়ি দেওয়ার পুরুতঠাকুর ওই পোর্টেবল-বক্সই।
বিবর্তনের পথে পা বাড়িয়ে ছোটবেলার বোকাবাক্স ঘরে ঘরে এক থেকে একাধিক হয়েছে, যেমনভাবে একান্নবর্তী ভেঙে গড়ে উঠেছে সাড়ে বত্রিশভাজা সংসার। ফেলে আসা সেই সিআরটি কিংবা পোর্টেবল পেরিয়ে টিভি এখন দেওয়ালে শোভাবর্ধক সামগ্রী। সিরিয়াস কিংবা সিনেমা দেখার জন্য তার প্রয়োজন আর পড়ে না, ট্যাব কিংবা মোবাইলে স্বচ্ছন্দে সে-কাজ সেড়ে ফেলা এখন বাঁয়ে হাত কা খেল। তবে খোলস বদলানো গুটিপোকার মতোই টিভি আমাদের আটপৌঢ়ে জীবনকে শিখিয়ে গিয়েছে যৌথ জীবনের সার্থকতা। যে জীবনকে আমরা ফেলে এসেছি সময়ের সরণিতে। মনে পড়লেও তাকে ফেরানোর চাবিকাঠি আমাদের হাতে নেই। ঘরের কোণে পড়ে থাকা ওই বোকাবাক্স যেন ‘গল্প হলেও সত্যি’র ধনঞ্জয়ের মতো। আজ তাকে আর দরকার পড়বে না।
.………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………..