সাদ্রী ভাষায় ‘করোয়া’ মানে কালো, আর ‘জানি’ অর্থে ‘বউ’। সাদ্রী ভাষায় এই নদীকে লোকেরা বলত ‘করোয়াজানি’ নদী। লোকমুখে তা হয় ‘কালজানি’ নদী। যার অর্থ কালো বউ। অর্থাৎ সমাজে কালো মেয়েকে কী চোখে দেখা হয়, তা উপকথার ভেতরেই লুকিয়ে আছে। নদী এই রকমই এক এনটিটি। সামাজিক জীবন নদীর সঙ্গে এমনভাবে মিশে যায় যে তাকে জীবনের থেকে পৃথক করা যায় না।
প্রচ্ছদ শিল্পী: রামকিঙ্কর বেইজ
নদী তার আপন খেয়ালে চলে। ভুল বললাম। আগে নদী তার আপন ইচ্ছাতেই নানাভাবে ঘুরে ঘুরে চলত। কিন্তু সেই সৌভাগ্য নদীর আর থাকল কোথায়! নদীর তীরে পাড়-বাঁধ দিয়ে , নদীর বুকে বাঁধ বানিয়ে নদীকে আজ নিজের মতো করে একটুও জিরোতে দেয় না মানুষ। একসময় ইঞ্জিনিয়ার ও সেচবিজ্ঞানী উইলিয়াম উইলকক্স বলেছিলেন নদীতীরের পাড়-বাঁধ ‘শয়তানের শৃঙ্খল’। পাড়-বাঁধ নদীকে মেরে ফেলে। আমাদের বাপ-ঠাকুরদাদারা একসময় বলতেন নদীতে নেমে স্নান করতে হয়। আগে নদীর প্লাবনভূমি ছিল উঁচুতে। আর নদী ছিল নিচুতে। এখন ঠিক উল্টোটা হয়েছে। নদীখাত এখন প্লাবনভূমি থেকে উঁচুতে। কাজেই বৃষ্টির জল নদীতে গড়িয়ে নামতে পারছে না। কেন?
প্লাবনভূমি মানে– বন্যার সময় নদী যখন কানায় কানায় ভরে ওঠে, তখন সে জলের সঙ্গে বয়ে আনা পলিকে বিছিয়ে দেয় নদীর দু’পাড়ে। নদীর বন্যার জল নদীর দু’পাড়ের যতটুকু অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সেটাই নদীর প্লাবনভূমি। পাড়-বাঁধ দিয়ে প্লাবনভূমিতে বন্যার জল আর ঢুকতে দিচ্ছি না আমরা। ফলে বন্যার সময় বয়ে আনা পলিগুলো জমা হচ্ছে নদীর বুকে। নদীখাত অগভীর হচ্ছে। বন্যার জল ধরার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে নদীর। নদীতে যত পলি জমছে নদীর খাত তত উঁচু হচ্ছে।
একসময় নদীকে নিয়ে মানুষ নানাভাবে নদীর নানা কথাকে উত্তর-প্রজন্মের জন্য এগিয়ে নিয়ে যেত। এই পরম্পরার ক্রমকে ধরে রাখা হত উপকথার মধ্য দিয়ে। রূপকথা ছেলে-ভোলানো গল্প হলেও উপকথা আসলে আমাদের গল্প ছিল। যার মধ্যে লুকিয়ে ছিল আমাদের যাপন। কীভাবে?
উত্তরবঙ্গের এক নদী হল কালজানি। এই নদীটা নিয়ে একখানা উপকথা পাওয়া যায়। সে বহুদিন আগের কথা। টুটু নামে এক পশুপালক ছিল। তার ছিল এক বৃদ্ধা মা। মা ভাত রান্না করে দিত, সেই ভাত খেয়ে টুটু কাঠ কাঠতে যেত জঙ্গলে। একদিন সে জঙ্গলে কাঠ কাটছে। হঠাৎ শুনতে পায় একটা কান্নার আওয়াজ। কোথা থেকে আওয়াজ আসছে, তা খুঁজতে গিয়ে সে দেখে এক গভীর জঙ্গলে একটা কালো মেয়ে খুব কাঁদছে। সেই কালো মেয়েটার কাঁদার কারণ জিজ্ঞাসা করলে মেয়েটা উত্তর দেয় না। আরও জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। তখন সেই কালো মেয়েকে টুটু বাড়ি নিয়ে আসে। একা একটা মেয়েকে ঘরে রাখতে চাইল না টুটুর মা। তাই আকাশ, বাতাস আর শালগাছকে সাক্ষী রেখে টুটু বিয়ে করে সেই কালো মেয়েকে। বিয়ের পরের দিন টুটু জঙ্গলে যায় কাঠ কাটতে। সেদিনই জঙ্গলে তাকে বাঘ কামড় দিয়ে তুলে নিয়ে যায়। সেকথা টিয়াপাখি এসে টুটুর বাড়িতে জানালে কালো বউকে টুটুর মা ঘর থেকে বের করে দেয়। কালো মেয়ে মনের দুঃখে নদী হয়ে বয়ে যায়।
এই উপকথাকে কেবলই এক উপকথা ভাবলে ভুল ভাবা হবে। ভুল হবে একে শুধুমাত্র একটা গল্প ভাবলে। এই উপকথাটিকে যদি ইন্টারপ্রেট করা যায় তাহলে তার ভেতর থেকে উঠে আসবে একটি অন্য ঘটনা। কীরকম? সাদ্রী ভাষায় ‘করোয়া’ মানে কালো, আর ‘জানি’ অর্থে ‘বউ’। সাদ্রী ভাষায় এই নদীকে লোকেরা বলত ‘করোয়াজানি’ নদী। লোকমুখে তা হয় ‘কালজানি’ নদী। যার অর্থ কালো বউ। অর্থাৎ সমাজে কালো মেয়েকে কী চোখে দেখা হয়, তা উপকথার ভেতরেই লুকিয়ে আছে। নদী এই রকমই এক এনটিটি। সামাজিক জীবন নদীর সঙ্গে এমনভাবে মিশে যায় যে, তাকে জীবনের থেকে পৃথক করা যায় না।
উত্তরবঙ্গের নদীদের নিয়ে কয়েকটা কথা বলা প্রয়োজন। উত্তরবঙ্গের নদীগুলোর খাত ক্রমশ পলি পড়ে উঁচু হওয়ার ফলে নদীখাত ও প্লাবলভূমিকে আলাদা করা যায় না। কাজেই বন্যার জল ঢুকলেই দু’কুল ছাপিয়ে বন্যা নিয়ে আসে। উত্তরবঙ্গের নদীগুলো থেকে বিপুল পরিমাণে বালি ও কাঁকড় তোলা হয়। ক্ষেত্রসমীক্ষাতে দেখা যাচ্ছে ১৮ থেকে ৩৯ বছরের তরুণেরা মূলত এই কাজের সঙ্গে বেশি যুক্ত। ৩৯ থেকে ৫৯ বছরের মানুষ যে এই কাজ করে না, তা নয়, তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম। নদীর বুক থেকে বালি ও কাঁকড় তোলার কাজটা বেশ খাটনির বলে মূলত তরুণরাই মালিকপক্ষের বেশি পছন্দের। উত্তরবঙ্গের নদীগুলোতে বালি তোলার কাজের চেহারাটা প্রায় সব জায়গায় একই। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত চলে বালি তোলার কাজ।
নদীর বয়ে চলার পথে তার জল বয়ে আনার ক্ষমতা, তার খাতের ঢাল– এই দুটো বিষয়ই মূলত নদীর গতিশীলতার ভারসাম্যকে ঠিক করে রাখে। পাহাড় থেকে হঠাৎ করে উত্তরবঙ্গের নদীগুলো সমতলে নামায়, নিজের শরীরের তাল বজায় রাখতে পারে না। চওড়া হয়ে যায় নদীর খাত। অনেকটা জাপানি হাতপাখার মতো। নদীবিজ্ঞানের ভাষা/ নদীর এই চেহারাটাকে বলে, ‘রিভার ফ্যান’। নদীখাতের গভীরতা বাড়ানো দরকার– তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। তাহলে নদী থেকে যারা বালি-পাথর তুলছে তাদের কাজ তো সমর্থনযোগ্য, কারণ তারা নদীখাতকে আরও গভীর করেছে। আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনে হলেও, নদীবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে তা খুবই উদ্বেগের। কারণ অবৈধভাবে নদীতে যারা খনন করে, তারা বালি-পাথর তুলতে তুলতে নদীর যত্রতত্র গভীর গর্ত বানিয়ে ফেলে। বর্ষার সময় নদীতে জল বাড়লে নদীখাতের গর্তগুলোতে জলের ক্ষয়কাজ বাড়তে থাকে। ফলে নদীর তলদেশের স্রোতের স্বাভাবিকতা বিঘ্নিত হতে থাকে। ভাঙনের প্রবণতা বাড়ে। ফলে নদীখাত তার গতিপথের পরিবর্তন করতে চায়।
নদীকে বাঁচিয়ে রাখার বিভিন্ন প্রাকৃতিক শর্ত– যেমন ভৌমজল-স্তরকে ঠিক রাখা, বাস্তুতান্ত্রিক প্রবাহকে ঠিক রাখা, রিফ ও রিল-কে বিঘ্নিত হতে না দেওয়া। এগুলো নষ্ট হলে নদীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, নদী আমাদের শত্রু নয়। বরং আবহমান কাল ধরে সভ্যতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পড়শির মতো। সেই পড়শির সঙ্গে মুখোমুখি আলাপের আরশিনগর, যাকে বলে জীবন, তার প্রবাহও বাঁধের যান্ত্রিক হিসেব মেনে চলে না কখনও।
…………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………