১৯৬৩-তে তাঁদের একটি অসমাপ্ত সিনেমার কয়েকটি দৃশ্য– সুইমিং পুলের কিছু ছবি (মনরোর ন্যুড) স্টুডিয়োর থেকেই ‘লাইফ’ পত্রিকায় প্রকাশিত করা হয়। ফোটোগ্রাফিক ইমেজ যে প্রক্রিয়ায় প্রচারিত হয় ও আর্কাইভে টিকে থাকে, তাতে দর্শক তাঁর ফিল্মের কথা ভুলে গেলেও, অথবা ফিল্মগুলি হারিয়ে গেলেও বা ম্লান হয়ে গেলেও, মনরোর সেই ‘ন্যুড’ ছবির প্রচার চিরবিদ্যমান। ফলে, ধীরে-ধীরে, মনরো তারকা থেকে হয়ে ওঠেন ‘জ্যোতিষ্ক’, অর্থাৎ ‘হেভেনলি বডি’। অথচ, মেরিলিন মনরো অভিনেতাও হতে চেয়েছিলেন। এ কোনও ন্যাকামি বা নাকি-কান্না নয়। বরং, একটি ছোট লড়াইয়ের গল্প। যেমন, তাঁর কর্মজীবনের শেষপর্যন্ত তিনি সঙ্গে রাখতেন তার বিশ্বস্ত ‘অ্যাক্টিং কোচ’, এবং পরিশেষে ‘পরফেকশনিস্ট’ হিসাবে বারংবার ‘রি-টেক’ আবেদন করায় বিস্তর বদনাম কুড়িয়ে ছিলেন। সম্ভবত তাঁর তৃতীয় স্বামী, প্রখ্যাত লেখক ও নাট্যকার আর্থার মিলার (‘ডেথ অফ আ সেলসম্যান’ খ্যাত) ছাড়া কেউই তাঁকে অভিনেতা হিসাবে বিশেষ গুরুত্ব দেননি।
প্রচ্ছদে ব্যবহৃত পপ-আর্ট: অ্যান্ডি ওয়ারহল
পয়লা জুন, ১৯২৬-এ, দুনিয়া কাঁপানো মার্কিন অভিনেতা ও মডেল মেরিলিন মনরোর জন্ম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে তাঁর প্রথম দিককার ছবি রিলিজ করে। অথচ এতগুলি দশক উত্তীর্ণ হওয়ার পরও তাঁর অমলিন ইমেজের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে দু’টি কথা: ‘সেক্স-সিম্বল’ ও ‘ডাম্ব ব্লন্ড’; অর্থাৎ, যৌনতার প্রতীক ও স্বর্ণালি চুলের বোকা মেয়ে। এছাড়াও নানা ঝুটা, জনপ্রিয় জীবনী, ছবি এবং সিরিজ তাঁর সম্পর্কে বিবিধ ধারণা নির্মাণ করতে সাহায্য করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় তাঁর প্রসিদ্ধ প্রেমিক এবং স্বামীর সুদীর্ঘ তালিকা।
তাঁর জন্মশতবার্ষিকীর প্রাক্কালে, মেরিলিন মনরো কী প্রকারে এই বিস্ময়কর ‘ডাম্ব ব্লন্ড’ হয়ে উঠলেন, সেই ‘মিথ-মেকিং’-এর প্রক্রিয়া কিছুটা কাটাছেঁড়া করে দেখতে চাই। যেমন: স্থানটি যখন হলিউড এবং সুন্দরী নায়িকা, এমনকী ব্লন্ড নায়িকার যেখানে কমতি নেই, সেখানে– হোয়াই মেরিলিন মনরো? অ্যান্ড, হাউ মেরিলিন মনরো? অর্থাৎ, কেন ও কীভাবে ‘নরমা জিন’ আইকনিক মেরিলিন মনরো হয়ে উঠলেন?
পিতামাতাহীন, নির্যাতিত ও পরবর্তীকালে বিবাহিত, উনিশ বছরের নরমা জিন ১৯৪৫-এ মডেলিং শুরু করেন এবং প্রথমেই তাঁর স্বাভাবিক গাঢ় বাদামি চুলের রং পাল্টে তিনি নিজেই নির্মাণ করেন তাঁর সেই অক্ষয় চকচকে স্বর্ণালি ‘প্ল্যাটিনাম ব্লন্ড’ ইমেজ। মেরিলিন মনরো ক্রিয়েটেড হার সেলফ-ইমেজ। কোনও এক নামহীনা দেবীর মতো তিনি নিজেই নিজের রূপ-দান করেন।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র-তাত্ত্বিক রিচার্ড ডায়ার (Richard Dyer) তার বই ‘স্টার্স’ (১৯৭৯)-এ চিত্র-তারকাদের সামাজিক ভূমিকার কথা লিখছেন। তাঁর মতে, ফিল্ম-স্টার কোনও কৃত্রিম বিষয় নয়। বরং তাঁরা ছায়ায়-মায়ায় এক বিচিত্র রহস্য, যার এক প্রগাঢ় সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে, দর্শক সেই ছবির মাঝে নিজেকে দেখতে চায়। এই স্টার-ইমেজ নির্মিত হয় নানা প্রকারে, যার মধ্যে গণমাধ্যম বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
আমি বলতে চাই, নরমা জিন-এর মেরিলিন মনরো হয়ে ওঠার পিছনে ছিল তাঁর ফোটোগ্রাফ, বিশেষ করে ‘প্লেবয়’ প্রত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ‘ন্যুড’ ছবি। ১৯৪৯-এ তোলা কিছু ছবি, ১৯৫৩ সালে, যে সময়ে মনরোর ‘বাজার’ (মানে মার্কেটেবিলিটি) বেশ সরগরম ও পরপর তাঁর ছবি হিট হচ্ছে, ঠিক তখনই ‘প্লেবয়’ পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়।
এছাড়াও রয়েছে, ১৯৬৩-তে তাঁদের একটি অসমাপ্ত সিনেমার কয়েকটি দৃশ্য– সুইমিং পুলের কিছু ছবি (মনরোর ন্যুড) স্টুডিয়োর থেকেই ‘লাইফ’ পত্রিকায় প্রকাশিত করা হয়। ফোটোগ্রাফিক ইমেজ যে প্রক্রিয়ায় প্রচারিত হয় ও আর্কাইভে টিকে থাকে, তাতে দর্শক তাঁর ফিল্মের কথা ভুলে গেলেও, অথবা ফিল্মগুলি হারিয়ে গেলেও বা ম্লান হয়ে গেলেও, মনরোর সেই ‘ন্যুড’ ছবির প্রচার চিরবিদ্যমান। এছাড়াও রয়েছে টেকনোলজির পরিবর্তন, কালার ছবি ও সিনেমাস্কোপের জনপ্রিয়তা। ফলে, ধীরে-ধীরে, মনরো তারকা থেকে হয়ে ওঠেন ‘জ্যোতিষ্ক’, অর্থাৎ ‘হেভেনলি বডি’।
অথচ, মেরিলিন মনরো অভিনেতাও হতে চেয়েছিলেন। এ কোনও ন্যাকামি বা নাকি-কান্না নয়। বরং, একটি ছোট লড়াইয়ের গল্প। যেমন, তাঁর কর্মজীবনের শেষপর্যন্ত তিনি সঙ্গে রাখতেন তার বিশ্বস্ত ‘অ্যাক্টিং কোচ’, এবং পরিশেষে ‘পরফেকশনিস্ট’ হিসাবে বারংবার ‘রি-টেক’ আবেদন করায় বিস্তর বদনাম কুড়িয়ে ছিলেন। সম্ভবত তাঁর তৃতীয় স্বামী, প্রখ্যাত লেখক ও নাট্যকার আর্থার মিলার (‘ডেথ অফ আ সেলসম্যান’ খ্যাত) ছাড়া কেউই তাঁকে অভিনেতা হিসাবে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। সেকথায় পরে আসছি।
১৯৫০ সালে খুবই কম পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তাঁর ‘কন্ট্রাক্ট’ হয় ‘টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স’-এর (20th Century Fox) সঙ্গে; ওদিকে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে, ফলে ১৯৫১ সালে তৎকালীন সংবাদমাধ্যম তাঁকে ‘মিস চিজকেক’ আখ্যা দেন। ‘চিজকেক’ মানে (অতি) ‘মিষ্টি’ মেয়ে নয়, এটি একটি মার্কিন স্ল্যাং; যার অর্থ– স্বল্প পোশাক পরা মহিলা, সস্তা ও লোভনীয় বস্তু।
১৯৫৩ সালে, ‘নায়েগ্রা’ ছবিতে ‘ফাম ফেটাল’ (Femme Fatale) মেরিলিন মনরোর এই রূপ দেখা যায়; এবং তিনি তাঁর কালজয়ী ভূমিকায় উত্তীর্ণ হন। এ ছবির ট্রেলারে প্রচার করা হয় দু’টি চমপ্রদ ইমেজ: নায়েগ্রা ফলস ও মনরো। ঝকঝকে টেকনিকালার Noir ছবি, মেরিলিন মনরোর পারফেক্ট মেকআপ– বাঁকা ভুরু, লাল লিপস্টিক, বিউটি স্পট, ঝিলমিলে সোনালি চুল ও দু’-চারটে খুনের সম্ভবনা।
এই ছবির সবচেয়ে জনপ্রিয় দৃশ্য ছিল মেরিলিন মনরোর ৩০ সেকেন্ডের ‘ব্যাক-টু-ক্যামেরা’ হাঁটা। এবং একই বছর মুক্তি পায় মনরোর বিখ্যাত দু’টি ছবি– ‘জেন্টেলমেন প্রেফার ব্লন্ডস’ ও ‘হাউ টু ম্যারি আ মিলিয়েনেয়ার’– যার মাধ্যমে মনরোর ‘ডাম্ব ব্লন্ড’ ইমেজ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা পায়। এবং পরবর্তী সময়ে (১৯৫৪) মুক্তি পায় ‘দেয়ার ইজ নো বিসনেস লাইক শো বিসনেস’।
মনরোর আগেও হলিউডে ‘ইট গার্ল’, ‘ব্যাড গার্ল’ ও ‘ব্লন্ড বমশেল’-এর, অর্থাৎ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের ছড়াছড়ি ছিল। কিন্তু, ১৯৫৩-এর ছবিগুলি মনরোকে এই ‘ডাম্ব ব্লন্ড’ চরিত্রে উপস্থিত করে। প্রথম দু’টি ছবির বিষয় হচ্ছে: কয়েকজন অসামান্য সুন্দরী ও বুদ্ধিমান মহিলা ‘বোকা’ সেজে ততোধিক বোকা পুরুষদের আকৃষ্ট করত ও তাদের বিয়ে করত। এতে জটিলতার তেমন কিছুই নেই, কারণ ছবির নামই তার প্রমাণ বহন করে। এবং কে না জানে যে– ‘‘ডায়মন্ডস আর আ গার্ল’স বেস্ট ফ্রেন্ড”। ফলে, ক্রমে, মেরিলিন মনরো ‘মেরিলিন মনরো’ হয়ে উঠলেন। এবং ১৯৫৮ সালে, মনরো পুনরায় ‘ডাম্ব ব্লন্ড’-এর ভূমিকায় অভিনয় করে ‘সাম লাইক ইট হট’ ছবির জন্যে গোল্ডেন গ্লোবেক্স পুরস্কার পান।
এইখানে তাত্ত্বিক বিষয়ে হল এই যে, মেরিলিন মনরোর ক্ষেত্রে এই ‘ডাম্ব ব্লন্ড’-এর ভূমিকা ছিল একটি অত্যন্ত উচ্চমানের পারফরম্যান্স। এবং সেই অভিনয়ের বা পারফম্যান্সের দীপ্তি এমনই উজ্জ্বল যে, দর্শকের চোখ ধাঁধিয়ে যায়, এবং সাধারণ মানুষ ব্যক্তি মনরোকে ‘ডাম্ব ব্লন্ড’ ব্যতীত অন্য কিছু কখনও ভাবতে পারে না। অবশ্য, কাজের বাইরে, পাবলিক শো-তে মনরো অনায়াসে ‘ডাম্ব’ ভাব করতেন, শিশুসুলভ স্বরে কথা বলতেন, দ্ব্যর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করতেন, এবং পরনে থাকত অসাধারণ সব– বিতর্কিত– পোশাক।
এ যেন নিজের জীবন জুড়ে এক অসামান্য অভিনয়। বস্তুত, তার অভিনয় ক্ষমতা এমনটাই ছিল যে: ফিল্মের স্ক্রিনিং-এ সম্পূর্ণ আবৃত থেকেও ‘ন্যুডিটি’ পরফর্ম করার ক্ষমতা রাখতেন। ‘নায়াগ্রা’ ছবির কথা মনে করুন, এমনই সেই লং-শটে, ব্যাক-টু-ক্যামেরায় হাঁটায় যে তুলকালাম পড়ে গেল, মহিলারাও প্রতিবাদ করলেন, এবং আপামর জনতা ছবিটিকে ‘ভালগার’ আখ্যা দিলেন।
এমন অবশ্য আরও ঘটেছে। যেমন ১৯৫৬ সালের রজার ভাদিম-এর বিখ্যাত ছবি ‘অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড ওম্যান’ দেখে ফ্রেঞ্চ সেন্সর বোর্ড বিধান দেয়– যে দৃশ্যে ব্রিজিদ বার্দো উলঙ্গ হয়ে এক কিশোরের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন– সেই দৃশ্য বাদ দিতেই হবে। অথচ, এই দৃশ্যে তাঁর পরনে ছিল টাইট, লম্বা, কালো প্যান্ট। সিনেমার ক্ষেত্রে এমনটা কখনও-সখনও ঘটে যায়– যাকে বলে সিনেম্যাটিক ম্যাজিক। চাক স্টিফেন্স (২০০০) লিখছেন: “More a force against reason, or a blinding special effect– not unlike Einstein’s equations, or Elvis’s pelvis– Bardot warped cultural memory as easily as she bent a projector-beam of light.” অর্থাৎ, যুক্তি-তক্কের বাইরে চোখ ধাঁধানো এক দ্যুতি।
তবে, মনরোর আরও এক ক্ষমতা ছিল– চার্লি চ্যাপলিনের মতো কমেডি ও ট্রাজেডি একইসঙ্গে পরফর্ম করা। যেমন, আইকনিক ফেমিনিস্ট ফিল্ম স্কলার লরা মালভি তাঁর প্রবন্ধে (‘থটস অন মেরিলিন মনরো: এমব্লেম এন্ড অ্যালিগরি’, ২০১৭) মনরো সম্পর্কে কিছুটা আলাদা তর্ক করছেন। তিনি লিখছেন:
“Charlie Chaplin and Marilyn Monroe are the only Hollywood stars whose characteristics can be figured with a few strokes of a pencil in an immediately recognizable caricature. While Chaplin is more usually drawn in full body (with his hat and cane), Monroe can be evoked simply by her facial features. … Both stars invested deeply in the construction of their images, which were minutely thought through and consciously developed around a surface masquerade: Chaplin’s mask is descended from the clown’s; Marilyn’s is an exaggerated mask of cosmetic femininity.”
এর তর্জমা করলে দাঁড়ায়: চ্যাপলিন ও মনরোর রূপ সহজেই চেনা যায়। একজনের টুপি, লাঠি, খাটো কোট, ঢোলা পাতলুন ও বেঢপ জুতো; অন্যজনের সোনালি চুল, বাঁকা ভুরু, লাল ঠোঁট ও বিউটি-স্পট– বাকি চেহারাটা না দেখালেও চেনা যায়। এবং, এই ইমেজ কিন্তু খুব সচেতনভাবে নির্মাণ করা হয়। যেন মুখের ওপর মুখোশ, এবং মেরিলিনের ক্ষেত্রে তার মেক-আপই তার মুখোশ। মালভি তাঁর লেখায় চ্যাপলিন ও মনরোর এক প্যারালাল জীবনী নির্মাণ করছেন, বা তাঁদের জীবনের তুলনামূলক আলোচনা করছেন। কিন্তু কেন? ও কীভাবে?
একদিকে যেমন দু’জনেরই ছেলেবেলা কেটেছে অসহ্য দারিদ্রে এবং দু’জনেই হয়ে ওঠেন অসম্ভব জনপ্রিয় স্টার; অপরদিকে, চ্যাপলিন তাঁর টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গিয়ে ইউনাইটেড আর্টিস্টস (স্টুডিও) গঠন করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে ক্ষমতাশালী ফিল্মমেকার হয়ে ওঠেন; বিপরীতভাবে, মনরো কিন্তু একইরকম স্ট্রাগল করে অর্জন করেছিলেন বেশ খানিকটা বদনাম। তাঁর সবচেয়ে বড় বদনাম ছিল: তিনি বড় খুঁতখুঁতে, ‘রি-টেক পে রি-টেক’ দাবি করেন। এতে স্টুডিওর অনেকটা সময় নষ্ট হত, লোকসান হত, এদিকে মনরো ছিলেন স্টুডিও-র ‘মানি মেকিং ডল’।
মনরোর সময়টা ছিল হলিউড সিস্টেমের পতনের শুরু। সিস্টেম মানে এই সময়ে কাস্ট ও ক্রু (সাত বছরের) কন্ট্রাক্টে স্টুডিও তে ‘চাকরি’ করতেন। এদিকে, ১৯৫৪-এ, টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স-এর সঙ্গে লড়াই করে, মনরো ঘটালেন এক অসম্ভব ঘটনা। কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে শুরু করলেন মেরিলিন মনরো প্রোডাকসনস– এম. এম. পি। মালভি এই প্রচেষ্টাকে ‘প্রতীকি’ বলছেন, কারণ বহু দশকের অত্যাচার ও স্বৈরাচারী সিস্টেমের ওপর এ যেন এক বজ্রাঘাত।
অবশেষে, এই ঘাত-প্রতিঘাতের পর মনরোর কন্ট্রাক্ট বদলায়। তিনি ছবির বিষয়, তার চরিত্র, ও পরিচালক মনোনীত করার অধিকার অর্জন করেন। মালভি লিখছেন, মনরোর জীবনই যেন হলিউড স্টুডিও সিস্টেমের ‘রূপক’: একদিকে স্টুডিওগুলিই উজ্জ্বল তারকা ও তার বিস্ময়কর ইমেজ প্রচার করে, অপর দিকে, তারকার এই উত্থানই সিস্টেমের গোড়ায় আঘাত করে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যাকে বলে।
মালভির ভাষায়: “the characteristic ‘Marilyn’ look and there is no doubt that she realized that she had to construct, even exploit, herself for the ‘male gaze’ to establish her Hollywood career. … However, if it was the male gaze that had enabled Monroe’s move into pictures and made her into a superstar, she had other ideas for her future with Marilyn Monroe Productions.”
অর্থাৎ, মনরো নিজেই নিজের ইমেজ নির্মাণ করেছিলেন, এবং হাবেভাবে, অভিনয়ে, বলেছেন: ‘পয়সা ফেকো, তামাশা দেখো’। যে সময়ে মনরো স্টার হয়ে উঠছেন, সেই যুদ্ধপরবর্তী সময়ে (কোল্ড ওয়ার পিরিয়ড) একদিকে ছায়ার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি, ওপর দিকে, যেন এই স্মৃতি ভুলে থাকার তাগিদেই মানুষ ছুটছে সুখের খোঁজে।
মার্কিনি বিজ্ঞাপনে ‘হ্যাপি ফ্যামিলি’র যে ছবি আমার দেখি (রান্নাঘর, ফ্রিজ, অঢেল খাবার, লাল টুকটুকে বউ, সন্তান, কুকুর) মানুষ যেন বাজারে সেই সুখ কিনতে ছুটে চলেছে। এবং মেরিলিন মনরোর ঝকঝক, চকচকে ইমেজ তারই ফেটিসাইজড (fetishized) রূপ। তাহলে, প্রশ্ন হল: মনরো নিজের জন্যে কী ‘ফিউচার’ বা ভবিষ্যৎ কল্পনা করেছিলেন?
পরিশেষে মনরো-মিলার-জন হিউস্টন-এর ছবি ‘দ্য মিসফিটস’ (১৯৬১)-এর কথা বলি। যদিও মনরোর অনেক ক’টা ছবি, যেমন, ‘দ্য সেভেন ইয়ার ইচ’ (১৯৫৫), ‘বাস স্টপ’ (১৯৫৬), ‘দ্য প্রিন্স অ্যান্ড দ্য শো গার্ল’ (১৯৫৭) উল্লেখযোগ্য। ‘দ্য মিসফিটস’-এ ( ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট) ছবির ট্রেইলার-এ পর-পর দেখা যায় স্টিলস বা স্থিরচিত্র। প্রথমেই দেখানো হয় লেখক আর্থার মিলার ছবি, তারপর পরিচালক জন হিউস্টন ও ক্লার্ক গেবেল। এরপর ভেসে ওঠে ছবির কিছু দৃশ্য, এবং মেরিলিন মনরোর অন্য এক চেহারা। তার আইকনিক মেক-আপবিহীন এক নতুন অথচ চিরপরিচিত মুখ ও শরীর।
এই ছবির এক দৃশ্যে, আয়নায় প্রতিবিম্বিত হয়ে সেই চেনা মেরিলিন মনরো মুখ, কিংবা মুখোশ। অথচ, এই একই দৃশ্যে যখন চরিত্রটি ক্যামেরার দিকে ঘোরে, এবং আলোর পরিবর্তন ঘটে, তখন স্পষ্ট দেখা যায় ক্লান্ত এক চেহারা, চোখের তলা ফোলা, মুখে ঈষৎ রিঙ্কেলস। এই ছবিতে মনরো যেন বলছেন: ‘আমি নিজেই নিজের ইমেজ গড়ি, আমি নিজেই তার বিনির্মাণ করি’।
শিল্পী অ্যান্ডি ওয়ারহল-এর বিখ্যাত মনরো ‘পপ-আর্ট’ (১৯৬৭) যদি তার ইমেজের প্রতি কমেন্ট হয়, তাহলে (মালভির মতে) মনরো নিজেই নিজের ইমেজের এক সচেতন তত্ত্ব খাড়া করছেন। যেন তিনি বারবার তার ভঙ্গিমায় ও অভিনয়ের সাহায্যে বলছেন: ‘এই আমি নরমা জিন, এই আমার মুখোশ, এই আমি মেরিলিন মনরো হয়ে উঠলাম…’।
এমনকী, মনরোর মাত্র ৩৬ বছর বয়েসে মৃত্যু নিয়েও মিথ রয়েছে। যেমন, শোনা যায়: একদিন আয়নায় নিজের বলিরেখা দেখে নারভাস হয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। বলা চলে, এই মিথটিও তাঁরই তৈরি; যেন সোজাসুজি ভাবে ‘দ্য মিসফিটস’-এর সিন তাঁর জীবনের মাধ্যমে দর্শকের মননে প্রবেশ করেছে। নরমা যেন সত্যিই একটি জিন বা অশরীরী আত্মা, জীবনে-মরণে দক্ষ ফিল্মমেকারের মতো নিজের ছবি নিজেই গড়েছেন, ভেঙেছেন।