উৎপল দত্ত যেটা করতেন, সেটা আশ্চর্যের! যে পাতায় নাটকটা লিখেছেন, তারই বাঁদিকের পাতায় গোটা নাটকের ব্লকিং একদম তৈরি করে ফেলতেন। তারপর একটা টেবিল পেতে, সেই টেবিলে দাবার ঘুঁটি পেতে বসতেন। সেই ঘুঁটিগুলোকে সাজাতেন নাটক অনুযায়ী। সেই অনুযায়ী চেয়ার-টেবিল, রস্ট্রাম দেখিয়ে দিতেন। এক-একটা চরিত্র দাবার এক-একটা ঘুঁটি– কেউ সাদা বোড়ে, কেউ কালো বোড়ে, কেউ রাজা, কেউ রানি, কেউ নৌকা। এবার চরিত্রগুলোকে বলতেন যে, তুমি এখান থেকে এখানে যাচ্ছ। ফলে সঙ্গে সঙ্গে অভিনেতারা মিলিয়ে নিত যে, আমরা জুনিয়ররা যেগুলো লিখে এনেছি, তা কতগুলো ঠিক বা কতগুলো ভুল।
উৎপল দত্ত নিজেই বলেছেন, আমি একজন প্রোপাগান্ডিস্ট। আমার মতে, প্রোপাগান্ডা করে না, এমন কোনও শিল্প নেই। হতে পারে না। কোনও না কোনও মতামতের প্রোপাগান্ডা তা করেই থাকে। হয়তো প্রেমের একটা নাটক বা প্রেমের কবিতা, কিন্তু সেটা কোন সমাজব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে করা হচ্ছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। তার ওপর নির্ভর করে, প্রেমকে কীভাবে দেখা হয়, কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। ধরা যাক, বর্তমান সমাজব্যবস্থার যে অসাম্য, তার পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে দুটো ছেলে-মেয়ে প্রেম করার চেষ্টা করছে। যেমন রোমিও-জুলিয়েট একটি অসম্ভব রাজনৈতিক নাটক। যাঁরা বলেন, শেক্সপিয়র অরাজনৈতিক, রবীন্দ্রনাথ অরাজনৈতিক বা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য-কীর্তিগুলো অরাজনৈতিক– তাঁরা নেহাতই অন্য রাজনীতিটা করতে চান বলেই এমন কথা বলে থাকেন। অন্য রাজনীতি, অর্থাৎ তথাকথিত শাসকের পক্ষের রাজনীতি।
উৎপল দত্তের মানুষকে চিনতে গেলে বা বুঝতে গেলে আমার মনে হয় চারটে মৌলিক অবদানকে মাথায় রাখতে হবে। একটি হল মার্কসবাদ, তার পর শেক্সপিয়র, অর্থাৎ শেক্সপিরিয়ান উপস্থাপনা। বাংলার যাত্রা বা বাংলার লোকশিল্পের আঙ্গিক। এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বার্নার্ড শ। আজকের তারিখে দাঁড়িয়ে এটাই প্রমাণিত সত্য যে, মানুষ যতই সংকটে পড়েছে, থিয়েটারের লোকেরা ততই উৎপল দত্তকে আঁকড়ে ধরছেন।
উৎপল দত্তের নাট্য নির্মাণের পদ্ধতিটা আমাদের চেনা-জানা পদ্ধতির থেকে একদম আলাদা। তার কারণ, উনি অত্যন্ত বৈজ্ঞানিক উপায়ে তাঁর দলে রিহার্সাল করতেন। আমার একটা বড় সুবিধা হচ্ছে, সম্ভবত আমার মতো আর কেউ নেই যে, দুটো স্কুলেই পড়াশোনা করেছে। একটা মিত্র স্কুল– আচার্য শম্ভু মিত্রের। আর একটা হচ্ছে উৎপল দত্তের। তার কারণ, আমি রমাপ্রসাদ বণিকের ছাত্র। আরও একটা অন্য ধারার স্কুল আছে, যেটা বাদল সরকারের তৈরি। আচার্য শম্ভু মিত্র যে দর্শনে থিয়েটার করতেন, নাট্য নির্মাণ করতেন, আমি সেইটাতে পড়াশোনা করেছি প্রায় ছয় বছর। আর উৎপল দত্তের কাছে আমার চার বছর মতো শিক্ষালাভের সুযোগ হয়েছিল।
অন্যান্য জায়গায় দেখা যায়, সবাই প্রথমে বসে নাটকের সংলাপ বোঝা, মুখস্থ করা, আবেগ অনুসারে উচ্চারণ করা, একটা সময় উঠে দাঁড়ানো, উঠে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত ব্লকিং করা, এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে আলো-পোশাক-সংগীত ইত্যাদি– এই পদ্ধতিতেই অধিকাংশ নাট্যদল রিহার্সাল পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু উৎপল দত্তের পদ্ধতি আলাদা। প্রথমেই আমাদের মতো জুনিয়র ছাত্রছাত্রীদের গোটা নাটকটার দশটা করে পাতা দিয়ে দেওয়া হত, কেননা তখন সাইক্লোস্টাইল করা হত, ফোটোকপি মেশিন আসেনি। বলতেন, কিউ-সহ লিখে নিয়ে আসতে। এইবার উৎপল দত্ত যেটা করতেন, সেটা আশ্চর্যের! যে দু’-তিনদিন আমাদের লিখে আনতে সময় লাগত, তার মধ্যেই স্ক্রিপ্টের বাঁদিকের পাতায় গোটা নাটকের ব্লকিং একদম তৈরি করে ফেলতেন। রিহার্সাল শুরুর প্রথম দিনেই কম্পোজিশন বা ব্লকিং অভিনেতাদের লিখিয়ে দেওয়া যেত। কেননা, রিহার্সাল শুরু হত একটা টেবিল পেতে, সেই টেবিলে দাবার ঘুঁটি পেতে বসতেন। সেই ঘুঁটিগুলোকে সাজাতেন চরিত্রের মুভমেন্ট অনুযায়ী। ডাস্টার, দেশলাই, সিগারেটের প্যাকেট ইত্যাদি দিয়ে চেয়ার-টেবিল, রস্ট্রাম দেখিয়ে দিতেন। দিন দুয়েকের মধ্যেই উৎপল দত্ত নাটকটার স্টেজ মডেল তৈরি করে ফেলতেন। এক-একটা চরিত্র দাবার এক-একটা ঘুঁটি– কেউ সাদা বোড়ে, কেউ কালো বোড়ে, কেউ রাজা, কেউ রানি, কেউ নৌকা। এবার চরিত্রগুলোকে বলতেন যে, তুমি এখান থেকে এখানে যাচ্ছ। ফলে সঙ্গে সঙ্গে অভিনেতারা মিলিয়ে নিত যে, আমরা জুনিয়ররা যেগুলো লিখে এনেছি, তা কতগুলো ঠিক বা কতগুলো ভুল। সেই ভুলগুলো সংশোধিত হত, একই সঙ্গে কম্পোজিশন বা ব্লকিংটাও হয়ে যেত। এটা দু’দিন চলার পর, সবাই হাতে কাগজ নিয়ে, আসল চেয়ার-টেবিল নিয়ে ব্লকিং অনুযায়ী ঘোরাফেরা করত। ইতিমধ্যে যেটা হত, প্রপার্টিজ, অর্থাৎ, বন্দুক, চামচ, গ্লাস, কলম সব এসে যেত। এবার দিনপাঁচেকের মধ্যে মুখস্থ করে নেওয়া, এবং মুখস্থ হয়ে গেলে হাত থেকে স্ক্রিপ্ট ফেলে দিয়ে প্রপার্টি হাতে নিয়ে, প্রপার্টি ব্যবহার করতে করতে রিহার্সাল শুরু করে দেওয়া হত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: খরা নয়, ফসলের বার্তা দিতে চেয়েছিলেন ভ্যান গগ
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এর পর দিন পাঁচেক রিহার্সাল করার পরে অভিনেতাদের যখন সংলাপ মুখস্ত হয়ে গেছে, সেখান থেকে উৎপল দত্ত ক্রমাগত চরিত্রের যে বহুমাত্রিক বিন্যাস, তা ব্যাখ্যা করতে আরম্ভ করতেন। সমাজতাত্ত্বিক মাত্রা, রাজনৈতিক মাত্রা, ব্যক্তিগত জীবনের সম্পর্কের যে টানাপোড়েন এগুলো নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করতেন। এবং তারই সঙ্গে সঙ্গে অভিনয়ের বিভিন্ন টেকনিক, যেমন স্বরবিন্যাস, স্বরক্ষেপণ, চরিত্রের মানসিক অবস্থা অনুযায়ী শরীরের অবস্থান– এগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন। ততদিনে মিউজিক এসে গেছে, সুতরাং মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গে কী করে ওই আবেগ এবং গলা এবং শরীরকে সেইখানে নিয়ে যেতে হবে, সেটা নিয়েও উনি আলোচনা করতেন, যথাসম্ভব দেখিয়েও দিতেন। এই পদ্ধতিতে একমাত্র ‘পিএলটি’-তেই রিহার্সাল হত। এই জন্যই তেরো থেকে চোদ্দো দিনের মাথায় ‘টিনের তলোয়ার’ তৈরি হতে পেরেছে। অর্থাৎ, খুব স্বল্প দিনে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা একটা মানে পৌঁছে যেতেন, যেখানে সাধারণত অত সহজে পৌঁছনো যায় না।
আমি দু’বার ওঁর লাইব্রেরি পরিষ্কার করেছি। মানে, সাজিয়েছি, গুছিয়ে দিয়েছি। আমি এবং শৌভিক রায়চৌধুরী বলে ওঁর আর এক ছাত্র। শৌভিক রায়চৌধুরী অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, পরে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রফেসর ছিলেন। আমরা দু’জনে মিলে লাইব্রেরি সাজাতাম। ওঁর নিজের বইয়ের সংখ্যা পঁয়ত্রিশ হাজার। এবং তার সঙ্গে বাবার দশ হাজার। আমরা অবাক হয়ে দেখতাম, প্রত্যেকটি বইয়ের ক্ষেত্রেই, যেখান থেকেই পাতা ওল্টাই না কেন, দেখতে পাব সরস উক্তি-সহ কতগুলো লাইন লেখা। এবং তার রেফারেন্সও পাওয়া যাবে। বুঝতে পারতাম, একজন মানুষের লেখাপড়ার গণ্ডিটা কত বড় হতে পারে। আসলে, উৎপল দত্ত নিজেই একটা ইনস্টিটিউশন। তাঁকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, এত বিবিধ ক্ষেত্র ধরে আলোচনা করতে হবে যে, সেটা স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। উনি পাঁচটি ভাষায় অনর্গল লিখতে-পরতে পারতেন। ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, লাতিন, উর্দু। এবং মনে রাখতে হবে, ২০ বছর বয়স থেকে উনি বাংলা ভাষাটা প্রকৃতপক্ষে আয়ত্ত করতে শুরু করেন। কেননা বাড়িতে ভয়ংকর সাহেবি ব্যাপারস্যাপার চলত বাবার কড়া নির্দেশে। সংগীতেও তাঁর বিশেষ দক্ষতা ছিল। কেউ যদি কোনও গান গুনগুন করে গাইত, উনি সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করতেন– বলো তো এটা কোন ঠাট, কী রাগ, কী আরোহ, অবরোহ কী, প্রধান শব্দটা কী? সঙ্গে সঙ্গে বলে দিতেও পারতেন। আমার চোখের সামনে দেখা, বাখের বাজনা চলছে, তার স্বরলিপিটা শর্টহ্যান্ডে লিখে কাউকে দিচ্ছেন। যাঁকে দেওয়া হচ্ছে, তিনি একজন প্রখ্যাত ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যালের শিল্পী। অবলীলাক্রমে উর্দু লিখতে পারতেন। আমাদের মধ্যে ছিলেন সামিম ভাই, তিনি হিন্দি পড়তে পারতেন না, এমনকী, অন্য় কোনও ভাষাই পড়তে পারতেন না। উৎপল দত্ত সামিম ভাইকে পুরো কিউ শিটটা বানিয়ে দিতেন উর্দুতে লিখে। এগুলো আমার চোখের সামনে দেখা।
সুতরাং, স্বল্প পরিসরে উৎপল দত্তকে ধরা সম্ভব না। উৎপল দত্তের যেদিন প্রয়াণ হয়, সেই দিন একটি স্বল্পবয়সি মেয়ে এসে সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করেন যে, উৎপল দত্ত সম্পর্কে কিছু বলুন। তাতে সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় একটাই প্রশ্ন করেন, কোন উৎপল দত্ত? অভিনেতা, নাটককার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সংগীতজ্ঞ, ভাষাবিদ? কোন জন? আমরা কোন উৎপল দত্তকে সঙ্গে করে হেঁটে যাব? পারব তো তাঁর সমগ্রটাকে ধরতে?
প্রচ্ছদের শিল্পী: অর্ঘ্য চৌধুরী
প্রথমবার মহিষাসুরমর্দিনী প্রযোজনা করেন জগন্নাথ মুখোপাধ্যায় ও মালতী বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনে করেছেন– কল্যাণ ঘোষ, প্রদ্যোৎ, বিভাস পাল এবং বহুবার পঙ্কজদা, শর্মিষ্ঠাদি। প্রদ্যোৎ যেবার প্রযোজনা করেছিল সেবার দুর্গার চরিত্রে রূপদান করেছিলেন হেমা মালিনী।