Robbar

হারিয়ে যাওয়া, বাতিল মেয়েদের খোঁজে…

Published by: Robbar Digital
  • Posted:January 25, 2025 6:02 pm
  • Updated:January 25, 2025 6:04 pm  

উলফের প্রশ্ন অবশ্য শুধু মেয়েদের ইতিহাসের পাতায় বেনামি হয়ে থাকা, হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে আবদ্ধ ছিল না। প্রশ্ন তুলেছিলেন নারী সাহিত্যের রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়েও। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পুরুষরা সাহিত্যে মেয়েদের রচনা করেছেন। নিজেদের কল্পনার আদলে গড়েছেন নারী চরিত্রদের। কিন্তু মেয়েরা সাহিত্য রচনা করলে তা কীরকম হবে? ভাবতে গিয়ে উলফ কল্পনা করেন মেরি কর্মইকেল নামক এক লেখিকাকে। সেই নারী সাহিত্যের জন্য বরাদ্দ গ্রন্থগারের খালি তাক থেকে ধুলোয় ভরা মেরির এক বই বের করে তার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে তিনি থমকে গেলেন। এক জায়গায় লেখা ‘Chloe likes Olivia’। এই একটি লাইন যেন গোটা সাহিত্যের ইতিহাস বদলে দিল।

ঝিলম রায়

‘I would venture to guess that Anon, who wrote so many poems without signing them, was often a woman…’

১৯২৮। বহু সংগ্রামে সদ্য ভোটাধিকার ছিনিয়ে নেওয়া এক লেখিকার ডাক পড়েছে ‘নারী ও সাহিত্য’ নিয়ে বক্তব্য রাখার। বক্তব্যের বিষয়ে নিয়ে ভাবতে, গবেষণা করতে সেই লেখিকা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পথই সেই সময় যে কোনও মেয়ের জন্য দুর্গম ছিল। সেই পথ পেরিয়ে পুরুষ অধ্যুষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থগারে পৌঁছে একের পর এক ধুলোভরা তাক পেরিয়ে নারী লেখকদের অংশে এসে দ্যাখে– সেই তাক প্রায় খালি!

ছবি সংগৃহীত

কিন্তু সত্যিই কি শতকের পর শতক জুড়ে মেয়েরা কিছুই লেখেনি? ইতিহাসের পাতায় তাহলে অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে নারী লেখকদের উল্লেখ কোথায়? সেই সময় মেয়েদের জীবন কোথায়? ইতিহাসের পাতা হাতড়াতে ক্লান্ত লেখক ভাবে, ইতিহাসে ‘নেই’ হয়ে যাওয়া মেয়েদের কথা– সেই ভাবনার অলিগলিতে ঘুরপাক খেতে খেতে তার প্রশ্ন জাগে ইতিহাস কী? কোনও ঐতিহাসিকের চোখ কীভাবে ঠাওরায় কোনটা নথিভুক্ত করার যোগ্য, কোনটা নয়? এত এত পাতা জুড়ে যে ইতিহাস আমরা পড়ি, তা কাদের কথা বলে? যে ইতিহাস মূলত রাজারাজরার শাসন, যুদ্ধ, বাণিজ্যের গল্পে ঠাসা, সেখানে কি আদৌ মেয়েদের ঠাঁই আছে? কোনও সাধারণ মেয়ের কথা কি ইতিহাসের এই ধাঁচায় আদৌ বলা সম্ভব? যে অপরিসীম অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিকূলতা পেরিয়ে মেয়েরা ‘লেখক’ হয়ে ওঠে, সেই ইতিহাস কি তার সাক্ষ্য রাখে?

Virginia Woolf died 80 years ago. What does reading her work in ...
ভার্জিনিয়া উলফ

প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে খেতে লেখকের মনে হয় ইতিহাসের পাতায়, বইতে যে অসংখ্য বেনামি গল্প-কবিতা পাওয়া যায়, হয়তো বা খুঁজলে, অনেক অনেক খুঁজলে, পাওয়া যাবে কোনও না কোনও মেয়েকে। কোনও মেয়েকে ‘ডাইনি’ বলে পুড়িয়ে মারার গল্পে, কোনও মেয়ের ওপর শয়তানের ভর করার খবরে, কোনও মেয়ের প্রলাপ একটি গল্পকথায় হয়তো বা খুঁজে পাওয়া যাবে কোনও হারিয়ে যাওয়া লেখিকাকে– কোনও ‘নেই’ হয়ে যাওয়া কবিকে। হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে শেক্সপিয়রের বোনকে, সেই সময় সমাজ যার প্রতিভাকে তিল তিল করে মেরে ফেলেছিল। প্রশ্ন করে, যে-মেয়েদের ভোর হওয়ার আগে উঠে থেকে সংসারের কাজ করতে হয়, বাচ্চা সামলাতে হয় যার, অবসর থাকতে নেই, দু’দণ্ড একলা বসে চিন্তা করার ফুরসত নেই, শান্ত হয়ে নিজের ভাবনা গোছানোর কোনও নিজের জায়গা নেই, শুধু লেখার জন্য সময় কাটানোর আর্থিক সামর্থ নেই, যে দুনিয়া ঘুরতে বেরিয়ে পড়তে পারে না, যার জন্য এমন কোনও শহর নেই যেখানে সে দিনে-রাতে নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারবে, লিখতে বসলে যার ভাবনা, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা প্রকাশ করার কোনও ভাষা তার পূর্বসূরিরা দিয়ে যেতে পারেনি, নেই ধার করার মতো কোনও নারী সাহিত্যের ঐতিহ্য, সেই মেয়েদের লেখক হয়ে ওঠা কি সম্ভব? যে সমাজ নিজের হক দাবি করলে মেয়েদের সর্বসমক্ষে ডাইনি দাগিয়ে পুড়িয়ে মারে, যে-সমাজ মেয়েদের মত প্রকাশকেই ‘পাগলের প্রলাপ’ মনে করে, যে সমাজ বরাবর মানিয়ে না-নেওয়া মেয়েদের বাতিল করে দেয়, সেই সমাজে নারী লেখক হয়ে ওঠাই আসলে বিপ্লবী প্রতিরোধের গল্প।

Virginia Woolf
১৯১১। ভার্জিনিয়া উলফ

১৯২৮ সালের ব্রিটেনে, মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভার্জিনিয়া উলফের এই এতগুলো প্রশ্ন সজোরে রাখা আসলে এক নতুন ইতিহাস তৈরি করে। ইতিহাসকে পড়ার নারীবাদী চোখ তৈরি করে। সাহিত্যের ইতিহাসের লিঙ্গীকরণ করে। সেই প্রশ্ন ধরেই নারীবাদী রাজনীতি এক অন্য ইতিহাস লিখতে শেখায়। যে-ইতিহাস মূলস্রোতের তথ্যসূত্রের বাইরে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের খোঁজ করে। যে ইতিহাস রচিত হয় ইতিহাস বইয়ের মার্জিন থেকে। অস্ফুটে বলা কথার সূত্র ধরে তদন্ত করে। সেই ইতিহাস কখনও পাওয়া যায় কোনও রান্নার বইয়ের শেষপাতার হিজিবিজিতে পরে থাকা কোনও কবিতার লাইনে, কখনও বা হিসেবের খাতার এক পাশে ছোট ছোট করে লেখা কোনও গল্পে, কখনও বা কোনও মায়ের শিশুকে শোনানো ঘুমপাড়ানি গানে, কখনও বা ঠাকুমার বলা অনেক মুখ ঘুরে আসা কোনও লোককথায়, কখনও বা বাড়ির জঞ্জালে পড়ে থাকা কোনও বাতিল পাণ্ডুলিপিতে, কিংবা কোনও পত্রিকায় ছদ্মনামে লেখা কোনও কবিতায়, অথবা বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে থাকা কোনও ডায়েরিতে, খেতে কাজ করতে করতে গেয়ে ওঠা কোনও গানে। নারীবাদী ইতিহাসের শুরু এই বাতিল মেয়েদের খোঁজ থেকেই।

Joan Kelly Horn - Wikipedia
জোয়ান কেলি

সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের নিয়ে প্রশ্ন করতেই আরেক জটিল প্রশ্ন করে বসেন আরেকটি মেয়ে। উলফের চার দশক পরে। জোয়ান কেলি। ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের খুঁজতে গিয়েই এই ঐতিহাসিক প্রশ্ন করে বসেন ইতিহাসে কালপর্ব নির্ধারণের রাজনীতিকে। ১৯৭৬-এ ইউরোপের ইতিহাসে খুঁড়তে গিয়ে জোয়ান দেখেন যে, ইউরোপিয়ন রেনেসাঁ নিয়ে এত কথা হয়, সেই ইতিহাসের সময়কে মেয়েদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে যদি পড়া হয়, তাহলে দেখা যাবে যে-পর্বকে ‘রেনেসাঁ’ বলা হয়, সেই সময়ের যুগান্তকারী নানা নতুন আবিষ্কার, অনুসন্ধান, ভাবনার বিকাশের প্রশ্নকে সামনে রেখে, মেয়েদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখলে দেখা যাবে মধ্যযুগে মেয়েদের যাপনে, ভাবনায়, রাজনীতিতে যে বিকাশ ঘটছে, তা তথাকথিত রেনেসাঁর যুগে এসে থমকে যাচ্ছে। যে-ইউরোপিয়ান সমাজ পুরুষদের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল– বিজ্ঞান, সাহিত্যে, শিল্পে নতুন জোয়ার এনেছিল, সেই সমাজ, সেই সাহিত্য, সেই শিল্পই মেয়েদের শৃঙ্খলবদ্ধ করেছিল সতীত্ব, পবিত্রতার নানা সামাজিক নীতির জালে। ‘রেনেসাঁ’ মেয়েদের জীবনে কি কোনও নতুন জোয়ার এনেছিল? তাহলে সেই সময়কালকে ‘রেনেসাঁ’ নির্ধারণ করলে মেয়েদের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে মুছে দিতে হয়। তাহলে কি ‘রেনেসাঁ’ নারী প্রশ্নকে উপক্ষা করবে? জোয়ান কেলির সেই প্রশ্ন ইতিহাস লেখার রাজনীতিকে নারীবাদী আঙ্গিকে দেখার এক অন্য পাঠ শুরু করেছিল। হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের চোখ দিয়ে ইতিহাসকে দেখার বোঝার পাঠ, ইতিহাসের মূল ধারণাকেই প্রশ্ন করার পাঠ। যার হাত ধরে পরবর্তী প্রজন্মের নারীবাদী ঐতিহাসিকরা নতুন প্রথাগত ছক ভেঙে নতুন করে ইতিহাস লেখার সূচনা করেছে। এই উত্তরাধিকার বয়েই আমাদের দেশের ইতিহাসকেও নতুন ভাবে পড়েছেন নারীবাদী ঐতিহাসিকরাও। খুঁজেছেন নতুন তথ্যসূত্র। কালপর্ব নির্ধারণের রাজনীতিকে মেয়েদের অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রশ্ন করে লিখেছেন নতুন ইতিহাস। কেলির প্রশ্নের হাত ধরেই নারীবাদী ঐতিহাসিক উমা চক্রবর্তী প্রশ্ন করেছেন, ইতিহাসের চরিত্র কারা? প্রশ্ন করেছেন, শুধু কিছু ঘটনা ধরে ইতিহাস লেখার প্রয়াসকে। একই সঙ্গে প্রশ্ন করেছেন শুধু উৎপাদন সম্পর্ক ধরে ইতিহাস লেখার প্রবণতাকে। প্রশ্ন করেছেন, এই ইতিহাসে কেন বারবার মেয়েরা হারিয়ে যায়? প্রশ্ন করেছেন, যাদের কাঠামোগত ভাবে উৎপাদন সম্পর্ক থেকে বাইরে রাখা হয়েছে, তাদের ইতিহাসের স্থান কোথায়? হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের ইতিহাসে খুঁজতে তাই নারীবাদী ইতিহাসরা গবেষণা করেছেন সামাজিক পুনরুৎপাদনের সম্পর্কও।

……………………………

উলফের মতোই সাহিত্যের ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের খুঁজতে গিয়ে ১৯৭৬ সালে লরা উৎরেইচ লিখেছিলেন, ‘well behaved women seldom make history’। উলফের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া লরার এই উক্তি নারীবাদী আন্দোলনের স্লোগান হয়ে ওঠে। জানান দেয় কেন এই সমাজ অবাধ্য মেয়েদের পুড়িয়ে ফেলতে চায়।

…………………………….

উলফের প্রশ্ন অবশ্য শুধু মেয়েদের ইতিহাসের পাতায় বেনামি হয়ে থাকা, হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে আবদ্ধ ছিল না। প্রশ্ন তুলেছিলেন নারী সাহিত্যের রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়েও। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পুরুষরা সাহিত্যে মেয়েদের রচনা করেছেন। নিজেদের কল্পনার আদলে গড়েছেন নারী চরিত্রদের। কিন্তু মেয়েরা সাহিত্য রচনা করলে তা কীরকম হবে? ভাবতে গিয়ে উলফ কল্পনা করেন মেরি কর্মইকেল নামক এক লেখিকাকে। সেই নারী সাহিত্যের জন্য বরাদ্দ গ্রন্থগারের খালি তাক থেকে ধুলোয় ভরা মেরির এক বই বের করে তার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে তিনি থমকে গেলেন। এক জায়গায় লেখা ‘Chloe likes Olivia’। এই একটি লাইন যেন গোটা সাহিত্যের ইতিহাস বদলে দিল। ভেঙে দিল সাহিত্যে এতকাল চলে আসে পুরুষের সম্পর্কে নিরিখে নারীর নির্মাণের প্রথাকে। এই প্রথম সাহিত্যে দুই নারী চরিত্রের কথা এল কোনও পুরুষ চরিত্রের সূত্র ছেড়ে। উঠে এল একই ল্যাবরেটরিতে কাজ করা দুই নারীর একে অপরকে ভালোলাগার, একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্বের, ঘনিষ্ঠতার গল্প। সেই একটি লাইন যেন অনেক অন্ধকার ঘরে একসঙ্গে আলো ফেলল। ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের, ইতিহাসে নিষিদ্ধ হওয়া বহু সম্পর্কে আলো ফেলল। যেসব কথা লেখা বারণ, যেসব কথা বলা বারণ সেই সমস্ত নীরবতা ভেঙে মুখর হল ক্লোই এবং অলিভিয়ার গল্প। পুরুষের অক্ষ ছাড়িয়ে দুই মেয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠা তাই বারবার গড়ে তুলেছে এক অন্য প্রতিরোধের ইতিহাস। অবাধ্য, বাতিল মেয়েদের ইতিহাস।

উলফের মতোই সাহিত্যের ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের খুঁজতে গিয়ে ১৯৭৬ সালে লরা উৎরেইচ লিখেছিলেন, ‘well behaved women seldom make history’। উলফের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া লরার এই উক্তি নারীবাদী আন্দোলনের স্লোগান হয়ে ওঠে। জানান দেয় কেন এই সমাজ অবাধ্য মেয়েদের পুড়িয়ে ফেলতে চায়। কেন ক্লোই আর অলিভিয়ার গল্প পিতৃতন্ত্রের ভিত নাড়িয়ে দেয়। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকেই জন্ম নেই প্রতিরোধী নারীবাদী ইতিহাস।