একাধিক নামকরা বহুজাতিক ফুড ডেলিভারি সংস্থা এবং ই-কমার্স কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা ডেলিভারি কর্মীদের ভোটের দিনেও ছুটি দেয়নি। কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯ এপ্রিল প্রথম দফার লোকসভা ভোটের দিনে তামিলনাড়ুতে একাধিক নামকরা ই-কমার্স সংস্থা ডেলিভারি কর্মীদের মাল সরবরাহের কাজে নিযুক্ত করেছিল। কমিশনের কাছে এই মর্মে অভিযোগ দায়ের করেন চেন্নাই হাই কোর্টের আইনজীবী কে. নরসিমা। অভিযুক্ত সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানান তিনি। প্রশ্ন হল, আদৌ কি এই প্রতিবাদে চিড়ে ভিজবে?
‘যে করে খনিতে শ্রম, যেন তারে ডরে যম।’ শুধু খনি শ্রমিক নয়, এই হল শ্রম ও শ্রমিক সম্পর্কে সমাজের সার্বিক ধারণা। যেহেতু ‘গরিব আর মেয়ে মানুষের শরীর হল কই মাছের প্রাণ!’ যেমন এদেশের লক্ষ লক্ষ ডেলিভারি কর্মী তরুণ-তরুণী। কাজের হিসেবে ওঁদের দিন যা, রাতও তাই। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি, এমনকী, ভূমিকম্প হলেও গ্রাহকের হাতে মাল পৌঁছে তবে মরার ফুরসত! তবেই তো মিলবে খুড়োর কল কমিশন। কাস্টমার ভালো ‘রেটিং’ দিলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল না হলেও ফ্যাকাসে ভাব খানিক কমলেও কমতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, আচ্ছা, এঁরাই কি নব্য প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারা? লোকসভা ভোটের মুখে সুইগি-জোম্যাটো, বিগ বাস্কেট, অ্য়ামাজন-ফ্লিপকার্টের মতো দেশি ও বিদেশি অনলাইন বিপণন সংস্থাগুলি এই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। কীভাবে?
এই যে দুই দফায় গণতন্ত্রের উৎসব চলল দেশে। তাতে যে এলাকায় ভোট সেখানকার সরকারি, বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা সবেতন ছুটি পেয়েছেন ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন তথা নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকা মেনে। ব্যতিক্রম ‘হারাধনের ফেলনা ছেলে’ ডেলিভারি কর্মীরা। একাধিক নামকরা বহুজাতিক ফুড ডেলিভারি সংস্থা এবং ই-কমার্স কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা ডেলিভারি কর্মীদের ভোটের দিনেও ছুটি দেয়নি। কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯ এপ্রিল প্রথম দফার লোকসভা ভোটের দিনে তামিলনাড়ুতে একাধিক নামকরা ই-কমার্স সংস্থা ডেলিভারি কর্মীদের মাল সরবরাহের কাজে নিযুক্ত করেছিল। কমিশনের কাছে এই মর্মে অভিযোগ দায়ের করেন চেন্নাই হাই কোর্টের আইনজীবী কে. নরসিমা। অভিযুক্ত সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানান তিনি। প্রশ্ন হল, আদৌ কি এই প্রতিবাদে চিড়ে ভিজবে?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বহুজাতিক সংস্থাগুলির মোটো হল ‘ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হবে না।’ কী করে হবে? আত্মনির্ভর ভারতে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা নতুন রেকর্ড গড়েই চলেছে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের (ILO) দাবি, বর্তমান ভারতে কর্মক্ষম যুবসমাজের ৮৩ শতাংশই বেকার। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই ঘরে মুনাফা তুলছে অনলাইন বিপণন কোম্পানিগুলি। অথচ যাঁদের রক্ত জল করা শ্রমে পয়সা কামাচ্ছে, তাঁদের হাতে ‘পেনসিল’ও থাকছে না!
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এমনিতে নিয়ম ভাঙলে সংবিধানে শাস্তির ব্যবস্থাও রয়েছে। ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী ৫০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে বিধিভঙ্গকারীর। সংস্থার বিরুদ্ধে থানায় এফআইআর দায়েরও করতে পারে প্রশাসন। যদিও নির্মম সময় বলছে, অসংগঠিত শ্রমিক ডেলিভারি কর্মীদের ‘অচ্ছে দিন’ হল রাজপাল যাদবের অমিতাভ বচ্চন হওয়ার স্বপ্নের মতো। অবাস্তব এক বিষয়। বহু ডেলিভারি কর্মীর অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ তাঁদের মানুষ বলে জ্ঞান করে না। প্রদীপের জিনের মতো করে কাজ চায়। অবশ্যি এমনটাই স্বাভাবিক। বহুজাতিক সংস্থাগুলির মোটো হল ‘ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হবে না।’ কী করে হবে? আত্মনির্ভর ভারতে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা নতুন রেকর্ড গড়েই চলেছে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের (ILO) দাবি, বর্তমান ভারতে কর্মক্ষম যুবসমাজের ৮৩ শতাংশই বেকার। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই ঘরে মুনাফা তুলছে অনলাইন বিপণন কোম্পানিগুলি। অথচ যাঁদের রক্ত জল করা শ্রমে পয়সা কামাচ্ছে, তাঁদের হাতে ‘পেনসিল’ও থাকছে না!
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: ১০ মিনিট শেষমেশ পাংচুয়াল হল
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………
২০২৩ সালের জুলাই মাসের একটি রিপোর্ট অনুয়ায়ী, শুধু পশ্চিমবঙ্গেই তিন থেকে সাড়ে তিন লক্ষ মানুষ এই পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। এই শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা বলে কিছু নেই। ডেলিভারি বয় বা গার্ল, এই পেশার সঙ্গে যুক্তরা সংস্থার ‘পার্মানেন্ট এমপ্লয়ি’ বা স্থায়ী কর্মী হিসেবে বিবেচিত হন না। পিএফ, গ্রাচুইটি, বিমার মতো সুযোগ সুবিধার থেকে বঞ্চিত। মাঝে এদের পাশে দাঁড়াতে উদ্যোগ নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শ্রম দপ্তর। সেই সূত্রে ডেলিভারি কর্মীদের ‘গিগ ওয়ার্কার’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, অর্থাৎ যে সমস্ত কর্মীর নির্দিষ্ট কোনও নিয়োগ কর্তা নেই।
যার কেউ নেই, সেই অনাথকে সবাই চমকাবে-ধমকাবে, এটাই তো স্বাভাবিক। সেই ‘নিয়ম’ মেনে সম্প্রতি একটি বহুজাতিক অনলাইন ফুড ডেলিভারি সংস্থা ঘোষণা করেছে, তীব্র গরমের মধ্যেই এ রাজ্যের ডেলিভারি কর্মীদের দুপুর ১২টা থেকে ৪টে পর্যন্ত কম করে ৩ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট ডেলিভারির কাজ করতে হবে। তবে শ্রমিকদের দিকটিও বিবেচনা করেছে ‘দায়িত্ববান’ ওই সংস্থা। তাই ইনসেনটিভ ২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ টাকা করা হয়েছে। বলা যেতে পারে, মৃত্যুর দাম ৩০ টাকা বেশি!
মৃত্যুই তো! জলবায়ুর পরিবর্তনে মাত্রাছাড়া গরমের সাক্ষী হচ্ছে দেশ। তথাপি বৈশাখ, জৈষ্ঠ্যের আগুনে রোদের সঙ্গে যুঝে পেট চালাতে হবে। এসব জেনেই তো কাজে এসেছেন ওঁরা। ঠিক কথা। কিন্তু এ গ্রীষ্মের মোকাবিলা দুঃস্বপ্নকেও যে হার মানাচ্ছে! দু’চাকায় ছুট লাগালে ছোবল মারে লু। সিগন্যালে দাঁড়ালে বিষাক্ত তিরের মতো বিঁধছে রোদ। যে কঠিন আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখে, হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচতে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল চারটে অবধি ঘরের বাইরে যেতে বারণ করছে আবহাওয়া দপ্তর। তার মধ্য়েই হা-ক্লান্ত শরীর নিংড়ে কাজ করতে হয় এই মানুষগুলোকে। বিধ্বস্ত মনে নিছকই আশাহীন কাজ বা জয়হীন চেষ্টার শ্রম। ‘কাজ করলে টাকা, না-করলে নেই’ চুক্তিতেও অনেকেই অসুস্থ হয়ে ছুটি নিচ্ছেন। তবে একটি সংস্থা নাকি নিখরচার অ্যাম্বুল্যান্সের আশ্বাস দিয়েছে।
সম্ভবত, এই অ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে শায়িত একটি অসুস্থ সমাজ! অতি দ্রুত যার চিকিৎসার প্রয়োজন। অথবা হীরক রাজার কায়দায় লিবিয়ার জঙ্গলের মতো অন্ধকারে ছুড়ে ফেলুন সর্বহারা অসংগঠিত শ্রমিক শ্রেণিকে। আর হে আর্বান, প্রগতিশীলতার মুখোশ খুলে চিৎকার দিন– ‘অনাহারে নাহি খেদ, বেশি খেলে বাড়ে মেদ!’ এই হল তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকের সত্য।