ঝোপেঝাড়ে ঘুরে আমার ছোটবেলা কেটেছে। পুরনো ভাঙা পাঁচিলের খোপে কতবার বোড়া সাপের রোদ পোহানো, খোলস ছাড়ানো দেখেছি। কিন্তু সাপ দেখলেই আমরা যেভাবে দৌড়ে গেছি, বাস্তসাপেরাও বাস্তহারা হয়েছে। ঝোপেঝাড়ে ঘুরতে ঘুরতে কতবার গায়ে বিছুটি পাতার ঘষা লেগেছে, তার ইয়ত্তা নেই। সেই বিছুটি গাছ শেষ কবে দেখেছি মনে পড়ে না। দিদি বোনদের সঙ্গে অনেক রান্নাবাটি খেলেছি। ব্যাটাছেলে হয়েও। রান্নাবাটি খেলায় ব্যবহার হত বিভিন্ন ধরনের আগাছা। ছোট ছোট পানপাতার মতো দেখতে একটা গাছ খুব ব্যবহার করতাম। নাম না জানা। ওই গাছ আর খুব একটা দেখা যায় না।
নব্বইয়ের গোড়ার দিকে ভারতের উদার অর্থনীতি যখন সবে সবে কচি সবুজ, আমরাও শরীর-মন সবদিকে কচি কলাপাতা রঙের সবুজ তখন। প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে সেই সবুজের এবং তার আশপাশের কেমন বদল হল আজ সে-কথাই বলব।
নয়ের দশকেরও অনেক বছর আগের কথা। আমার বাবার মুখে শোনা। আমাদের জাত-পেশা তাঁত বোনা। আমাকে নিজেকে যদিও কখনও তাঁত চালাতে হয়নি। আমার বাবা কম বয়সে চালিয়েছেন। বংশের প্রথম গ্রাজুয়েট আমার বাবা। কমার্স পড়তেন। বাঁকুড়া সম্মিলনী কলেজে। নাইট ব্যাচে। সারাদিন তাঁত চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে একরকম দৌড়ে দৌড়ে কলেজ পৌঁছতেন। সাইকেল কেনার সামর্থ্য ছিল না। বাগছালা শিমুলডাঙ্গা হয়ে তালতলার ঘাট থেকে দ্বারকেশ্বর পার হয়ে ওপারে ভগার ডেগ পার হয়ে হসপিটালের মর্গের পাশ দিয়ে একদম লেট লতিফ হয়ে কলেজ পৌঁছতেন। এত কথা বলা এইজন্যেই, কারণ এই পুরো রাস্তাটা ছিল প্রায় জঙ্গলে ঘেরা। আমার জ্ঞান হওয়ার পর নয়ের শুরুর দিকে ওই ঘন সবুজ জঙ্গলের ছিটেফোঁটা দেখেছি হয়তো। এখন সাততলা বিল্ডিং, পুরোটাই ফ্ল্যাটবাড়ি।
………………………..
মনে পড়ে ছোটবেলায় একটা পাখি দেখা যেত। যেমন অদ্ভুত রং, সেরকম অদ্ভুত সুন্দর নাম। ট্যাসকোনা। শান্তিপুরী বাংলায় কী নামে ডাকে জানি না। প্রচলিত রূপকথার গল্পের আঞ্চলিক ভার্সনগুলিতে তাই কখনও কখনও স্থান হত এই পাখির।
…………………………
সবুজের কথা বললেই গাছপালা, বন, জঙ্গলের কথা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তবে ওই গাছপালা, বন, জঙ্গলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা জীবন, জীবিকা, স্মৃতি, ভাঙা প্রেম সবকিছুই টেনে বেরিয়ে আসে।
মনে পড়ে ছোটবেলায় একটা পাখি দেখা যেত। যেমন অদ্ভুত রং, সেরকম অদ্ভুত সুন্দর নাম। ট্যাসকোনা। শান্তিপুরী বাংলায় কী নামে ডাকে জানি না। প্রচলিত রূপকথার গল্পের আঞ্চলিক ভার্সনগুলিতে তাই কখনও কখনও স্থান হত এই পাখির। এত জটিল ভাবনায় যাব না। আমাদের ছোট শহর থেকে গত কয়েক বছরে প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে কাক-চড়ুইয়ের মতো অত্যন্ত সাধারণ পাখি। কাঠবিড়ালী। গিরগিটি। আঞ্চলিক ভাষায় যাকে ‘ফেওয়া’ বলে, ইংরেজি নাম ‘গোল্ডেন স্কিংক’। এইসব প্রাণীগুলোও আর বেশি দিন দেখা যাবে বলে মনে হয় না।
ঝোপেঝাড়ে ঘুরে আমার ছোটবেলা কেটেছে। পুরনো ভাঙা পাঁচিলের খোপে কতবার বোড়া সাপের রোদ পোহানো, খোলস ছাড়ানো দেখেছি। কিন্তু সাপ দেখলেই আমরা যেভাবে দৌড়ে গেছি, বাস্তসাপেরাও বাস্তহারা হয়েছে।
ঝোপেঝাড়ে ঘুরতে ঘুরতে কতবার গায়ে বিছুটি পাতার ঘষা লেগেছে, তার ইয়ত্তা নেই। পাড়ার এক তুতো দিদি মাথায় চুল গজানোর জন্য বিছুটি পাতা ঘষত। সেই বিছুটি গাছ শেষ কবে দেখেছি মনে পড়ে না।
দিদি বোনদের সঙ্গে অনেক রান্নাবাটি খেলেছি। ব্যাটাছেলে হয়েও। রান্নাবাটি খেলায় ব্যবহার হত বিভিন্ন ধরনের আগাছা। ছোট ছোট পানপাতার মতো দেখতে একটা গাছ খুব ব্যবহার করতাম। নাম না জানা। ওই গাছ আর খুব একটা দেখা যায় না।
যেমন দেখা যায় না আমার মায়ের খুঁজে দেওয়া গাই বাছুর গাছের ফল। ঘাস জাতীয় আগাছার ফলের বিচি হল এই গাইবাছুর গাছ। খুব সূক্ষ্ম রোঁয়া থাকে। বিচিগুলোকে বট বা অশ্বত্থ পাতার উপর রেখে জোরে চিৎকার করলে কম্পনে বিচিগুলো আস্তে আস্তে নড়তে থাকে। মা সুর করে গেয়ে শোনাত– গাই গেল রনে বনে, বাছুর গেল বৃন্দাবনে, রাখালিয়া হোওওওওও।
দেখা যায় না নরম মোলায়েম লাল টুকটুকে আষাঢ়ে পোকা। ছোটবেলায় বর্ষাকালে মাটির ঘাসে ঘাসে আকছার দেখা মিলত এই আদুরে পোকাগুলোর। কেউ কেউ দেশলাই বাক্সে ভরে রাখত। ঘাসপাতা খেতে দিয়ে। ভালো মন্দের অত জ্ঞান তো ছিল না তখন।
…………………
পড়ুন লাল নিয়ে হিরণ মিত্রের লেখা: সাদা-কালো ক্যানভাসে একদিন লালের ফোঁটা পড়ল, আমার ছবি বদলে গেল তারপর
………………….
এইসব এস্থেটিক পোকামাকড়ের কথা বাদ দিন। গেল দীপাবলিতে তো বিরক্তিকর শ্যামাপোকার দেখাও মেলেনি।
এইসব আগাছা পোকামাকড়ের মতো ছোটখাটো খুচরো জিনিসের দিকে নজর দেওয়ার সময় কার আছে! একটু বড়সড় জিনিসের দিকে তাকানো যাক। আমাদের ছোট শহরে এবং তার আশপাশের গ্রামগঞ্জে গত এক দশকে যে পরিমাণে বট অশ্বত্থ জাতীয় বড় বড় গাছ কাটা পড়েছে, তার হিসাব নেই। দুঃখের বিষয় এই অঞ্চলের মানুষজনের এবং মিডিয়ার কোনও হেলদোল দেখা যায় না। যেমনটা হয়েছিল যশোর রোডের গাছ কাটার সময়।
কিছু কিছু বট অশ্বত্থ গাছ তাও মানুষের নজর এড়িয়ে যেতে পেরেছে, কারণ সেইসব গাছের তলায় রাখা ছিল সিঁদুরলেপা মাটির হাতি-ঘোড়া। স্থানীয় দেব-দেবী। জিনাসিনি। কুদরাসিনি। সাত বহিন। কিন্তু যেসব গাছগুলি দেবদেবীর দাক্ষিণ্য পায়নি, তাদের কেউ বাঁচাতে পারেনি। যেমন চাকলতা বা চটরা বাদাম। আকড় বা এগড়ো। সবই স্থানীয় নাম। মনে পড়ে আগে কালবৈশাখীর পর ছাদ উঠোন ভরে যেত বাঁদরলাঠি ফুলের সোনালি পাপড়িতে। বাঁদরলাঠি নামেই ডাকতাম আমরা অমলতাসকে। এসথেটিক হয়েও মানুষের ভালোবাসা পায়নি এই গাছ। আমাদের শহরে কতগুলো আছে, হাতে গোনা যাবে এখন।
………………….
পড়ুন কমলা নিয়ে সুশোভন অধিকারীর লেখা: সময় যখন সন্ধ্যা, তখন এক লহমায় চিনে নিতে পারি অনুচ্চারিত রংটি কী?
…………………..
আসলে আম বা লিচুর মতো ফল দেয় না এইসব গাছ। সেগুন মেহগিনির মতো দামী কাঠও হয় না এসব গাছ থেকে। তাই কারও এইসব গাছ নতুন করে লাগানোর দায়ও নেই আর। চাকলতা গাছের গুঁড়ি ব্যবহার হত মাটির বাড়ির চালার কাঠামো বানাতে। এখন তো মাটির বাড়িই উঠে গেছে। ক্লাস টুয়ের ‘পরিবেশ পরিচিতি’ বইয়ে পড়েছিলাম যারা পাকা বাড়ি বানায়, তাদের ‘রাজমিস্ত্রি’ বলে আর যারা কাঁচা বাড়ি বানায়, তাদের ‘ঘরামি’ বলে। এই ঘরামি পেশারও বিলুপ্তি হয়েছে এখন। এই পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা হয় রাজমিস্ত্রি হয়েছেন, নয়তো টোটো চালাচ্ছেন, নয়তো নদী থেকে বালি তোলার কাজ করছেন। আর নতুন করে যদি ভাবেন মাটির বাড়ি বানাবেন, তাহলে আপনাকে প্রচুর চড়া দাম দিয়ে আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে আসতে হবে। আর নিজে না বানাতে চাইলে গ্রামসুলভ নামের কোনও রিসর্টে অনেক টাকা ভাড়া দিয়ে রাত কাটিয়ে আসুন। ঝুলনের মতো সাজানো পুকুরে হাঁস দেখুন। গরুর গাড়ি চড়ুন।
প্রশ্নটা হচ্ছে কোথায় গেল এসব গাছ। কোথায় আবার? আমাদের লোভে। গত কয়েক দশকে দূর গ্রামগঞ্জ থেকে জেলা সদরে উঠে আসার পরিমাণ যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে জেলা থেকে বড় মেট্রো শহরে উঠে যাওয়ার পরিমাণ। ফলে ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেছে বাড়ি বানানোর পরিমাণ। একের পর এক বড় বড় সাজানো বাড়ি খালি করে মানুষ বাঁকুড়া পুরুলিয়া মেদিনীপুর ছেড়ে উঠে যাচ্ছে গুরগাঁও, বেঙ্গালুরু, লস এঞ্জেলেস। আর সারেঙ্গা, লুধুরকা খালি করে মানুষ উঠে আসছে জেলা শহরে। পড়াশোনা। চিকিৎসা। একটুখানি কাজের আশায়।
এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষের প্রপার্টি বাড়ানোর ইচ্ছা। আমি হয়তো বছরে একবার ছুটি কাটাব, তাও একটা ঢাউস বাড়ি বানিয়ে রাখব। ইনভেস্টমেন্টের কথা ভেবে। এর সবথেকে বড় উদাহরণ হল শান্তিনিকেতন। গ্রাম-গ্রাম পরিবেশের খোঁজে কলকাতার মানুষজন শান্তিনিকেতনকেই আরেকটি কলকাতা বানিয়ে ফেলেছে। কিছুদিনের মধ্যেই একই অবস্থা হতে চলেছে অযোধ্যা পাহাড়ের। ডেস্টিনেশন ওয়েডিং। সারারাত ধরে নাইট ম্যারাথন। ডিজে পার্টি। এককথায় অযোধ্যা পাহাড় হিলটপ এখন একটি স্মল টাউন। সান্দাকফুও এখন স্মল টাউন। দুর্গম জঙ্গলে বসে যদি পেস্ত স্যান্ডউইচ না খাই, তাহলে এত রোজগার করে লাভ কী হল? তাই না?
ওই খুচরো আষাঢ়ে পোকা, চটরা বাদাম, খামালুর জন্যে রুদালি করে লাভ কী?
বারবার ফিরে যেতে হয় ছোটবেলায়। মনে পড়ে বাড়ির পিছনে জেঠুদের বাগানে একটা পর্বত প্রমাণ শিমূল গাছ ছিল। ওই গাছের গুঁড়ি থেকে জন্ম হয়েছিল আরেক বিশাল বেড়া গাছের। জিলিপির মতো ফল হত। টিয়াপাখির খুব প্রিয় খাবার। গাছের কোটরে কত টিয়াপাখি যে থাকত। আরও ছিল। পেদো কাঞ্চন ফুলের গাছ। নিম গাছ। খেজুর গাছ। সবক’টা গাছ জড়িয়েছিল ওই সুবিশাল শিমূল গাছের সঙ্গে। শীতের শেষে শিমূল কুঁড়িতে গাছ ভরে আসত। আমরা গাছের তলা থেকে শিমূলের কুঁড়ি কুড়িয়ে নিয়ে তাতে পোড়া দেশলাই কাঠি গুঁজে বানাতাম ছোট ছোট লাটিমের মতো ঘূর্ণি। ক’দিন পর পুরো গাছ ফুলে ভরে উঠত। অনেক দূর থেকে চিনতে পারতাম আমাদের শিমূল গাছ। শুধু ট্যাসকোনা আর টিয়াপাখি না। থাকত প্রচুর শকুন। শকুনের বাচ্চার চিৎকার শুনেছেন কখনও? অবিকল মানুষের বাচ্চার কান্না। কতবার শুনেছি ছোটবেলায়। ভয় পেয়েছি।
আর থাকত প্রচুর সাপ। কারা যেন বলেছিল ঝড়ের সময় গাছ থেকে উড়ন্ত সাপ পড়তে দেখলে লাল শালু চাপা দিতে হয়। তাহলে নাকি সাপ সোনা হয়ে যায়। অনেক সোনার লোভে একদিন কাটা পড়ল সেই শিমূল গাছ। গোটা পাড়া কাজ কামাই করে দেখতে এসেছিল। সেই সুবিশাল গাছের কাণ্ড যখন মাটিতে পড়ল আশপাশ কেঁপে উঠেছিল। ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন। এখনও ভাবলে বুকে বাজে সেই আওয়াজ। এক লহমায় বাস্তুহারা হল অত টিয়াপাখি, শকুন, সাপ। এক নিমেষে শেষ হয়ে গেল একটি সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্র। এক নিমেষে শেষ হয়ে গেল আমার ছোটবেলার একটা অধ্যায়।