গত সাত দশকের ব্যবধানে সংবাদের জগতে অনেক বিবর্তন ঘটেছে। জনগণের খবরের খিদে আর এখন শুধুমাত্র খবরের কাগজের ছাপা অক্ষর মেটায় না। ড্রয়িংরুমের টিভির পর্দা ছাড়িয়ে ঘরের বাইরে থাকাকালীন হাতের মুঠোফোনে সব খবর উঠে আসে জনগণের কাছে। কিন্তু সেই অধিকার একদিনে আসেনি। তবে তার প্রথম ধাপটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যা এসেছিল ফিরোজ গান্ধীর হাত ধরে।
সম্প্রতি শাসক-বিরোধী একে অপরকে ‘চোর চোর’ বলে এ রাজ্যের বিধানসভাকে উত্তপ্ত করেছিল। শুধু এ রাজ্য বলে নয়, টিভির ক্যামেরা আজ ঘরের কোণে পৌঁছে যাওয়ায় দেশের বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভায় অথবা লোকসভায় জনপ্রতিনিধিদের এহেন আচরণ জনগণ দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু স্বাধীনতার ঊষালগ্নে সে সুযোগ ছিল না। তখন সংবাদপত্রের অধিকার ছিল না আইনসভায় ভিতরে যা ঘটছে, তা লেখার। আইনসভার বিবরণী ছাপার ব্যাপারে মানহানির অভিযোগ থেকে সংবাদমাধ্যমকে সুরক্ষিত রাখাটা কতটা জরুরি, তা সেদিন ফিরোজ গান্ধী অনুভব করেছিলেন।
সংবাদপত্র যাতে কোনও রকম আইনি ভয় ছাড়াই স্বাধীনভাবে আইনসভার বিবরণী প্রতিবেদনে ছাপতে পারে তার জন্য তৎপর হন তিনি। ইতিমধ্যে ‘ফেডারেশন অফ ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট’ এবং ‘অল ইন্ডিয়া নিউজপেপার এডিটরস কনফারেন্স’ এমন দাবি জানিয়েছিল। ভারত সরকার দ্বারা নিয়োজিত প্রেস কমিশনের সুপারিশ এই অধিকারের পক্ষে ছিল। ফিরোজ অনুভব করেছিলেন, এই সংক্রান্ত বিল আইনে পরিণত হলে তার প্রভাব পড়বে শুধুমাত্র সংবাদপত্রের ওপর নয়, প্রভাব পড়বে গোটা দেশের গণতন্ত্র এবং সংসদীয় ধাঁচের সরকারের ওপরেও। ফলে প্রস্তাবিত বিলের খসড়া তৈরির সময় বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের থেকে মতামত গ্রহণ করেন। আইন মন্ত্রক, সাংবাদিক ও সম্পাদকদের বিভিন্ন সংগঠন এবং বেশ কিছু নামকরা সংবাদপত্রের সম্পাদকের কাছে গিয়ে তাঁদের মতামত নিয়েছিলেন তিনি। এই বিষয়ে তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘এই হাউস আমার বা আপনার নয়, এই হাউস জনগণের। আমরা প্রতিনিধিত্ব করছি ৩৬ কোটি মানুষের ইচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষাকে। তাদের হয়ে আমাদের কথা বলতে হবে এবং কাজ করতে হবে এই চেম্বারে। তাদের পছন্দের প্রতিনিধিরা এখানে কী বলছে, কী করছে তা জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। এক্ষেত্রে কোনও বাধা থাকলে তা দূর করতে হবে।’ সেই কারণে বিস্তারিতভাবে ভারতের আইনসভার পাশাপাশি ব্রিটিশ সংসদের বিবরণী প্রকাশের ক্ষেত্রে যেসব নিয়ম-বিধি রয়েছে, সেগুলি তিনি খুব ভালো করে পড়ে দেখেন। লক্ষ করেন, ব্রিটিশ সংসদের বিবরণী ছাপার ক্ষেত্রে আদালতের সিদ্ধান্তের দ্বারা ব্রিটিশ প্রেস তা ছাপার ব্যাপারে নীতি প্রণয়ন করেছে। এক্ষেত্রে বিখ্যাত মামলা রয়েছে ‘Wason Vs Walter’– যা ব্রিটিশ সংবাদ জগতের কাছে একেবারে যুগান্তকারী।
ফিরোজ সংসদকে জানিয়েছিলেন, ‘আপনারা দেখছেন, আর্টিকেল ১০৫(৩) মনে হচ্ছে সংসদের বিবরণী ছাপার ব্যাপারে সুরক্ষা দিচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে তা দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে, যা এর প্রকৃত অর্থ, আসলে তা এর মানে নয়। গ্রেট ব্রিটেনে সংসদের বিবরণী ছাপার সুবিধা আছে কিন্তু ভারতে তা নেই।’ তিনি তাঁর বক্তব্যের বিষয় প্রতিষ্ঠার জন্য তুলে ধরেন সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের একট মামলা।
বাংলা বিধানসভার সদস্য সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ‘লোকসেবক’ নামক একটি সংবাদপত্রের প্রকাশক। বিধানসভায় একটি ভাষণে তিনি এক ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে কুৎসা করেন এবং সেই কথা প্রকাশ করেন তাঁর সংবাদপত্রে। পরে তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হয়। কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হ্যারিস পর্যবেক্ষণ করে দেখেন, সংবিধানের দেওয়া নিরাপত্তা শুধুমাত্র আইনসভার সদস্যের জন্য প্রযোজ্য কিন্তু সেটা সংবাদপত্রে প্রকাশনায় প্রযোজ্য নয়।
ফিরোজ তাঁর যুক্তির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হাউসকে জানান, তাঁর অন্যতম সহকর্মী প্রেস কমিশনের সদস্য টি.এন. সিং-এর অভিজ্ঞতার কথা। পিটিআই সাংবাদিক কে রামচন্দ্রনের কাছে টি. এন. সিং জানতে চেয়েছিলেন, কেন তিনি সরল বিশ্বাসে বিবরণীর রিপোর্টিং করছেন না। তখন রামচন্দ্রন জবাবে জানান, ‘টি. এন. সিং মহাশয়, সংসদের সদস্য হিসেবে আপনি যেমন ইচ্ছে ভাষা প্রয়োগ করে ভাষণ দিতে পারেন, কিন্তু আপনি যে ভাষায় হাউসের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন, আমরা সেই কথাগুলি রিপোর্টে লিখব কেমন করে? সংবিধান আমাকে সেই অধিকার দেয়নি, যাতে আমি সংসদের ভিতরে হওয়া কথাগুলি একেবারে সত্যনিষ্ঠ হয়ে রিপোর্টে লিখতে পারব। আমরা সেই সুবিধাটা চেয়েছি আইনসভা থেকে, কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হয়েছি।’
এরই রেশ টেনে ফিরোজ বেশ কিছু উদাহরণ তুলে ধরেন যেখানে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম লোকসভায় আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কগুলি ছাপতে পারেনি। সংবাদপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রে এই বাধা সরাতে উদ্যোগী হন ফিরোজ গান্ধী। সেজন্য তিনি আইনসভার বিবরণী (প্রকাশনার নিরাপত্তা) বিল সংসদে আনেন। এই বিল তৈরি করতে গিয়ে ফিরোজ যেমন সংবাদ জগতের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তেমনই সংসদে এমন অনেকের সঙ্গে তিনি আলোচনায় বসেছিলেন, যাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন বিতর্কে ভিন্নমত পোষণ করতেন তিনি। যেমন, এন. সি. চট্টোপাধ্যায়। সংসদে তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন বিতর্কে মতবিরোধ হলেও এই বিখ্যাত আইনজীবীর পরামর্শ নিয়েছিলেন ফিরোজ বিলটির ব্যাপারে।
ফিরোজ খোলা মনে এই বিলের যাঁরা বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের বক্তব্য শুনেছিলেন। অথচ কংগ্রেসের পাশাপাশি আরও কয়েকটি দল যেহেতু বিলটিকে সমর্থন করেছে ফলে সহজেই বিলটি পাশ করানো যেত। তবুও ফিরোজ জোরাজুরি করেননি বিলটিকে পাশ করানোর ব্যাপারে, বরং সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি উঠলে তা মেনে নেন। তার কারণ, এই বিষয়ে ফিরোজ যতটা সম্ভব সব দলকেই যুক্ত করতে চেয়েছিলেন যাতে প্রকৃত অর্থেই এমন সংস্কারমূলক বিলটি সংখ্যাগরিষ্ঠতার বদলে সর্বসম্মত হতে পারে।
এরপর ওই বিল সিলেক্ট কমিটিতে যায়। কিছু সংশোধনের পর নয়া রূপে আইনসভার বিবরণী (প্রকাশনার নিরাপত্তা) বিলটি গ্রহণ করা হয় এবং ১৯৫৬ সালের ৪ মে তা পাশ করা হয়। গোটা ভারতজুড়ে, সংবাদপত্রে অভিবাদন জানানো হয়েছিল এমন আইন প্রণয়নের জন্য।
ইতিহাসের পাতা থেকে বিস্মৃত ফিরোজ গান্ধী (১২ সেপ্টেম্বর ১৯১২-৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬০) হলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর শ্বশুর, স্ত্রী এবং পুত্র– প্রত্যেকেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তবে তাঁর পরিচয় শুধু এতেই সীমাবদ্ধ নয়। আকর্ষণীয় ঘটনাবহুল তাঁর জীবন। তাঁর জন্ম, বিবাহ এবং মৃত্য ঘিরে বিতর্ক রয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়ে বারবার জেলে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে সংসদে এমন কেলেঙ্কারির উন্মোচন করেন, যার জন্য তাঁর নিজের দলকেও অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছিল। এলআইসিআই জাতীয়করণেও ফিরোজ গান্ধীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
গত সাত দশকের ব্যবধানে সংবাদের জগতে অনেক বিবর্তন ঘটেছে। জনগণের খবরের খিদে আর এখন শুধুমাত্র খবরের কাগজের ছাপা অক্ষর মেটায় না। ড্রয়িংরুমের টিভির পর্দা ছাড়িয়ে ঘরের বাইরে থাকাকালীন হাতের মুঠোফোনে সব খবর উঠে আসে জনগণের কাছে। কিন্তু সেই অধিকার একদিনে আসেনি। তবে তার প্রথম ধাপটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যা এসেছিল ফিরোজ গান্ধীর হাত ধরে। তিনি এমন উদ্যোগ নিয়েছিলেন শুধুমাত্র দেশের সাংবাদিকদের নিরাপত্তার কথা ভেবে নয়, তার পাশাপাশি সংসদে কী হচ্ছে, তা জানার স্বাধীনতা যাতে সাধারণ মানুষ পায় তার জন্যও।
…………………….
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন
…………………….
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved