‘একজন অনুবাদককে মূল ভাষার সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতেই হবে। তাদের আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি সম্পর্কে না জানা থাকলে অনুবাদ হয় না।’ বলছেন অরুণ সোম। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর দেশে ফিরেছেন। সোভিয়েতে বসে রুশ ভাষায় দস্তয়েভস্কি পড়েছেন, রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন শিশু সাহিত্য থেকে গোর্কি। প্রগতির অনুবাদক, রাদুগার অনুবাদক অরুণ সোম। ফিরে এসেও নিরলস চলছে অনুবাদ। এখন হাত দিয়েছেন দস্তয়েভস্কি অনুবাদে। যাঁর অনুবাদ পড়ে এ প্রজন্ম বড় হয়েছে, যাঁর অনুবাদ বিশ্বসাহিত্যের আলো-বাতাস দিয়েছে, বিশ্ব অনুবাদ দিবসে তাঁর সাক্ষাৎকার নিল রোববার.ইন। কথোপকথনে তিতাস রায় বর্মন। আজ প্রথম পর্ব।
আপনার অনূদিত কোন বইটি আপনার সবচেয়ে প্রিয়?
আমি শিশু সাহিত্য অনুবাদ করতে খুব ভালোবাসতাম। ওখানে থাকতে শেষ অনুবাদ করেছিলাম ‘আনাড়ির কাণ্ডকারখানা’, এটা করে আমার খুব ভালো লেগেছিল। ওখান থেকে ১৭টা খণ্ড বেরিয়েছিল। ১৩টা অনুবাদ করতে পেরেছিলাম। তারপর তো সোভিয়েত ভেঙে গেল। এই বইটা আবার বেরবে নতুন করে এখান থেকে। অরিজিনাল ছবিগুলো সব পেয়েছি। এটা খুব আনন্দের খবর। রাশিয়ান ক্লাসিকের মধ্যে তলস্তয় অনুবাদ করে আনন্দ হয়েছিল। তবে সবচেয়ে কঠিন দস্তয়েভস্কি। তলস্তয় তুলনায় অনেক সোজা। দস্তয়েভস্কির মূল যে চারটে বই, চেয়েছিলাম চারটেই অনুবাদ করব। ৩টে তো হয়ে গেছে, সাহিত্য আকাদেমি থেকে। শেষ বইটা এখন করছি। কিন্তু এই কঠিনটার মধ্যেই আমি সবচেয়ে আনন্দ খুঁজে পাচ্ছি। অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে। দস্তয়েভস্কি তো সহজ নয়, তাঁর অনেক ঘোরপ্যাঁচ, জটিল ভাবনাসূত্র। এখন যে শেষ বইটা করছি, সেটাই বোধহয় সবচেয়ে কঠিন।
কোন বইটা করছেন?
ইংরেজিতে দুটো নাম আছে। ‘দ্য পোজেজড’ বা ‘ডেভিল্স’। প্রচুর সময় লাগছে। প্রতিটা প্যারাগ্রাফ দু’বার করে পড়তে হচ্ছে। ওহ, আরেকটা বই অনুবাদ করে আনন্দ পেয়েছিলাম, সেটা হল বুলগাকভের ‘মাস্টার ও মার্গারিতা’। তবে এগুলো এখানে এসে করা। ওখানে ক্লাসিক অনুবাদের চল ছিল না খুব একটা।
মস্কোতে থাকতে কী ধরনের বই আপনাকে অনুবাদ করতে হত?
সাহিত্য ছাড়া একটা বড় অংশ ছিল আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক। যেহেতু ‘প্রগতি’র প্রতিষ্ঠাই হয়েছিল তাত্ত্বিক বই বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করার জন্য। এটা কোনও লাভজনক প্রতিষ্ঠান নয়, কতকটা প্রচারমূলক প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে একটা ভাগ ছিল শিশু ও কিশোর সাহিত্য। শিশু সাহিত্যের কারণই ছিল একটি শিশুকে ছোট থেকেই সাংস্কৃতিকভাবে বড় করা। শুধু তো আর্থ-সামাজিকভাবে নয়, সাংস্কৃতিকভাবেও একটা দেশকে জয় করা যায়! কিন্তু শিশু-কিশোর সাহিত্যে তো সেরকম কোনও প্রচার নেই। তাহলে কী ছিল, যার জন্য রুশ শিশু-কিশোর সাহিত্য এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল বিশ্বজুড়ে? আসলে এই বইগুলোর মধ্যে ছিল একটি মানবিক দিক, যা একটি শিশুমনে বড়সড় প্রভাব ফেলতে পারত। যা অভিভূত করে দিত পাঠককে। তুলনায় কম অনূদিত হত রাশিয়ান ক্লাসিক। আরও কম ছিল কবিতার ভাগ। কবিতা প্রায় অনুবাদই হত না, শিশু সাহিত্যে যে কবিতা ছিল, তা অনুবাদ হত শুধু। তখনকার দিনের ক্লাসিক কবিদের কবিতা আমাদের ভাষায় সেভাবে অনুবাদ হয়নি।
তখন ‘প্রগতি’র বাংলা বিভাগে কারা ছিলেন?
আমি যে সময়ে গেছি সেসময় দু’জন ছিলেন। ননী ভৌমিক এবং বিষ্ণু মুখোপাধ্যায়। প্রথমদিকে অনেকে গিয়েছিলেন। তবে তিন বছরের কনট্র্যাক্ট শেষে সবাই চলে এসেছিলেন। একমাত্র দীর্ঘদিনের জন্য থেকে গিয়েছিলেন ননীদা ও বিষ্ণুদা। প্রথমদিকে প্রগতিতে ছিলেন নীরেন্দ্রনাথ রায়, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সমর সেন। ননী ভৌমিক মূলত সাহিত্য আর রাজনৈতিক বিষয় অনুবাদ করতেন, বিষ্ণুদা আর্থ-সামাজিক। আমরা গেলাম সাতের দশকে, বাংলাদেশ হওয়ার পর। বাংলাদেশ থেকে ওখানে গেছিলেন হায়াত মামুদ। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমি আর মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়। পরে বাংলাদেশ থেকে এলেন দ্বিজেন শর্মা আর খালেদ চৌধুরী। ইনি আমাদের খালেদ চৌধুরী নন, ইনি বাংলাদেশের। প্রগতি থেকে একটাই কবিতা সংকলন বেরিয়েছিল, সেটা হায়াত মামুদ করেছিলেন। তখন সময় সেন ছিলেন ওখানে, ওঁর আক্ষেপ ছিল ওঁকে কবিতা দেওয়া হয়নি বলে। উনি এখানকার এত বিখ্যাত কবি, ওঁর মনখারাপ হয়ে গেছিল। কিন্তু ওখানে তো ৭০ শতাংশ প্রোপাগান্ডার বই, ৩০ শতাংশ সাহিত্য। ওদের তো উদ্দেশ্য ছিল প্রোপাগান্ডা। একটা মজার ব্যাপার ছিল। ওখানে যেহেতু কাজ অনুযায়ী টাকা, তাই অনেকেই প্রচুর প্রচুর অনুবাদ করতেন। সম্পাদকরা একদিন আমাদের ডেকে পাঠালেন, বললেন এত অনুবাদ হচ্ছে যে আমরা কূল পাচ্ছি না। অনেক ক্ষেত্রে মানও পড়ে গেছিল। অন্য বিভাগে শুনেছি কিছু অনুবাদককে শেষকালে খারিজ করতে হয়েছিল।
কতগুলো বিভাগ ছিল সেখানে?
ভারতীয় প্রায় সব ভাষারই বিভাগ ছিল। এমনকী, কাশ্মিরী ভাষারও বিভাগ ছিল। বিরাট একটা সংস্থা ‘প্রগতি’। মূলত রাজনৈতিক কারণেই অনুবাদে এই বিশেষ জোর দেওয়া। নয়তো ভেবে দেখো না, একটা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান কীভাবে এত কম দামে এতগুলো ভাষায় বই ছড়িয়ে দিল প্রায় গোটা বিশ্বে।
তারপর রাদুগা তৈরি হল কবে?
আটের দশকে রাদুগা তৈরি হল। রাদুগা শুধু সাহিত্যের জন্যই। প্রগতি থাকল প্রোপাগান্ডার জন্য। রাদুগাতে একমাত্র অনুবাদক হিসাবে আমাকে নেওয়া হল। অনেক সময় ছোটখাটো কাজগুলো অন্যরা বাইরে থেকে করে দিতেন। ননীদাও দু’-একটা অনুবাদ করেছিলেন।
আপনি বললেন যে, প্রগতিতে বই বাছাইয়ে আপনাদের কোনও ভূমিকা ছিল না। রাদুগা-তেও কি তাই?
কোথাওই সিলেকশনে আমাদের হাত ছিল না। দু’-একজন অনুনয়-বিনয় করে দু’-একটা পছন্দের বই অনুবাদ করতে পেরেছেন। তবে আমি সেটা কখনও করিনি। যদিও প্রগতিতে থাকতে সাহিত্যই বেশি করেছি। আমি একটু গোলমাল পাকাতাম বটে। বলতাম যে করব না। ওরা তাতে একটু হইচই করত। রাদুগাতে তো সেসবের বালাই নেই। গোটাটাই সাহিত্য।
যে বইগুলোর অনুবাদ হত, সেগুলো কি ওই দেশে জনপ্রিয় ছিল বলে অনুবাদ করা হত?
সবসময় তা নয়। একইসঙ্গে আমাদের মানসিকতাও মাথায় রাখা হত। আমাদের দেশে সেই বই অ্যাকসেপ্টেড হবে কি না, আমাদের সংস্কৃতি কেমন, ভাবা হত। আমাদের মনোমত বই না হলে আমরা আবার জিজ্ঞেস করতাম যে কেন এই বইটা বাছা হল। কে বেছেছে? বলত, ওপর থেকে বাছা হয়েছে। আমি বলতাম, সোভিয়েত ইউনিয়নে ভগবান আছে নাকি। এটা তো এখানে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু প্ল্যান কে করছে, জানতে পারতাম না। এটা একটা আক্ষেপ ছিল। এদিকে আমি ভেবেছিলাম ওখানে গিয়ে ক্লাসিক করব, সেটা তো হল না। শেষ ক্লাসিক ওখানে অনুবাদ করেছিলাম শোলখভ-এর চারটে খণ্ড। এখানে সব নিয়ে আসতে পারিনি সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর। চতুর্থ খণ্ডটি তো এসেই পৌঁছয়নি কলকাতা। এখন তো পাওয়াও যায় না আর। তবে, গোর্কি আর তুর্গেনিভ করেছি ওখানে বসে।
একজন মানুষ অনুবাদের সিদ্ধান্ত কেন নেয়? আপনি কেন অনুবাদের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?
বললে খুব অদ্ভুত শোনাতে পারে, কিন্তু যখনই ইংরেজিতে কোনও কিছু পড়তাম, মাথার মধ্যে খালি তার বাংলাটা খুঁজতে চাইতাম। কোনও শব্দ হতে পারে, কোনও এক্সপ্রেশন হতে পারে। রুশ শিখেও তাই করতাম। কোনও কোনও এক্সপ্রেশন হয়তো বাংলাতে এলই না। এরকম তো হতেই পারে কোনও একটা শব্দ বা এক্সপ্রেশন বাংলাতে নেই। বিশেষ করে ইউরোপিয়ান ভাষাগুলির ক্ষেত্রে। হিন্দি থেকে তো এই সমস্যাটা হবে না, কিন্তু বিদেশি ভাষার ক্ষেত্রে অনুবাদকরা এই সমস্যায় পড়বেনই। তাদের ভঙ্গিটাকে কীভাবে অনুবাদ করবে? তবে ইংরেজি থেকে এই সমস্যা কম। কারণ ইংরেজি গদ্যের প্রভাব আমাদের গদ্যে রয়েছে। জার্মান বলো, ফরাসি বলো, এগুলো থেকে অনুবাদ করা কঠিন।
হঠাৎ রুশ ভাষা শেখার কথা ভাবলেন কেন?
রুশ ভাষার চর্চার কথা ভাবি যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। সেসময় আমাদের দেশে অন্যরকম একটা রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল– বামপন্থী রাজনীতির। বামপন্থী আন্দোলনের একটা অবদান ছিল এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেপথ্যে। তখন কয়েকটা জায়গাতেই রুশ ভাষা সেখানো হত, আমি শিখি ভারত-সোভিয়েত সংস্কৃতি সমিতি। আমি সবসময়ই ভাবতাম কেন রুশ থেকে ইংরেজি হয়ে আমাদের ভাষায় অনুবাদ করা হবে। রুশ ক্লাসিক সাহিত্য পড়তে পড়তে মনে হত সরাসরি রুশ ভাষাতেই যদি পড়তে পারতাম সেই সাহিত্যগুলো। নিজের জন্য পড়া এবং আমাদের পাঠককেও সেই সুযোগ করে দেওয়ার ইচ্ছে থেকেই আমার রুশ ভাষা শেখা। রুশ সাহিত্যের যে মানবিক দিক, তা আমাকে বরাবর টানত। তাছাড়া এই ভাষা তো বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভাষা। রুশ ভাষার সাহিত্যিক– তুর্গেনিভ বলো কি গোর্কি কি দস্তয়েভস্কি– এত বড় মাপের সাহিত্যিক বিশ্বসাহিত্যে কমই আছে।
আমাদের প্রজন্মও আপনাদের কল্যাণে রুশ সাহিত্য পড়ে বড় হয়েছে। আপনার ছোটবেলায় আপনি কী কী বিদেশি সাহিত্য অনুবাদে পড়েছিলেন, কার কার অনুবাদ পড়তেন?
ছোটবেলায় সেসব ক্লাসিক পড়েছি অনুবাদে, সেখানে গ্রিক সাহিত্য, ফরাসি সাহিত্য, ইতালীয় ক্লাসিক ছিল অনেকটা জায়গা জুড়ে। কিন্তু সেগুলো ছিল সংক্ষিপ্ত অনুবাদ। আমাদের সময় ছিল হেমেন্দ্রকুমার রায়, দীপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, সুধীন্দ্রনাথ রাহা-র অনুবাদ। সেগুলোকে আমি অনুবাদ বলব না। এগুলো ছিল স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য সংক্ষিপ্ত করে লেখা। বিদেশি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করানো ছিল মূল উদ্দেশ্য। তখনও মনে হয়েছিল, এগুলো তো সব সংক্ষিপ্ত। পরবর্তীকালে যখন রুশ ভাষা শিখলাম, ক্লাসিকগুলো পড়লাম, আরও বেশি করে মনে হল এগুলোর সরাসরি পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ দরকার। তখন থেকেই আমার ইচ্ছে তৈরি হল। কিন্তু আমাদের দেশে তো সে সুযোগ নেই। এখানকার প্রকাশকরা ভাবানুবাদ প্রকাশ করছে। কিন্তু এই চিন্তাটা আমার মাথায় থেকেই গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে স্কুল-কলেজে পড়াচ্ছি বটে, কিন্তু অনুবাদ করব, ঠিক করে নিয়েছিলাম।
এখানে আপনার রুশ শিক্ষকের সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।
আমি তো শিখেছি ভারত-সোভিয়েতে, সেখানে পড়াতেন একজন ভদ্রমহিলা। তিনি ছিলেন শরণার্থী। রাশিয়া থেকে এসেছিলেন স্বামীর সঙ্গে। আমি তখন পার্ক সার্কাসে থাকতাম, তিনি আবার আমার প্রতিবেশীও ছিলেন। অনেক সময়ই আমি তাঁর বাড়িতে গিয়ে গল্প করতাম। ফলে মৌখিক রাশিয়ানও আমি রপ্ত করে ফেলেছিলাম। ওদের বাড়িতে আমি নিয়মিত রাশিয়ান খাবারও খেতাম। রাশিয়ার সঙ্গে অন্য একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তখন এদেশে আবার ফিল্ম স্ক্রিনিং হত, যেখানে রাশিয়ান সিনেমা দেখানো হত। আমি সেগুলো দেখতে যেতাম। রাশিয়ান সংস্কৃতি আমি একটু একটু করে আয়ত্ত করছিলাম এখানে থেকেই। সেসময় আমরা এখানে যে ক’জন রুশ ভাষা শিখতাম, তারা একটা সংস্থাও তৈরি করেছিলাম। সেটা দিল্লি বেস্ড। সেখান থেকেই ঠিক হয়েছিল যে প্রত্যেক বছর দু’-একজনকে রাশিয়া পাঠানো হবে। ফেন্ডশিপ ফেলোশিপ। একসময় আমিও সেই সুযোগ পেলাম। সেটা ১৯৬৫ সাল। মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে একবছরের ফেলোশিপ। সেসময় প্রগতিতে ছিলেন ননী ভৌমিক। ননী ভৌমিক ভারতে বিশাল একটা নাম, বড় মাপের সাহিত্যিক। তাঁর নাম শুনেছি, কিন্তু তাঁর সঙ্গে আলাপ করার ভরসা হয়নি কখনও। মস্কোতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ হল। আমি ননীদাকে বলেছিলাম, যদি মস্কোতে কোনও সুযোগ পাওয়া যায় অনুবাদ করার, তাহলে আমার কথা যেন মনে রাখেন। উনি মনে রেখেছিলেন আমার কথা। তারপর অনেক বছর কেটে গেল। মাঝে দু’বার আমি সোভিয়েত ইউনিয়ন গেছি একমাস একমাস করে আন্তর্জাতির রুশ শিক্ষক সম্মেলনে। শেষবার ননীদা বললেন যে, একজন লোক নেওয়ার কথা হচ্ছে। আমি যেন অপেক্ষা করি।
তারপর শেষমেশ যাওয়ার অবকাশ কীভাবে পেলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে?
তখন বাংলাদেশ সদ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হয়ে উঠল, মর্যাদা বৃদ্ধি হল এই ভাষার। এর প্রভাব প্রগতিতেও পড়ল। আরও কিছু অনুবাদকের দরকার হল। ননীদা একবার এলেন কলকাতায়। এসে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। আমি তখন একটা কলেজে পড়াচ্ছি। বললেন, একটা স্যাম্পেল অনুবাদ জমা দিতে। বলেছিলেন, দেওয়ার আগে একবার ওঁকে দেখিয়ে নিতে। নির্বাচিত হলাম আমি। সব ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। নির্বাচিত হয়েছিলেন মঙ্গলাচারণ চট্টোপাধ্যায়ও। তিনি অবশ্য ইংরেজি থেকে অনুবাদ করতেন। অনেকের ধারণা প্রগতিতে থেকে যে অনুবাদগুলো বেরত, সেগুলো সব রুশ থেকে। কিন্তু রুশ থেকে হাতেগোনা কয়েকজন অনুবাদ করতেন। যাঁরা প্রথমদিকে শুরু করেছিলেন, তাঁরা কিন্তু সব ইংরেজি থেকে। কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সমর সেন-রাও ইংরেজি থেকে অনুবাদ করতেন। ননীদাও শুরুতে ইংরেজি থেকে করতেন। পরে ওখানে থেকে রুশ শিখে, রুশ থেকে অনুবাদ শুরু করলেন। মূল রুশ থেকে মেলানোর জন্য সম্পাদক ছিলেন। তাঁরা মোটামুটি বাংলা জানতেন, রুশদেশীয় মানুষ। তাঁরাই সরাসরি রুশ থেকে বাংলাটা মিলিয়ে নিতেন, সম্পাদনা করতেন। এই সম্পাদকদের বাংলা জানতেই হত। তাঁরা যেহেতু বাঙালি নন, তাই তাঁরা মাঝে মাঝে বিদঘুটে প্রস্তাব দিয়ে বসতেন। ফলে একটা অনুবাদ হলে অনেকগুলো মিটিং হত সম্পাদক ও অনুবাদকের মধ্যে।
পড়ুন সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব: ক্লাসিক অনুবাদ করে কিন্তু বদল আনা যায় না
আপনি তো মূল রুশ থেকে অনুবাদ করছেন, আপনার সঙ্গে এগুলো হত?
আমার সঙ্গে এরকম মতানৈক্য কমই হয়েছে। তবে সম্পাদকের সঙ্গে তর্ক তো হতই।
সেসময় কলকাতার থেকেও তো অনেক অনুবাদ হত?
হ্যাঁ। কলকাতা থেকেও কিছু অনুবাদ হত। সেগুলো ইংরেজি থেকে। যেমন ‘মা’ উপন্যাসটা। ওটা অনুবাদ করেছিলেন পুস্পময়ী বসু। উনি সোভিয়েতে কোনও দিন যাননি। অনুবাদগুলো এখান থেকে ওখানে যেত, ওখানকার সম্পাদকরা সেগুলি সম্পাদনা করতেন।
আপনি প্রথমবার যখন গেছিলেন সোভিয়েত, জানতেন এত বছর থেকে যাবেন যে?
প্রথমবার আমি গেছিলাম তিন বছরের কনট্র্যাক্ট নিয়ে। তারপর সেটা রিনিউ হল আরও দু’বছরের জন্য। দুই কি তিন বছর বাদে একবার করে দেশে আসার জন্য ছুটি মিলত, দু’-তিন মাসের জন্য। বন্দোবস্ত ওরাই করত, ভাড়া ওরাই দিত। আমি এটুকু জানতাম যদি ঠিকমতো কাজ করি, তাহলে নিশ্চয়ই থেকে যাব। যেভাবে বিষ্ণুদা, ননীদারা থেকে গিয়েছিলেন। বিষ্ণুদা রিটায়ার করেছিলেন ওখান থেকেই। আমার আরও অনেক কাজ করার ছিল। অনুবাদের কাজটাই তো করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের দেশে সে সুযোগ নেই। চেয়েছিলাম সোভিয়েতেই থেকে যেতে। আমার কনট্র্যাক্ট রিনিউ হতে থাকল আর আমিও ওদেশের সঙ্গে জুড়ে গেলাম। তারপরে তো ওখানে আমার পরিবারও হয়ে গেল। আর যে সমস্ত আর্থ-সামাজিক সুযোগ-সুবিধাগুলো ছিল, সেগুলো তো আর কোথাওই পেতাম না। আমার চিকিৎসা ব্যবস্থা, আমার মেয়েদের লেখাপড়া সবই তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল। টাকা পয়সার জমানোরও কোনও ব্যাপার ছিল না। রিটায়ার করলে পেনশন পাব জানতাম। একটা নিশ্চিতির মধ্যে ছিলাম। সে জন্য আর ভাবিনি যে চলে আসতে হবে।
আপনার মতে, অনুবাদকের কোন গুণটা থাকাটা আবশ্যিক?
একজন অনুবাদককে মূল ভাষার সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতেই হবে। সেই দেশের ভেতরে ঢুকতে হবে। শুধু ভাষা জানলে হবে না। সেই দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য জানতে হবে। দেশের মানুষকে জানতে হবে। তাদের আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি সম্পর্কে না জানা থাকলে অনুবাদ হয় না।
তার মানে, রুশ দেশে থেকে আপনার অনুবাদ আর এদেশ থেকে যে অনুবাদ হচ্ছে, তার মধ্যে তফাত রয়েছে।
অনেক তফাত, অনেক। ভাষার ব্যঞ্জনা, নুয়ান্স এগুলো তো এখানে থেকে ধরতে পারছেন না তাঁরা। এ কথা আমি বলছি না যে, আমাদের ভাষায় সেগুলো সবসময় ট্রান্সফার করা যায়। কিন্তু অনুবাদককে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। একটা বিকল্প তাকে বের করতেই হবে। ধরো ওখানকার কোনও ধ্রুপদী সংগীত, ধরো নাইন্থ সিম্ফোনি। আমাদের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্কই নেই। আমাকে সেক্ষেত্রে ওটা রাখতেই হবে। বা একটা নাচের ভঙ্গিমা। সেটা ভাল্স বা মাজুরগা হতে পারে। আমি সেক্ষেত্রে ভারতনাট্যম ব্যবহার করব? সেটা তো সম্ভব না। আমাকে মূলটা রাখতেই হবে। আশা করি, পরবর্তীকালে পড়তে পড়তে পাঠকের একসময় আর অসুবিধা হবে না। তাঁরা ধরতে পারবেন।
অনুবাদের প্রভাব কি সেই ভাষায় এসে পড়ে?
অবশ্যই। কারণ মস্কোতে যে সমস্ত অনুবাদ হয়েছে, বা আমরা যে সমস্ত অনুবাদ করেছি, আমরা দেখেছি এমন কতগুলো এক্সপ্রেশন আছে, যেটা বাংলায় আগে ছিল না, তা বাংলায় এসে গেছে। যেমন, ‘ভোরেরা এখানে শান্ত’। ‘ভোরেরা’ তো বাংলায় হয় না। কিন্তু এ তো সুন্দর লাগছে। এটা হল রুশি ভাষার প্রভাব, যা বাংলা পেয়েছে।
রুশি থেকে বাংলায় অনুবাদ করতে কী কী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন?
আমাদের বাংলা ভাষার এমন বাক্য বিন্যাস, যেখানে অনুবাদের ক্ষেত্রে অসুবিধা হয় মূলত ক্রিয়াপদে। বাংলার থেকে রুশিতে ক্রিয়াপদ বেশি। এদিকে ক্রিয়াপদ বেশি ব্যবহার করলে ভাষাটা কীরকম একটা হয়ে যায়। হল, গেল, থাকল– বারবার এগুলো এসে যায়। ফলে অনুবাদের সময় আমাদের অনেক সময়ই ক্রিয়াপদ অ্যাভয়েড করে যেতে হয়। আরেকটা জিনিস হল, রুশিরা খুব কমপ্লেক্স সেনটেন্স ব্যবহার করে। একটা একটা সেনটেন্স প্রায় এক পৃষ্ঠা। সেই জটিল বাক্য যদি তুমি ভেঙে ভেঙে করো, তাহলে সমস্যা হল লেখকের চিন্তন প্রক্রিয়াকে ভেঙে দেওয়া। লেখকের তো একটা থট প্রসেস রয়েছে। আমি বাক্যটা ভেঙে দিলে লেখকের চিন্তাটাকেই ভেঙে দেব। সুতরাং আমাদের যতদূর সম্ভব, যতই জটিল বাক্য হোক, আমাদের কিন্তু ওই বাক্য বিন্যাস রাখতেই হবে। কিছু ভাঙতে পারি, কিন্তু একেবারে ভেঙে দিলে মূল টেক্সটাই আর থাকবে না। যেমন ধরো, গোগোলের বিখ্যাত লেখা ‘ওভারকোট’। সেখানে একটা পৃষ্ঠা একটা বাক্য। আমি কিন্তু অনুবাদ করার সময় যতটা সম্ভব সেটা রাখার চেষ্টা করেছি। এবার লোকের পছন্দ না-ও হতে পারে। কিন্তু ওটাকে আমি ভাঙিনি। লেখকের থট প্রসেসকে ছিন্নভিন্ন করিনি। সেটা করা উচিত নয়। আর একটা বিষয় আছে, সর্বনামের ব্যবহার। ইংরেজিতে তো সবই ‘ইউ’। ইউ মানে ‘তুই’, ‘তুমি’, ‘আপনি’ সবই হতে পারে। রুশিতে ‘তুমি’ আছে, ‘আপনি’ আছে। তাতে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ ‘তুই’ নেই। ‘আপনি’ শব্দটা আবার ‘আপনারা’ও হতে পারে। আবার সেই কনটেক্সটে যেতে হবে। আমি যতদূর চেষ্টা করেছি মূলের কাছে থাকার। সেটা কতদূর সম্ভব হয়েছে জানি না। একটা শব্দ নিয়ে ভাবতে কয়েকটা দিন কেটে গেছে, এমনও হয়েছে। সমস্ত বইটা একাধিকবার পড়েও অনেক সময় কূল পাওয়া যায় না। এখনও দু’-তিনটে বই রয়েছে, তার শিরোনাম এখনও মাথার ভেতরে ঘুরছে।
(চলবে)
পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কথা বলতে বলতে তাঁর অশ্রুসজল চোখ দেখে শুধু সেই সময় নির্বাক হয়েছিলাম তা’ নয়, আজও তাঁর সেই চোখ দেখতে পাই, শুনতে পাই মানুষের প্রতি মানুষের বর্বরোচিত অত্যাচারের সেই গল্প বলতে বলতে তাঁর রুদ্ধ কণ্ঠস্বর।