Robbar

শ্মশানের সঙ্গে বৈরাগ্যের কোনও সম্পর্ক নেই, তবুও প্রবাদের মতো সত্য শ্মশান-বৈরাগ্য

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 19, 2025 8:41 pm
  • Updated:October 19, 2025 9:56 pm  

অত যে সুন্দর চিতা সাজিয়ে মুখখানি সপ্রকাশ করে রেখেছে, এবং আলতা-মাখা ‘চরণারবিন্দেষু’, করে রেখেছে চরণস্পর্শ করার জন্য। আমি মায়ের মুখাগ্নি করে মায়ের চরণ ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আত্মীয়স্বজনেরা আমারে সরিয়ে নিয়ে গেলেন খানিক ফাঁকে। একান্ন বছরের মা, তেরো-চোদ্দো বছরের কনিষ্ঠ পুত্র। দাহকার্য দেখছি। পুরোটা দেখছি। পুরোটা দেখবি? পুরোটা দেখছি।

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

ছোটবেলাই বটে– আমি তখন ক্লাস নাইন। আমার মা মারা গেলেন এবং দৈববশত আমাকেই তাঁর মুখাগ্নি করতে হল, অপিচ তাঁর শ্রাদ্ধেরও দায় আসল আমার ওপর। সেটা অবশ্য এখানে কথা নয়। কথাটা হল শ্মশান, এবং সেটা কেওড়াতলা শ্মশানের অভিজ্ঞতা। আমার মায়ের কারণে সেই শ্মশানে যাওয়ার অভিজ্ঞতাই আমার শ্মশানে যাওয়ার প্রথম অভিজ্ঞতা নয়। কারণ আমি থাকতামই টালিগঞ্জ রোডের এমন একটা জায়গায়, যেখান থেকে কেওড়াতলা শ্মশান ছিল বড়জোর একশো মিটার। সেটা ১৯৫৭ সালের গোড়ায়, আমরা তখন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের পাবনা জেলা থেকে নতুন একটা ভাড়াবাড়িতে এসে উঠলাম শ্মশানের কাছে। বাড়িতে প্রবেশ করার প্রথম রাত্রেই টের পেলাম শ্মশান কাকে বলে! আমার বয়স তখন ছয় পেরিয়ে কেবল সাতে।

সামনে একটা উনুন জ্বালা থাকলেই গনগনে কয়লার আঁচ যেমন পাশ থেকেই পাওয়া যায়, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি দূর থেকে ওই আঁচ পাওয়া যায় যদি শুকনো ডাল-পালা দিয়ে পথের ধারে আগুন জ্বালিয়ে শীতের রাতে আগুন জ্বালাই। কিন্তু শ্মশান আগুন ঠিক এমন নয়। শ্মশানের একটা চুল্লিতে আগুন জ্বললে তার আঁচ পাওয়া যায় শব্দভেদি চিৎকারে। নতুন বাড়ির প্রথম রাতে এমনিতেই ঘুম আসতে দেরি হয়েছে। তার মধ্যে মধ‌্যরাতের গভীরে যখন ‘আঁখিপরে শ্রান্ত ঘুম’ নেমে এসেছে, তখন একটা চিল-চিৎকারে সকলে সভয়ে একসঙ্গে হঠাৎ ঘুমন্ত বিছানা ছেড়ে বসে পড়লাম এবং পুনরায় সেই চিৎকার শুরু হল– বলো হরি, হরি বোল।
তখনই বুঝিনি, কিন্তু পরে বিলক্ষণ বুঝেছি, বিশেষত শীতকালের সন্ধ‌্যায় স্পষ্ট মালুম হত কেওড়াতলা শ্মশানে একটা চুল্লির আঁচ এমনই যে সেই টালিগঞ্জ ব্রিজের ওপার থেকে ‘বলো হরি, হরি বোল’-এ আগুন পোয়ানোর অনুভূতি শব্দ-চিৎকারে ভেসে আসত কানে। রাত্রির অন্ধকারে এই যে অন্তিমের সাংকেতিক চিৎকার, যেটা পরবর্তী সময়ের বিশ্লেষণে বুঝেছি– এটা শ্মশান যত নিকটবর্তী হত, ততই চিৎকারের ছন্দ মন্দাক্রান্তা থেকে ক্রান্তা থেকে ত্বরিত গতিতে পৌঁছত। দিনের পর দিন দিনে-রাতে এই মরণ-ধ্বনি শুনতে শুনতে আমরা সকলেই অভ্যস্ত হয়ে গেলাম হরিবোল ধ্বনিতে। ততদিনে সকাল থেকে রাত দশটার মধ্যে অনেক মৃতদেহের অন্তিম যাত্রা দেখে ফেলেছি এবং ততদিনে কেওড়াতলা শ্মশানের অন্তর-বাহির দুই দেখা হয়ে গেছে আমার।

তখন স্কুলে ভর্তি হয়ে গিয়েছি! আট বছর বয়স হয়ে গেছে। আমার আঞ্চলিক সেই স্কুলেই আমার এক পরম বন্ধু ছিল, তার ডাকনাম বুনো। বুনোর বাবা ছিল কেওড়াতলা শ্মশানের অন‌্যতম ডোম।

অতএব বুনোর হাত ধরেই আমার প্রথম কেওড়াতলা শ্মশানে যাওয়া। প্রথম ১৯৫৮ সালে, তখনও আমরা ইলেকট্রিক চুল্লি দেখিনি এবং জনসংখ্যাও এমন ছিল না, যাতে এমন অনুভব হয় শ্মশানের সামনের রাস্তা থিকথিক করছে, চেতলার ব্রিজ তখন কাঠের রিকশা-সাইকেল বড়জোর। গাড়ি নয়।

তবে হ্যাঁ, একেবারে থিকথিক না করলেও এই শ্মশান-সংলগ্ন পাড়াগুলিতে মানুষের সংখ্যা তুলনায় অনেক বেশি– কারণ, পাশেই মহাতীর্থ কালীঘাট এবং শ্মশানের রাস্তা পেরলেই যে বাজার, তার নাম ‘রিফিউজি মার্কেট’– এই নাম থেকেই মালুম হবে যে, এখানকার চারদিকের জনবসতির অধিকাংশের চরিত্র কী এবং সেই চরিত্রের অংশবিশেষ ছিলাম আমরাও।

যাই হোক, রাস্তাঘাটে জনমানব যতই থাকুক, বুনোর হাত ধরে কেওড়াতলা শ্মশানের, ওই সরু পথটাও বেশ ছমছমে লাগত। সারা প্রবেশপথে বিশাল-বিশাল মাধবীলতার ঝোপ ওপরে বাঁকানো শিঁকের মাঝখান নেমে এসেছে মাঝে মাঝেই। সেই লতাগাছির ডগা একটা মাথায় লাগতেই মনে হল যেন কোনও ভূতের টোকা। আমি সন্ত্রস্ত হলেও বুনোর কিন্তু ভয় ছিল না। ও অবশ্য আমার থেকে প্রায় দু’বছরের বড় ছিল। আর একটু এগোতেই দেখলাম– একটা লোক ওই আট-ফুটি সরু গলির একপাশে টানটান লম্বা হয়ে একটা লাল-পাড় সাদা শাড়ি মুড়ি দিয়ে ঘুমচ্ছেন। ওরকমটা দেখেই আমি বুনোর কাঁধে হাত দিয়ে অতি-ঘনিষ্ঠ হলাম পুনরায়।

বুনো দেখলাম অনেক সপ্রতিভ এবং প্রগলভও বটে। বলল– কোনও ভয় নেই। এ-লোকটা পয়সা কুড়োয়। ও সারারাত জেগেছে। এখন বেলা দশটার পরে ওর ছুটি, তাই ঘুমচ্ছে। ভয় নেই, চ। আমি দেখলাম– দিনের বেলায় অন্তত সাত-আটটা বুনোর বয়সি ছেলে বহুদূর থেকে মরার সামনে যে লোকটা খই আর পয়সা ছিটোতে-ছিটোতে যায়, তাকে সামনে রেখে পিছনে হাঁটছে। আর যেই না লোকটা হাত দিয়ে একটা দূরত্বের ‘টিপ’ করে খই-পয়সা ছুড়ত, সঙ্গে সঙ্গে ছেলেগুলো ‘আবাউট টার্ন’– ফুটো পয়সা, এক-আনি, দুয়ানি– রাস্তায় ঝাঁঝরিতে গলে যাওয়ার সাহস পাবে না, ছেলেগুলোর পায়ের বুড়ো আঙুলের চাপে হাতের মুঠোয় এসে যাবে।

বুনোর অনেক অভিজ্ঞতা, জীবন ব্যাপারটা ও মৃত্যুর চোখ দিয়ে দেখেছে ওর বাবার কল্যাণে। ও বলল– এই লোকটাকে তুই বাইরে ওই পয়সা-কুড়োনো ছেলেদের মধ্যে দেখিসনি। কেননা ওই ছেলেগুলোর দৌড় ওই ‘মোমের’ বাগান পর্যন্ত, তারপরেই এই শ্মশানের গেটে তুমুল কেত্তন, তুমুল ‘বলো হরি’, তুমুল খই-পয়সা। ওই পয়সা একটা একটা করে তুলে নেবে এই লোকটা। বড় ঠোঙায় খই ছড়াতে-ছড়াতে এলে তামার পয়সা, একানি, দুয়ানি তলায় পড়ে যায়। মরা-পার্টি যতই উঁচুতে ঝাঁকিয়ে তুলুক পয়সা, কিন্তু পয়সা নীচে নামবেই। আমার বাবা বলে, ‘পয়সা নিজেও নীচে নামে, অন্য লোককেও নীচে নামায়। নইলে কায়েতের ছেলে হয়ে এতগুলো ডোমের সঙ্গে কাজ করি!’

বুনোর বাবার এই উক্তি আমার সেই বয়সে বোঝার উপায় ছিল না। যাই হোক, শ্মশানে পূর্ণ প্রবেশের পর যে দৃশ্য চোখে পড়ল, সেটা আমার শৈশব কল্পনার বাইরে ছিল। দেখলাম– একটা চিতা দাউদাউ করে জ্বলছে এবং অন্য একটির আগুন সমস্ত কাষ্ঠখণ্ডগুলিকে পুড়িয়ে এমন খাঁক করে দিয়েছে যে, সমস্ত কাঠগুলোই যেন সাবয়বে লালে লাল আগুন হয়ে আছে। একটা অনির্দিষ্ট রেখায় আঁকা আয়তক্ষেত্র আগুন-ভাঙা চৌচির মোটা মোটা রক্তবর্ণ কাষ্ঠখণ্ডের আকার-মাত্র গ্রহণ করে ঈষৎ উঁচু এক গনগনে অগ্নিকুণ্ড হয়ে আছে। সেই চিতার পাশে একটি অতি-প্রৌঢ় লোক একটা বড় বাঁশের লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুনো বলল– ওই আমার বাবা, ওই চিতাটা হয়ে এসেছে, একটু পরেই বাবা ওই ‘আংরা’ থেকে ‘নাই’ বার করে আনবে। ওটাই বাবার কাজ এখানে। ‘অন্তপক্ষে’ পার্টি ভালো হলে চল্লিশ টাকাও পেয়ে যেতে পারে।
আমার ওই বয়সে জ্বলন্ত অঙ্গার থেকে ‘আংরা’ শব্দের উৎপত্তির ইতিহাস বোঝা সম্ভব ছিল না। ফলে সভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম– এই কথাগুলোর মানে কী। বুনো তার বাবার সৌজন্যেই সব জানে। ও বলল– আসলে একটা মরা চিতেয় উঠলে আমার ভাগে থাকে মরার নাই থেকে থেকে খুলি পর্যন্ত। মরা পুড়তে থাকলে যে কত রকম হয়! ধর, ওই যে মরাটা পুড়ছে– বুনো ওই দাউদাউ করে জ্বলা চিতাটির দিকে আঙুল দেখিয়ে আমাকে প্রায় টেনেই নিয়ে গেল চিতাটার দিকে। কিন্তু সেই জ্বলন্ত চিতার যে দিকটায় মৃতের আত্মীয়-স্বজন দু’-চারজন দাঁড়িয়ে ছিল, তার উল্টো‌ দিকে নিয়ে গিয়ে জ্বলন্ত কাঠগুলোর একটা দিকে ইঙ্গিত করে আমাকে বলল– কাঠের ফাঁক দিয়ে ভালো করে নজর দিয়ে দ‌্যাখ– অত আগুনের মধ্যে ভালো করে দেখাও যায় না। কিন্তু যতটুকু দেখা যায়, তাতেই শিউরে উঠলাম। দেখলাম– মাথাটার ওপরে কপালের, গালের মাংস পুড়ে গিয়ে নাকের সাদা হাড় বেরিয়ে পড়েছে, ঠোঁট নেই, কান নেই, চোখের জায়গায় রাঙা আগুনের কাঠের টুকরো পড়ে আছে, শব্দ হচ্ছে কাঠের সঙ্গে শরীরের চর্বির আগুন-মেশা, চড়-চড়-চটাস। বীভৎস দৃশ্য। আমি আর থাকতে না পেরে বললাম– শিগগির চল এখান থেকে। বুনো আমাকে সরিয়ে নিয়ে গেল ওখান থেকে, কিন্তু আমাকে বেশ ভালো করে চেপে ধরে খানিক অন্যদিকে নিয়ে যেতেই একটা ‘সাড়ে তিন ফুট বাই ন’ফুট’ আয়তক্ষেত্রাকার সামান্য এবং অগভীর কালচে মাটির অবস্থান দেখতে পেলাম। তার পাশেই কতগুলি লোক মোটা-মাঝারি-বিভিন্ন বৃত্তের কাঠ– সব যে খুব শুকনো তাও নয়– সব কাঠ এনে ফেলল ওই এবড়োখেবড়ো আয়তক্ষেত্রের পাশে। বুনো বলল– নতুন মরা চাপবে এখানে। পুরো কাঠ এসে গেলেই চিতা সাজানো হবে, দেখবি? পুরোটা দেখবি? ওই দ‌্যাখ মরাটা ওই ওদিকে ওই শানের চাতালে রয়েছে। একেবারে ‘রেডি’ মরা। ওর মরণপিণ্ডি হয়ে গেছে। দেখবি? চিতা সাজানো অত সহজ নয়, চিতের ওপর মরা চাপিয়ে ‘বডি’-র ওপরেও কতগুলো মোটা-মোটা কাঠ চাপানো হবে।

অদূরে চেয়ে দেখলাম– একটি শবদেহ। চাদর দিয়ে কণ্ঠ পর্যন্ত ঢাকা। আশপাশে যাঁরা বসে আছেন বা দাঁড়িয়ে আছেন– কতগুলি ভাবলেশহীন মুখ– এখন বুঝি, তাঁরা সেই প্রয়াত লোকটির খুব ঘনিষ্ট আত্মজন ছিলেন না। যাই হোক, আমি আর কিছুই দেখতে চাইলাম না। বুনো বলল– ওই দ্যাখ, আমার বাবা এবার ওই আংরা থেকে ‘নাই’টা বের করবে। দেখবি চ। আমি তাও দেখতে চাইলাম না। তখন শুধু বাড়ি ফিরতে চাইছি। বুনো তবু সোৎসাহে বলল– ‘নাই’ ব্যাপারটা বুঝিস তো– ওটা হল মানুষের নাভি। যত আগুনেই পোড়া, মরা পুড়ে খাঁক হয়ে যাবে, তবু ‘নাই’ পুড়বে না। আমি তবু কোনও ঔৎসুক্য দেখালাম না এবং কেওড়াতলা শ্মশানের আরও একটা গেট, যেটা তখনকার দিনেও অলিখিতভাবে ‘exit-gate’ হিসেবে পরিচিত ছিল– সেখান দিয়ে বেরিয়ে আসার সময়েও আরও আশ্চর্য হয়ে দেখলাম– বিশাল একটা কাঠের গুদাম– রাশি রাশি কাঠের গুড়ি– মোটা, মাঝারি গাছের ডাল– সামনে একটা বিরাট দড়ি-ঝোলানো দাঁড়িপাল্লা– কাঠের মাপ হচ্ছে। একটা শবদেহ সম্পূর্ণ ভস্মে পরিণত করতে কত মণ কাঠ লাগে কে জানে! অন্তত বুনোর কাছে আর জিজ্ঞাসা করতে চাইনি।

বিনা কোনও জিজ্ঞাসাতেই সেই আট-ন’বছর বয়সে যে বাস্তব অভিজ্ঞতা হল, সেটা যতটা ভয়ের ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি বীভৎস ছিল। লক্ষণীয়– বুনোর ভাষা এবং ভাষ্য। ও যে আমার সঙ্গে শ্মশানে গেল, ওর বাবারও ওকে দেখেছে, বুনোও দেখেছে ওর বাবাকে। কিন্তু ওর বাবারও কোনও জিজ্ঞাসা ছিল না, বুনোরও তেমনই। হয়তো বা এগারো-বারো বছর বয়সেই মৃতদেহ দেখতে দেখতে, শ্মশানে দাহকার্য দেখতে দেখতে অথবা ওর বাবার কাছে দাহকার্যের বিপুল বর্ণনা শুনতে শুনতে অদ্ভুত একটা নিরাসক্তি বুনোকেও এক বোধলেশহীন দার্শনিকে পরিণত করেছিল।

সেদিনের পর আরও অনেকবার শ্মশানে গিয়েছি– অভিজ্ঞতা হয়েছে আরও কষ্টকর। বিধবা রমনীর কান্না, অল্পবয়সি ছেলের জন্য মায়ের কান্না, বড়লোকের পো– যে নাকি দামি খাটে চড়িয়ে সধবা মাকে বেনারসি পরিয়ে, অজস্র ফুলশয্যায় কারুকার্য করা দু’পাশে কোলবালিশ দিয়ে, অবশেষে দাহকার্য শেষে চার-চারজন ডোমের সঙ্গে ঝগড়া করছে পয়সা নিয়ে; সেখানে সবচেয়ে বড় ‘আয়রনি’ ছিল দু’টি কুকুরের খেলা– একটি মৃতদেহের মাথার তলায় থাকা রুগ্ন-পুরাতন একটি ছিট-কাপড়ের বালিশ কামড়ে-ছিড়ে সামনের একটি পা দিয়ে বালিশের তুলো বার করে আনছিল– সেই বড়লোকের পো কুকুর দুটোর দিকেও তেড়ে গেল– তুলোগুলো উড়ে এসে তার নাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল বলে। এতক্ষণে বুনোর বাপকে দেখলাম সামনে আসতে। তিনি বড়লোকের ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন– আপনি কুত্তার মতো ঝগড় করছেন ডোমেদের সঙ্গে। মরার খাট-বিছানা-বালিশ-ফুলের পিছনে যে খরচা আপনি খরচা করেছেন, তার কয় ভাগ টাকা এই ডোমেদের পিছনে খরচা করছেন আপনি? মরার সঙ্গে দিন-রাত থাকি আমরা, মরার জন‌্যই আমরা বাঁচি, ছেলেপিলে বউ নিয়ে সংসার চালাই মরার দেওয়া পয়সায়। তাই মরা মানে আমাদের ভাত-রুটির জোগাড়। আপনি ডোমের পয়সা নিয়ে বাড়ি যান। আমিও ডোম– আংরা থেকে অস্থি বের করে আনা আমার কাজ। ওটা আজ আমি করব না। আপনারা আজ অস্থি বিসর্জন না দিয়ে গঙ্গাজলে কুলকুচি করে কুলকুচির জল গঙ্গায় ফুৎ করে ফেলুন। আপনাদের মতো বড়লোকদের মায়ের তর্পণ ওইভাবেই। ডোমেদের পাওনা টাকা আপনি নিয়ে যান। মায়ের শ্রাদ্ধে সেই টাকা দিয়ে ফুর্তি করুন।

বুনোর বাবাকে আমি কোনও দিন এত কথা বলতে দেখিনি। কায়েতের ছেলে কী করে এমন ডোম হয়ে উঠলেন জানি না। কিন্তু ক্লাস নাইনে আমার মাকে নিয়ে যেদিন শ্মশানে গেলাম, সেদিন মাকে চিতায় তোলার পরেই আমার বুনোর কথা মনে পড়ল– ‘ওই দ‌্যাখ কাঠ ফেলছে। ওই দ‌্যাখ ওখানে শোয়ানো রয়েছে। ওটার মরণপিণ্ডি হয়ে গেছে– একেবারে রেডি মরা। পুরোটা দেখবি। চ।’ আজকে এত কঠিনভাবে পরম আত্মজনের দুই বাহু মূলে, চাঁদনি-ধোয়া আমার মায়ের ঠোঁটের ওপর সেই তিল-মিশ্র অন্নের মরণপিণ্ডি দিলাম। আমি পুরোটা দেখছি– চিতা সাজানো দেখলাম পুরোটা। ‘বডি’ চাপানো হল চিতার ওপর। তারপর সেই ‘বডি’র ওপর মোটা মোটা শুকনো গাছের ডাল– তবু সেটা এমন সুকৌশলে যাতে আমার চাঁদ-চুয়ানো মায়ের মুখখানি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। কেন যে সেই মুখখানা দেখে আমার গৃহদেবতা গৌরাঙ্গ-সুন্দরের উদ্দেশে লেখা গানের কলি মনে পড়ল– চাঁদেরও জোছনা সনে আমিয়া মথিয়া গো/ কে মাজিল গোরার দেহখানি!

পরে বুঝলাম– অত যে সুন্দর চিতা সাজিয়ে মুখখানি সপ্রকাশ করে রেখেছে, এবং আলতা-মাখা ‘চরণারবিন্দেষু’, তা মুখাগ্নি করে রেখেছে চরণস্পর্শ করার জন্য। আমি মায়ের মুখাগ্নি করে মায়ের চরণ ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আত্মীয়স্বজনেরা আমাকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন খানিক ফাঁকে। একান্নো বছরের মা, তেরো-চোদ্দো বছরের কনিষ্ঠ পুত্র। দাহকার্য দেখছি। পুরোটা দেখছি। পুরোটা দেখবি? পুরোটা দেখছি।

দাউদাউ করে চিতার আগুন জ্বলছে। আবারও শুনতে পাচ্ছি– বলো হরি, হরি বোল। আর একটা আসছে। আমি তাকালাম না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে মায়ের চিতার আগুন দেখছি– ডোমেরা লম্বা লাঠি দিয়ে জ্বলন্ত কাঠের সংস্থান ঠিক রাখছে– এদিক খুঁচিয়ে, ওদিকে ঠেলা দিয়ে। এরই মধ্যে একজন এসে আমার কাঁধে হাত রাখল। চেয়ে দেখলাম বুনোর বাবা। মনে পড়ল, বুনো বলেছিল– ‘নাই’ থেকে ‘মাথার খুলি’ পর্যন্ত আমার বাবার ভাগ। বুঝলাম, সেই নির্মম ভাগীদার এসে গেছেন। সত্যি বলতে কী, এতদিন গেছে, কতবার সামনাসামনি দেখা হয়েছে বুনোর বাবার সঙ্গে। আমিও তাঁর সঙ্গে তেমন করে কথা বলিনি কোনও দিন, তিনিও না। আজ অদ্ভুত দেখলাম– বুনোর বাবা অনেকক্ষণ আমার কাঁধে পিছন থেকে জড়িয়ে নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে রইলেন শুধু। তারপর বললেন– এত কষ্ট পাস না, বাবা! আমাদের সকলের গতি এই শ্মশান। ক’দিন আগে, না হয় ক’দিন পরে। তোর মা একটু আগেই চলে গেলেন। তবে কষ্ট পাস না বেশি। দেখবি, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর বারবার মায়ের কথা মনে পড়বে। ওই যে তুই অত ভাববি, অত মনে করবি, কত কান্না পাবে, আর তত বুঝবি– তোর মা মরেনি, সে তোর সঙ্গেই আছে, মা মরেনি, তোর মা অমর হয়ে গেছে।

কথাগুলো আমার এত ভালো লাগল যে, এটা নিছক সান্ত্বনার মতো লাগল না, শান্তিবাক্যের মতো যেন ঝরে পড়ল আমার ওপর। এরই মধ্যে বুনোর বাবা হঠাই চিতার থানে গিয়ে লম্বা লাঠির আগা দিয়ে একটা মাঝারি ঠোকা দিলেন আমার মৃতা মায়ের মাথার খুলির ওপর। খুলিটা একটু শব্দ করে, ফেটে গেল চৌচির হয়ে। অজস্র রস গড়িয়ে পড়তে লাগল মুহূর্তের মধ্যে। আগুন আরও দাউদাউ করে জ্বলতে লাগল। আর কিছু যেন দেখাও যাচ্ছে না। আমি চোখ বুজে ফেলেছি ততক্ষণে।

বুনোর বাবা আবারও এসে আমার কাঁধে স্নিগ্ধ হাত রেখে বললেন– কষ্ট পাস না। দুঃখটা তোরই সবচেয়ে বেশি– আমি জানি। আর একটা লোক– তোর বাবা। তোর বড় দাদারাও কষ্ট পাচ্ছে কমবেশি। কিন্তু আর যারা এসেছে তোর আত্মীয়-স্বজন, তাঁদের দু’-তিনজনকে বাদ দিলে আর যারা আছে, যাদের শ্মশান-বন্ধু বলে, ওরা ‘ডিউটি’ মারতে এসেছে। আমাদের তো শকুনের চোখ, কে কী করছে সব দেখতে পাই। ওদের মধ্যে দু’-তিনজন বারবার এদিক-ওদিক করছে, সিগারেট-বিড়ি খাচ্ছে, একজন পেচ্ছাপ করতে গিয়ে রিকশা নিয়ে বাস-স্ট্যান্ডে চলে গেল, আবার একজন দেখলাম– এখানে কান্না-কান্না মুখ করে দাঁড়িয়ে তোকে লেকচার দিচ্ছিল– কী আর করবি! এ জগতে জীবনের কোনও ঠিক নেই রে। নইলে জলজ্যান্ত লোকটা এই বয়সে চলে গেল! সেই লোকটাকে এক্ষুনি দেখে এলাম– মোরের মাথায় একটা দোকান থেকে গরম পরোটা আর আলুর দম খাচ্ছে। ও জানে– সবশেষে তোদের বাড়িতে ঢুকে খানিক দেরিতে হলেও আলুসিদ্ধ ভাত ছাড়া কিছু জুটবে না। অতএব এখন রাত দশটার সময় পরোটা আর আলুর দম সাঁটিয়ে নিল। আবার যখন ফিরে আসবে দেখবি– কান্না-কান্না মুখ।

বুনোর বাবা যে এত কথা বলতে পারে এবং কঠিন বাস্তবকে এত সুন্দরভাবে গুছিয়ে বলতে পারে– সেটা সেদিন, সেই বয়সে তেমন করে বুঝিনি আমিও, তাই ওর কথাগুলো খুব কঠিন এবং খারাপ কথা বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু আজ বুঝি– শ্মশানভূমিতে বহুল মানুষের যে, এই উপলব্ধি– এই তো জীবন! পদ্মপত্রে জল– এই আছে, এই নেই। টাকা-পয়সা, ধন-যৌবন, সংসার– কোনও স্থিরতা আছে? কোনও মূল্য আছে? সব অনিত্য? এসব যে বাণীর মতো কথা– এর সঙ্গে বিরাগ এবং বৈরাগ্যের কোনও সম্পর্কই নেই, বরঞ্চ এই কথাটা প্রাবাদিক সত‌্য বলেই এই বৈরাগ্যের নাম শ্মশান-বৈরাগ্য। অর্থাৎ, একমাত্র শ্মশানে গেলেই এই ধরনের বৈরাগ্য সাময়িকভাবে মানুষের ওপর চেপে বসে। কিন্তু এরাই বাড়ি ফিরে গেলে পরপর দু’দিন যদি প্রাতঃকৃত্যের সমস্যা তৈরি হয়, তাহলে তখন এরা ওই শ্মশানে যাওয়াটাকেই দায়ী করে বলবে– ওদিন শ্মশানে গিয়ে এই দুর্ভোগটা হল আমার। গেলাম যদি বা, আমার রাতেই ফিরে আসা উচিত ছিল।

বস্তুত বৈরাগ্য বস্তুটা একেবারেই অন্য এক উচ্চমাত্রার ব্যাপার। আর শ্মশান-বৈরাগ্য কাকে বলে, সেটা বোঝা যাবে এই মর্মস্পর্শী গানটায়– অথবা সঠিক বৈরাগ্য কাকে বলে সেটাও বোঝা যাবে এই রামপ্রসাদের কলিতে–

মন কেন মার চরণ ছাড়া।
ও মন ভাব শক্তি, পাবে মুক্তি,
বাঁধ দিয়া ভক্তি-দড়া॥
সময় থাকতে না দেখলে মন,
কেমন তোমার কপাল পোড়া।
মা ভক্তে ছলিতে তনয়ারূপেতে,
বাঁধেন আসি ঘরের বেড়া॥
মায়ে যত ভালবাসে, বুঝা যাবে মৃত্যুশেষে,
মোলে দণ্ড দুচার কন্নাকাটী, শেষে দিবে গোবরছড়া॥
ভাই বন্ধু দারা সুত, কেবলমাত্র মায়ার গোড়া।
মোলে সঙ্গে দিবে মেটে কলসী, কড়ি দিবে অষ্টকড়া॥
অঙ্গেতে যত আভরণ, সকলই করিবে হরণ।
দোসর বস্ত্র গায় দিবে, চার কোণা, মাঝখানে ফাঁড়া।
যেই ধ্যানে একমনে গো মা, সেই পাবে কালিকা তারা।
বের হয়ে দেখ কন্যারূপে, রামপ্রসাদে বাঁধছে বেড়া॥