Robbar

‘বোধহয়’ এক অপ্রাসঙ্গিক অভিনেতা

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 11, 2025 4:31 pm
  • Updated:December 11, 2025 4:50 pm  

ছয়ের দশকে পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে পাশ করে কলকাতায় ফিরে আসা, তারপর লাগাতার কয়েকটি তপন সিনহার ছবি, কিছু মূলস্রোতের বাংলা ছবি এবং সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’। এই সবগুলোর মধ্যে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়া কোনও ছবির পোস্টারেই স্থান মেলেনি কল্যাণদার। অর্থাৎ, প্রধান বা মুখ্য চরিত্র তো নয়ই, পার্শ্বচরিত্রেও চিরকাল ব্রাত্য থেকে গিয়েছেন। তারপর সেই সুপারহিট গান ‘আমি কলকাতার রসগোল্লা’-র ব্যাকগ্রাউন্ডে নৃত্যরত কনস্টেবল; অতঃপর ধীরে ধীরে কিছু সময়ের জন্য আড়ালে চলে যাওয়া… বোধহয়।

মৈনাক গুহ

বোধহয়; যেহেতু বহু উত্তর অজানা থেকে গেল তাই ‘বোধহয়’ দিয়ে শুরু করা ভালো… যেমন গুগল বলছে মৃত্যুকালে ওঁর বয়স হয়েছিল ৮৩, আর্টিস্ট ফোরামের মতে ৮১, আবার এক সংবাদপত্র ছেপেছে ৮৯! ওঁকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলে উনি ৮১-কে উল্টে দিয়ে ১৮ বলতেন বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তবে এই উল্লেখিত গরমিল যে অবহেলার দিকে ইঙ্গিত করে, তা শুধু মৃত্যু-পরবর্তী নয়, তাঁর আজীবনের সঙ্গী। তাই কল্যাণ চট্টোপাধ্যায় ফিরে দেখতে চাইলে হয়তো আমাদের একটু সফ্ট ফোকাসে, একরকম আবছা আকারেই দেখতে হবে। সব রেখা সঠিক মিলবে না। বিনোদন জগৎ নিয়ে যে প্রচলিত সামাজিক কল্পনা, তার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থিত সাদা-কালোও না আবার রঙিনও না, বরং একটা সেপিয়া-টোন্ড নিঃসঙ্গ জীবন। যা সমাজমাধ্যমে প্রকাশিত শবযানের একাকী চলে যাওয়াতে প্রকট।

কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়

২০১৮ সাল, মাসটা জুলাই বা আগস্ট, বেলা পেরিয়ে দুপুর গড়িয়েছে। শিশির মঞ্চের উল্টোদিকে সোজা চলে যাওয়া গোখলে রোডে স্টেট ব্যাঙ্কের সামনে একটি পেল্লাই পুরনো বাড়ি, তার সামনে দাঁড়িয়ে ফোন করে বললাম, ‘এসে গেছি, এবার কোথায়?’ একতলার একটি কোণের জানালা দিয়ে সাদা চুল-দাড়ি ভরা মুখ বের করে বলল, ‘চলে আয়।’ মোটা বাঁধানো রেলিংযুক্ত সিঁড়ি উঠে যাওয়ার ঠিক পাশে একটি দরজা– খোলাই ছিল– ঠেলে ঢুকলাম। ছোট্ট একটি স্যাঁতসেঁতে নীলচে দেওয়ালের কোণের ঘর, প্রায় ত্রিভুজাকার। এবং অনেকটা ‘weathering’, ঠিক যতটা তাঁর শরীরেও।

সাদা-কালোও না, আবার রঙিনও না, বরং একটা সেপিয়া-টোন্ড নিঃসঙ্গ জীবন

ঘরের আরেকটি দরজা রাস্তার দিকে খোলে, সেই লাগোয়া একটি ছোট জানালা– আলতো রোদ এসে পড়েছে ঘরের মাঝ-বরাবর রাখা একটি অগোছালো চৌকির একাংশে এবং তার পাশের কাঠের টুলটার ওপর। বাকিটা মেঝেতে। টুলটা এখানে সেন্টার টেবিলের চরিত্রে মনোনীত। তাতে রাখা কিছু ওষুধের পাতা, একটি ওষুধের শিশি, একটি রং বদলে যাওয়া জলের মগ, আর সিনে-অনুশীলনীদের চিরসাথী– বুড়ো সাধুর অল্প কমে যাওয়া পাঁইট। গত সন্ধ্যায় কেউ এসেছিল হয়তো…

…আর দু’টি কাচের গ্লাস যার নিচের অংশের ফরেনসিক পরীক্ষা করালে অনেক ইতিহাস উন্মোচিত হবে। সেই গ্লাসেই দু’-পাত্তর ঢেলে আমাদের আলাপ শুরু। টুলের একদিকের চেয়ারে আমি, সিনেমার স্নাতকোত্তর ছাত্র, অন্যদিকের চেয়ারে কল্যাণদা, বর্ষিষ্ট অভিনেতা, ‘অনিল চ্যাটার্জীর ভাইপো, মিঠুন চক্রবর্তীর ব্যাচমেট!’ (যদিও কোনও সংবাদমাধ্যমেই ওঁর সহপাঠীদের তালিকায় এই দ্বিতীয় নামটির উল্লেখ দেখিনি, কিন্তু এই পরিচয়টা উনি একাধিকবার ঠাট্টার ছলে হলেও বলতেন। জয়া ভাদুড়ি (বচ্চন) বা শত্রুঘ্ন সিনহাকে নিয়ে ওঁর মধ্যে অতটা উত্তেজনা কখনও দেখিনি।) …আমার মুখোমুখি দেওয়ালের কোণে মরচে ধরা স্টিলের আলমারি, আর আমার পিছনে, ফিল্মের কোনও চমকপ্রদ ক্যামিও-র মতো তিন ফুট বেদির ওপরে একটা পাঁচ-ছয় ফুটের মূর্তি– যা ঘরের আনুমানিক ১০ শতাংশ জায়গা দখল করে প্রতিষ্ঠিত। সম্ভবত শনি। পাশে, টায়ে টায়ে মাপের টেবিলের ওপর একটা পেটমোটা টিভি।

আমার ছবির আলোচনা করতে করতে বুঝতে পারলাম ওঁর দৈনন্দিন খাবারের আয়োজন রাস্তার উল্টোদিকের ফুটপাথে একটি ভাত-ডাল-মাছের ঠেলাগাড়ি– আরও কয়েক দিন যাতায়াতের পর জানলাম ওঁর শৌচালয় প্রতিবেশীর বাড়িতে, যার দরজা রাত ১০টায় বন্ধ হয়ে যায়; তারপর নিজ দায়িত্বে রাস্তায়। বোঝাই যাচ্ছে, এটি আদতে কোনও বাসস্থান নয়– অন্য কিছু, যা বাসস্থানের চরিত্রে অভিনয় করছে। তাহলে কি বাতিল ঠাকুরঘর নাকি এই পেল্লাই বাড়ির সার্ভেন্টস কোয়ার্টার? আপনাদের মনে যে দীর্ঘকায় প্রশ্নচিহ্নটা জেগে উঠছে– সেই ‘কেন’টা আমারও কোনও দিন সাহস করে জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি।

তাই আবারও– বোধহয়…

অতীতের মুখ, যৌবনে কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়

ছয়ের দশকে পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে পাশ করে কলকাতায় ফিরে আসা, তারপর লাগাতার কয়েকটি তপন সিনহার ছবি, কিছু মূলস্রোতের বাংলা ছবি এবং সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’। এই সবগুলোর মধ্যে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়া কোনও ছবির পোস্টারেই স্থান মেলেনি কল্যাণদার। অর্থাৎ, প্রধান বা মুখ্য চরিত্র তো নয়ই, পার্শ্বচরিত্রেও চিরকাল ব্রাত্য থেকে গিয়েছেন। তারপর সেই সুপারহিট গান ‘আমি কলকাতার রসগোল্লা’-র ব্যাকগ্রাউন্ডে নৃত্যরত কনস্টেবল; অতঃপর ধীরে ধীরে কিছু সময়ের জন্য আড়ালে চলে যাওয়া… বোধহয়। যতদিন না রেসের মাঠ থেকে রবি ওঝার অ্যাসিস্ট্যান্ট ওঁকে স্পট করে; ফলত– ‘এক আকাশের নিচে’ । তখন বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব, তাই সেখানেও গৃহভৃত্য কানাই। কিছু বছরের নিয়মিত উপস্থিতি এবং আবারও অজানা অগোচর।

সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবির পোস্টারে কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়

এসব পেরিয়েও অফুরন্ত উদ্দম, প্রাণোজ্জ্বল চোখ, অমলিন হাসি, অনর্গল বকবক এবং নিছক রসিকতা। ক্লান্তি বা বিরক্তি ওঁর অভিধানের শব্দ নয় বলেই আমার ধারণা। কাজে বা আড্ডায় কখনই কোনও নেতিবাচক মনোভাব আমার চোখে পড়েনি। সানন্দ উসকোখুসকো সান্তাক্লজ।

গড়িয়া মোড়ের মতো একটি জনবহুল যানজটময় চৌমাথায় মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়ে নির্দ্বিধায় একাধিক ‘টেক’ দিতে থাকা। বরং, গা ঘেঁষে যাওয়া রিকশা ধাক্কা মেরে চলে গেলে এক অপূর্ব মুহূর্ত তৈরি করা, যা কাহিনিচিত্র কে করে তোলে আরও ‘রিয়েল’, আরও জৈব।

জনবহুল যানজটময় চৌমাথায় মধ্যমণি, তবুও ‘অপ্রাসঙ্গিক’

রোজ শুট শেষে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়লেও খুড়োর একাই আড্ডা জমিয়ে দেওয়া– তাঁর যৌবনের কতিপয় ইংরেজি গান, বিভিন্ন স্মৃতিচারণ এবং কিছু প্রেমকাহিনি– যা বর্তমান না অতীত, অলীক না বাস্তব; নিশ্চিত নির্ধারণ কঠিন।

তাহলে, ‘অপ্রাসঙ্গিক’ কেন? তাঁর কর্মজীবনের ব্যবচ্ছেদগুলো কীসের ইঙ্গিত দেয়? কেন বারবার ভস্মে দমকা হাওয়া লেগে জ্বলে ওঠার মতো ফিরে ফিরে আসা আবার নিভে যাওয়া? ফিল্ম স্কুলে থাকাকালীন, মণি কৌল এবং কুমার সাহানির মতো কিংবদন্তিদের স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিতে অভিনয় করা থেকে শুরু করে– টেলিভিশন ও সিনেমার পর্দায় যখনই যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন, তাই দিয়েই দর্শকের মনে স্থান উৎকীর্ণ করেছেন চিরদিন। তাহলে এই অবহেলা কেন? আমার মতে, এটি বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের সংকট ও দুর্ভাগ্য, যে আমাদের মূলধারার পরিসরে চরিত্রায়নের ‘স্কোপ’ খুব সংকীর্ণ ও গতে বাঁধা।

কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়: ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়েও দর্শক-মনে চিরস্থায়ী

আমাদের ছোট ছবি, ‘এক অপ্রাসঙ্গিক সংলাপ’এর কাজ শেষ হয়ে যায় ২০১৯ সালেই। তারপর সেই ছবির দেশ-বিদেশ ভ্রমণ ও কোভিড। এইসবের মধ্যে ফোনালাপ চলতে থাকলেও সাক্ষাৎ আড্ডার পুনরারম্ভ হয় কিছু বছর পরে, কোভিড পরবর্তী কালে।

ছবির স্বল্পমেয়াদি সাফল্য, গুটিকয় পুরস্কার ওঁর সঙ্গে তখনও সেলিব্রেট করা হয়নি এবং সেদিন আরেকটা সুসংবাদ দিতে ওঁকে ফোন করি। আধুনিক সঞ্চার মাধ্যমগুলোর সঙ্গে  ওঁর সেভাবে পরিচয় না-থাকলেও আমাদের ছবি মুবিতে স্ট্রিম হওয়ার আনন্দ উনি বোধহয় আমার কণ্ঠস্বর থেকেই আঁচ করে ফেললেন। আদেশ হল এক বোতল ওল্ড মঙ্ক নিয়ে তখনই যেন চলে আসি ওঁর বাড়ি। ‘হাফ নয়, আজ একটা ফুল নিয়ে আয়!’

‘এক অপ্রাসঙ্গিক সংলাপ’-এর দৃশ্যে কল্যাণ চট্টোপাধ্যায় এবং মায়া ঘোষ

পৌঁছলাম। দেখি ঘরটা আরেকটু বেশি অগোছালো, চুল-দাড়িও সাধারণ সময়ের থেকে বেশি লম্বা। অনেক দিন নিজের প্রতি নজর না দিলে যের’ম হয়ে থাকে। পরনে সাদা গোল-গলা গেঞ্জি আর সাদা পাজামা, তবে মুখে সেই একই পরিচিত হাই-ভোল্টেজ হাসি। কথা এগতে জীবনের পরিহাস স্পষ্ট হল। কল্যাণদার হাতে কাজ একেবারে নেই বললেই চলে, কারণ তিনি লাইট নিতে পারছেন না। তাঁর চোখের এক সমস্যায় শুটিং-এর আলোতে অসুবিধা হচ্ছে। ফলে দিনের আলো ছাড়া শুট বন্ধ। চিরকাল অভাবের জীবনের আরও অন্ধকারের দিকে যাত্রা বোধহয় এখানেই শুরু।

সেদিন কল্যাণদার মধ্যে আমি ‘তুরিন হর্স’-এর Janos Derzsi-কে দেখতে পাই। আমার মনে হয় ওঁর চোখে, মুখে, চামড়ার ভাঁজে যতটা ড্রামা লুকিয়ে আছে তার এক অংশও এই মূর্খ দেশ এখনও দেখতে পায়নি। আমরা তাঁকে তাঁর পূর্ণমাত্রায় ব্যবহারই করতে পারলাম না।

এরপর আর দু’-তিনবার দেখা হয়েছিল ওঁর সঙ্গে। আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে দেখি প্রতিবার। এইবার ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল চলাকালীনই গিয়েছিলাম ওঁর বাড়ি। তালা ঝুলছিল দরজায়। সন্দেহ হল খানিক, কিন্তু আর ফোন করা হয়নি সেদিন। আমার ডেবিউ ফিচারের একটি অন্যতম প্রধান চরিত্র ওঁর অবয়বের অপেক্ষাতেই রয়ে গেল।