প্রীতীশ প্রচণ্ড কড়া সম্পাদক। এ তো জানা কথাই। কিন্তু শুনেছি একজন তরুণ, উঠতি ফোটোগ্রাফারের ছবির জন্য প্রীতীশ অপেক্ষা করেছিলেন। যে দিন প্রেসে যাওয়ার কথা, সেদিন প্রেসে যায়নি ইলাস্ট্রেটেড উইকলি। ব্যাপারটা লক্ষ করার মতো, কোনও বিখ্যাত কারও জন্য অপেক্ষা তো অনেক জায়গাতেই করে, হয়তো আজও করে। কিন্তু একজন তরুণ, যার মধ্যে প্রীতীশ প্রতিভা দেখেছে, তার জন্য এই অপেক্ষাই অনেকটা বড় সম্মান।
প্রীতীশ নন্দীকে আমি প্রথমবার দেখি আমার বাড়িতে। আমার বাবা-মায়ের বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। তারপর একদিন দুম করেই হাওয়া! দেখা নেই। কিন্তু বাড়িতে এসে পড়েছে ওঁর সম্পাদনা করা পত্রিকা: ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া’। সেই বয়সে, এই পত্রিকা দেখছি বটে, কিন্তু যতটা উৎফুল্ল হওয়ার কথা, ততটা হইনি তখন। আজ ছবি নিয়ে এতদিন চর্চার পর বুঝি, প্রীতীশ কী করেছেন!
অনেক কাল পর, প্রীতীশের সঙ্গে আমার আবার যোগাযোগ শুরু হল, যখন বিজ্ঞাপনের ছবি করা শুরু করেছি। আমার এক মামা, প্রীতীশের সমবয়সি ও বন্ধু– তাঁকে বললাম, বিজ্ঞাপনের ৩০ সেকেন্ড থেকে বেরিয়ে বড় মাপের ছবি করব বলে ভাবছি, একবার প্রীতীশ নন্দীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলে ভালো হত। আমার সম্বন্ধে কী বলেছিলেন মামা, আমি জানি না। কিন্তু যোগাযোগটা হয়ে গিয়েছিল। প্রীতীশ তখন প্রোডিওসার, একজন পরিচালক যেমন আইডিয়া নিয়ে যায়, আমিও সেরকম, গেলাম। বললেন, ‘সাউন্ডস ইন্টারেস্টিং’। যদিও নানা কারণে সে ছবি হয়নি। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা দানা বেঁধে গেল। নানা কারণেই প্রীতীশ মেসেজ করত। এমনও হয়েছে, সারাদিন সিনেমা নিয়ে একটা কথাও হয়নি। বই নিয়ে, এটা-সেটা হাজারো জিনিস নিয়ে আড্ডা মেরেছি, খাবারদাবার-কফি খেয়েছি। ফিল্মমেকার-প্রোডিওসারের যে বন্ধুত্ব, তার মধ্যে একটা টাকাপয়সা, লেনদেনের ব্যাপারস্যাপার থাকে– কিন্তু সম্পর্কটা গড়াল নিখাদ বন্ধুত্বের দিকেই। কাজের ব্যাপারে কথা হত না, তা অবশ্য নয়। একদিন ওর সেক্রেটারি ফোন করে আমাকে বলল, আপনার জন্য কিছু জিনিস অফিসে রাখা আছে। তা আনতে গিয়ে দেখলাম, যা নিয়ে আড্ডা হয়েছিল, তার কিছু মেটিরিয়াল ও জোগাড় করে রেখে দিয়েছে আমার জন্য।
যখন ছবি নিয়ে কথা বলতাম, ওর চোখগুলো বড় বড় হয়ে যেত। খুবই বুদ্ধিদীপ্ত লোক, চট করে ধরে ফেলতে কী করতে চাইছি। বলেছিলাম, ‘কে করতে পারে এই চরিত্রটা?’ বললাম, ‘জানি না গো!’ তখন প্রীতীশ বলল, ‘নানা করতে পারে।’ বললাম, ‘পাটেকার?’ ‘হ্যাঁ, দেখছি দাঁড়াও।’ নানার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল প্রীতীশই। তারপর আমি পুনা গিয়েছিলাম। নানার ছবিও তুলেছিলাম তখন।
আমি ছবি তুলি। প্রায় সারাক্ষণই একসময় ক্যামেরা বগলদাবা করে ঘুরতাম। https://www.sanjeetchowdhury.net/ ওয়েবসাইটে তার অনেক ছবিই দেখা যাবে। ফোটোগ্রাফ নিয়েও কথা হত প্রীতীশের সঙ্গে। ফোটোগ্রাফি সম্পর্কেও ওর ধারণা ছিল অত্যন্ত আধুনিক, ঝকঝকে। গড়পরতা নয় একেবারেই, বরং রিমার্কেবল। ও বুঝতে পারত ছবিটা। একদিন আমি বলেছিলাম, ‘অ্যাই প্রীতীশ, মেনকা একটা এগজিবিশন করছে।’ মেনকা গান্ধীর এগজিবিশনে ছবি বিক্রির টাকা ডোনেট করা হবে পশুদের নানা উন্নতি কল্পে। প্রীতীশ বলল, ‘তোমার তো দুরন্ত কিছু ছবি আছে, এগজিবিশনে দিয়ে দাও।’ ‘কী করে দেব, কাল তো লাস্ট ডেট!’ আমি তখন গিয়েছিলাম বোম্বেতে, ছবি এডিট করতে। ফিরব আরও একদিন পেরিয়ে। দিন দুই আরও লাগবে, ছবি খুঁজতে। প্রিন্ট করিয়ে পাঠাতে। ফলত দিন পাঁচেকের ঝক্কি। এসবই গুছিয়ে বললাম প্রীতীশকে। প্রীতীশ বলল, ‘পাঁচদিন পরে মেনকার ঠিকানায় পাঠাতে পারবে তো?’ বললাম, ‘হ্যাঁ।’ ‘বেশ, শুধু তোমার জন্য আমি এন্ট্রির শেষ দিন ৫ দিন বাড়িয়ে দিচ্ছি। তোমার জন্য, বাকিদের জন্য নয়।’ এই এগজিবিশনে তাবড় তাবড় ফোটোগ্রাফারের ছবি ছিল, ছিল রঘু রাইয়ের কাজও। চট করে প্রিন্ট করে ১২/১৪ ইঞ্চি সাইজের প্রিন্ট করে ৪টে ছবি পাঠিয়েছিলাম। প্রীতীশ দেখতেও গিয়েছিল সেই এগজিবিশনে। পরে দেখা হতে, বলেছিল, ‘তোমার ছবিগুলো একটু বড় করে প্রিন্ট করলে পারতে।’ এগজিবিশন শেষে, আমার কাছে ফেরত এসেছিল ২টো ছবি। প্রীতীশ ভদ্রতার খাতিরে বলেনি বটে, কিন্তু জানতে পেরেছিলাম, ছবি দুটো কিনেছিল প্রীতীশই।
……………………
প্রীতীশ নন্দী, তাঁর কবিতার বইয়ের সংখ্যা ৬, থাকেন কলকাতায়, যেখানে তিনি সমকালীন কবিতা নিয়ে মজে থাকেন। তাঁর কাজ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বাইরেও, অনেকগুলি কবিতার বই বিশ্বের নানা জায়গা থেকে প্রকাশিত হবে বলে খবর। বর্তমানে বাংলা মহাকাব্য মাইকেল মধুসূদন দত্তর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’র ইংরেজি অনুবাদের ব্রত নিয়েছেন। বয়স ২৪ ও বিবাহিত।
……………………
প্রীতীশ ছবিকে কতটা যে ভালোবাসত, ইলাস্ট্রেটেড উইকলির পুরনো সংখ্যাগুলো দেখলেই বোঝা যায়। একটা সময় এই পত্রিকার বহু সংখ্যা পেয়েছিলাম, একেবারে নতুনের মতো– প্রীতীশকে উত্তেজনায় বারবার ফোন করেছিলাম। ধরেনি। দেখেছিলাম, কী অসাধারণ ফোটোগ্রাফির ব্যবহার। প্রীতীশ প্রায় কোনও ছবি বোধহয় ক্রপ করত না। করলেও, এতই ইন্টেলিজেন্টলি ক্রপ করত যে, ছবির কোনও ক্ষতি হত না। লেখার সঙ্গে ছবির যে একটা গুরুত্ব, তা প্রীতীশ ভালো বুঝত। যখন এই ওই অসংখ্য সংখ্যাগুলো দেখছিলাম, বুঝতে পারছিলাম তা আরও ভালোভাবে। একটা পাতাকে কীভাবে দেখত বা সাজাত, তা সত্যিই অভাবনীয়!
প্রীতীশের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব তৈরি হওয়ার পর কথায় কথায় একদিন ওর কবিতার কথা বলি। কবিতা, ওর প্রায় মুখস্তই থাকত। বললাম, ‘বাড়ি গিয়ে দেখো, এই কবিতাটা ওই কাব্যগ্রন্থে আছে।’ প্রীতীশ লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, অধিকাংশ বই-ই ওর কাছে নেই। ‘কী বলছ প্রীতীশ!’ বলল, ‘হ্যাঁ, শহর থেকে বাড়ি– সবই তো বদলালাম। বই আর থাকে!’ আমি ‘সুবর্ণরেখা’র ইন্দ্রনাথ মজুমদারকে ধরলাম। ইন্দ্রনাথদা, পণ্ডিত মানুষ, ‘শিক্ষিত’ শুধু নয়, পণ্ডিতই বলছি। সেই ইন্দ্রনাথদা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। বললাম, প্রীতীশের বইয়ের ব্যাপারে। মাঝেমধ্যেই ইন্দ্রদা ফোন করে বলতেন, ‘অ্যাই-ই, দুটো প্রীতীশের বই এসেছে। রাখা রয়েছে।’ সেগুলো আলাদা করে রাখা থাকত। আমি নিয়ে গিয়ে প্রীতীশকে দিতাম। প্রীতীশ আকাশ থেকে পড়ত! বহু বহু দিন পরে সেসব বই ফিরত পেয়েছিল সে। অন্য বহু কবিদের, কবিতার বই নিয়ে আলোচনা হতে শুরু করল। মজার ব্যাপার, ওর বইগুলোও ও তখন আমাকে দিতে শুরু করল। ’৭১ সালে প্রফেসর লাল, যিনি ‘রাইটার্স ওয়ার্কশপ’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘মডার্ন ইন্ডিয়ান পোয়েট্রি ইন ইংলিশ’ বইতে প্রীতীশের একটা কবি পরিচিতি ছিল। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় এইরকম: প্রীতীশ নন্দী, তাঁর কবিতার বইয়ের সংখ্যা ৬, থাকেন কলকাতায়, যেখানে তিনি সমকালীন কবিতা নিয়ে মজে থাকেন। তাঁর কাজ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বাইরেও, অনেকগুলি কবিতার বই বিশ্বের নানা জায়গা থেকে প্রকাশিত হবে বলে খবর। বর্তমানে বাংলা মহাকাব্য মাইকেল মধুসূদন দত্তর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’র ইংরেজি অনুবাদের ব্রত নিয়েছেন। বয়স ২৪ ও বিবাহিত।
প্রীতীশ প্রচণ্ড কড়া সম্পাদক। এ তো জানা কথাই। কিন্তু শুনেছি একজন তরুণ, উঠতি ফোটোগ্রাফারের ছবির জন্য প্রীতীশ অপেক্ষা করেছিলেন। যে দিন প্রেসে যাওয়ার কথা, সেদিন প্রেসে যায়নি ইলাস্ট্রেটেড উইকলি। ব্যাপারটা লক্ষ করার মতো, কোনও বিখ্যাত কারও জন্য অপেক্ষা তো অনেক জায়গাতেই করে, হয়তো আজও করে। কিন্তু একজন তরুণ, যার মধ্যে প্রীতীশ প্রতিভা দেখেছে, তার জন্য এই অপেক্ষাই অনেকটা বড় সম্মান।
একদিন রাধাপ্রসাদ গুপ্তর বাড়ি গিয়েছি। গিয়ে দেখছি, আরপি কাকু খুবই ক্লান্ত। জিজ্ঞেস করলাম, কী কেস? বললেন, সারাদিন ধরে প্রীতীশ আর মেনকা গান্ধী এসে আরপির কালীঘাট কালেকশনগুলো দেখেছে। এটা খুবই ঝক্কির, কারণ কোনও বইয়ে ছাপা থেকে তো দেখাচ্ছে না। এগুলো সত্যিকারের ছবি। এবং তার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে। ছবির গুরুত্ব কী, ছবির একটা চরিত্র কী বলছে– এরকম নানা ব্যাপার। কলকাতা শহরে আরপির সঙ্গে যেহেতু বন্ধুত্ব ছিল, আর কোথায়ই বা যেত প্রীতীশ।
আমি পড়তাম সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। কলেজের কাছেই ছিল ‘গ্যালারি এইট্টিএইট’। সেখানে আমি ছবি দেখার জন্য প্রায়শই ঢুঁ মারতাম। আমারও আগে অবশ্য ঢুঁ মারতেন আমার বাবা– বসন্ত চৌধুরী। বাবার সঙ্গে গ্যালারির অধিকর্তা মিসেস ব্যানার্জী ও তাঁর স্বামীর সঙ্গে একরকম সখ্যও ছিল। রাধাপ্রসাদ গুপ্তর সেন্টিনারিতে হয়েছিল এই গ্যালারিতেই। আমি দৌড়দৌড়ি করছিলাম। সেসময় ‘গ্যালারি এইট্টি এইটে’র মিসেস ব্যানার্জীর আমাকে চেনা চেনা লাগে। আর.পি-র মেয়েরা আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন। তাঁর চোখমুখে আনন্দ দেখতে পেয়েছিলাম, ওহ, তুমি বসন্তদার ছেলে! এই মিসেস ব্যানার্জীর গ্যালারিতেই ’৯১ সালের ৯-২০ মার্চ প্রীতীশের কবিতা ও সমীর মণ্ডলের ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল।
‘পিপল অ্যান্ড বুকস’ বলে একটা অংশ রয়েছে আমার ফোটোগ্রাফির ওয়েবসাইটে। যেসব মানুষের সংগ্রহে, বা যাদের ঘিরে প্রচুর বই রয়েছে। আমি আশিস নন্দীর পরিচয় জানতাম, কিন্তু আলাপ ছিল না। প্রীতীশকে বলেছিলাম, ‘একবার আশিস নন্দীকে বলে দাও না, ছবি তুলতে যাব।’ সেই সূত্রে আশিস নন্দীর বাড়ি গেলাম, ছবিও তুললাম। ছবি তোলার পরে, যখন কফি খেতে খেতে আড্ডা মারছি, আশিস নন্দী বলেছিলেন, ‘প্রীতীশ বলেছিল, তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে, তুমি যে শুধু ছবি তোলার লোক, তা নও।’
ক’মাস আগেও প্রীতীশের সঙ্গে কিছু কথা হয়েছে। অথচ, কী আশ্চর্য, আর কথা হবে না।
‘মহুয়া’র প্রচ্ছদের নেপথ্যে নন্দলালের আঁকা সহজ পাঠের ছবি রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয়ই প্রাণিত করেছিল। সহজ পাঠের আগে আমরা দেখেছি, ১৯২২ সালের শেষে আন্দ্রে কারপেলেস প্যারিস থেকে এনেছিলেন একগুচ্ছ কাঠখোদাই। এমনকী, বিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ যে কয়েকবার বিদেশ সফরে গিয়েছেন, সেখানে জার্মানিতে ও ফ্রান্সে তাঁর রীতিমত চেনাজানা ঘটেছিল কাঠখোদাই মাধ্যমটির সঙ্গে।