
১৫ ডিসেম্বর, প্রয়াত হয়েছেন প্রতিক্ষণ পত্রিকার সম্পাদক-সাংবাদিক স্বপ্না দেব। ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি, স্বপ্না দেব ঝলমলে এক নক্ষত্র, তেজে, সাহসে, রূপে চারদিক আলো করে থাকেন। দুঃসাহসিক মিশনে গিয়ে তুলে নিয়ে আসছেন দেশের জ্বলন্ত খবর, অথচ ঘরোয়া সাজে, শাড়ি, টিপ হাতের বালার সঙ্গে কোনও বিরোধ নেই। মুখে হাসি। কথা বললেই বোঝা যেত মানুষটির ব্যক্তিত্বের ধার কেমন। ভোপাল গ্যাস ট্রাজেডির বিস্তৃত অনুসন্ধান বেরিয়েছে ‘প্রতিক্ষণ’-এ।
‘প্রতিক্ষণ’ সম্পাদক স্বপ্না দেবের কাছে কীভাবে, কখন প্রশ্রয় পেতে আরম্ভ করেছিলাম, এখন আর মনে নেই। কিন্তু একসময় অনুভব করলাম তাঁর প্রতি যা আমার আছে তা একান্তই অন্তরের টান। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা মিলে-মিশে পরিণত হয়েছে গাঢ় আকর্ষণে। তাঁর কাছে আমিও পেয়েছিলাম বুক ভরা স্নেহ, যা দেখা দিত কেবল কথায় নয়, আমার প্রতি তাঁর আচরণের মধ্য দিয়ে। বাংলার বাইরে কাজ করি, কলকাতায় এলে একবার আসবই এসপ্ল্যানেডের সেই বাড়ির নিচতলার সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে, ‘প্রতিক্ষণ’ অফিসের আড্ডায়। সেখানে পত্রিকার কাজের পাশাপাশি লেখকদের আড্ডা, কথা আর হাসির উত্তাপে বাড়ি ঝলমল। মুড়ি-তেলেভাজা। আড্ডার মধ্যমণি এক অগ্রজ লেখক। তিনি আমাকে খুব অপরিহার্য মনে করতেন না। কাজেই আমি একটু পরেই সম্পাদিকার ঘরে বসে তাঁর কাজকর্মের গল্প শুনতাম, নিজের কথা বলতাম।

১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি, স্বপ্না দেব তখন ঝলমলে এক নক্ষত্র, তেজে, সাহসে, রূপে চারদিক আলো করে থাকেন। দুঃসাহসিক মিশনে গিয়ে তুলে নিয়ে আসছেন দেশের জ্বলন্ত খবর, অথচ ঘরোয়া সাজে, শাড়ি, টিপ হাতের বালার সঙ্গে কোনও বিরোধ নেই। মুখে হাসি। কথা বললেই বোঝা যেত মানুষটির ব্যক্তিত্বের ধার কেমন। ভোপাল গ্যাস ট্রাজেডির বিস্তৃত অনুসন্ধান বেরিয়েছে প্রতিক্ষণ-এ। সংবাদপত্রর সঙ্গে এইসব সাংবাদিকতার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। সেগুলি নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ এক টেক্সট। ভিন্দ্রানওয়ালের গোপন ডেরায় গিয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়ে ফেরার পর স্বপ্নাদি তখন কলকাতার সাংবাদিক মহলে চর্চার বিষয়! অথচ তাঁর গেরিলা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার আগুন নিজের সহজ আচরণের মধ্যে ঢেকে রাখতেন। নিজের কাজ নিয়ে কখনও তাঁর মুখে কথা শুনিনি। যৎসামান্য সাফল্যের পর যাঁরা ‘এনটাইটেইলড’ আচরণের তুঙ্গে চলে যান, তাঁরা যদি সদ্য পঞ্চাশোর্ধ্ব স্বপ্নাদিকে দেখতেন, বা অনুসরণ করার সুযোগ পেতেন!
তখন কয়েক বছর হল গল্প লিখছি, পাশাপাশি কবিতা। প্রতিক্ষণ-এর জন্য কবিতা চেয়ে নিতেন স্বপ্নাদি, গল্পও। তিনি জানতেন কাজের চাপ আর সংসারের দাবি মেটানোর পর লেখার সময় আমার অল্প। একবার অনেকদিন লেখা দেওয়া হয়নি। অভিমান করে বলেছিলেন, সব চেষ্টাই তো করছি। তোমার হয়ে তো আর লিখে দিতে পারি না। খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। আমার কোনও প্রতিবেদনের সঙ্গে ক্যামেরায় ছবি তুলেছিলেন নিজেই, সে ছবি কোনও কারণে নষ্ট হয়ে যায়। চিঠি লিখে সে কথা জানিয়েছিলেন দুঃখ করে।

১৯৮৭-তে আমি ওড়িশায়। অবিভক্ত সম্বলপুরের প্রজেক্ট অফিসার ডিস্ট্রিক্ট রুরাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি-র হয়ে গিয়েছি। সঙ্গে শিশুপুত্র। শ্বশুর-শাশুড়ি। স্বামী অন্যত্র ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। আমার ঘরে কখনও জল নেই, কখনও আলো। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো ট্যুর করতে গিয়ে তাকে ধরেছে ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়াতে। আমি কাজ ও সন্তান নিয়ে নাকানি-চোবানি খাচ্ছি। এর মধ্যে একদিন অফিসের দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি– এ কী! হাসতে হাসতে আসছেন স্বপ্নাদি। কোনও আত্মীয়ের কাছে এসেছিলেন, সেখানে আমার কথা মনে হয়েছে। অতএব অফিস খুঁজতে খুঁজতে নিজেই চলে এসেছেন। তাঁকে কী দিয়ে আপ্যায়ন করি, কোথায় বসাই– কিছুই ভাবার অবসর দিলেন না, যেন নিজের মা কিংবা মাসি এসেছেন– এইভাবে সব সহজ করে দিলেন।

স্বপ্নাদি যে কেবল আমাকেই স্নেহ করতেন তা নয়। আমার সমকালীন লেখকরা অনেকেই তাঁর স্নেহ ও সমর্থন পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ভগীরথ মিশ্র, অমর মিত্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী যেমন ছিলেন, তেমন ছিলেন ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, কিন্নর রায় আর আফসার আহমেদ। স্বপ্নাদি আর প্রিয়ব্রত দেব– দু’জনেই ছিলেন অনেক তরুণ ও নাতিতরুণ লেখকের অভিভাবক। তাঁদের গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ থেকে চিঠিপত্রের তরজা অনেক কিছুই প্রতিক্ষণ-এ ছাপা হত। এখানে সম্পাদকীয় প্রশ্রয় ছিল নিঃশর্ত। কী লেখা হবে এবং কেন– এই নিয়ে কোনও হস্তক্ষেপ থাকত না।

আজ এই ম্লান হেমন্ত-সন্ধ্যায় স্বপ্না দেবের কথা লিখতে লিখতে ভাবছি, তিনি গত কয়েক মাস ধরে অসুস্থ ছিলেন, বাড়িতে চিকিৎসা চলছিল কারণ হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাঁকে হারানোর নিরন্তর শঙ্কায় ভুগতাম। তবু কেন যে ভাবিনি এমন দিন আসবে যখন তাঁর কথা লিখতে হবে আমাকে। যা লিখছি তা কোনও শোকলিপি নয়, এ তাঁর জীবনকে ঘুরে-ফিরে দেখা। কারণ তাঁর কাজ রইল নিজের জায়গায়, সম্পাদক সাংবাদিকদের দৃষ্টান্ত স্বরূপ হয়ে। আমাদের মধ্যে তিনি যা সঞ্চারিত করেছেন, তা রয়ে গেল আমাদের মধ্যে। কোনও ক্ষয় নেই, ব্যত্যয় নেই।

আমাকে ফিল্ড ডায়েরি লিখতে শিখিয়েছিলেন স্বপ্নাদি। আমি তখন জলসম্পদ বিভাগের নির্মাণ ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিয়ে গ্রামগঞ্জে ঘুরছি। বলেছিলেন, যা দেখবে, শুনবে একটা খাতায় নোট করবে, তারপর ফিরে এসে পুরোটা লিখে আমাদের দেবে। তুমি যা দেবে, তাই-ই আমরা ছাপব। বাঁধের বাস্তুচ্যুত মানুষদের কাহিনি এইভাবে লেখা আরম্ভ হয় ১৯৯৪-তে, ধারাবাহিক ভাবে লেখা প্রথম নন-ফিকশন। আজ বুঝি, আমার ‘প্লাবন জল’ উপন্যাসের বীজ যেন তার মধ্যে সুপ্ত রয়ে গিয়েছিল। ‘কলকাতার প্রতিমাশিল্পীরা’ যখন লিখছি, ১৯৯৭ সাল। বাবা অসুস্থ। কলকাতা ছেড়ে বেরতে পারছি না। পথে ঘুরে আরম্ভ হয় আমার মহানগরের অন্যতম লোকশিল্প নিয়ে লেখা। শিল্পী যুধাজিৎ সেনগুপ্তর আঁকা-সহ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছে প্রতিক্ষণ-এ। কোনও তরুণ লেখককে তাঁর প্রিয় লেখাটির জন্য এইভাবে স্পেস বরাদ্দ করে দেওয়া একজন সম্পাদকের পক্ষে কত কঠিন, আজ জানি। কিন্তু স্বপ্না দেব এইভাবেই আমার মতো একজনকে লেখায় রাখতেন।
প্রিয়ব্রত দেবের সেই সুদর্শন, সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা চেহারা এখনও চোখের সামনে স্পষ্ট দেখি। তিনি অল্প কথার মানুষ ছিলেন, কিন্তু গভীর স্নেহ লুকতে পারতেন না। স্বপ্না দেবের সম্পাদনা, প্রিয়ব্রত দেবের প্রকাশনা, পূর্ণেন্দু পত্রীর শিল্প-নির্দেশনা– সব কিছুর সংযোগে ‘প্রতিক্ষণ’ হয়ে উঠেছিল অদ্বিতীয় একটি প্রতিষ্ঠান। প্রকাশক হিসেবে প্রিয়ব্রতবাবু যেসব বই প্রকাশ করতেন, তার নেপথ্যে স্বপ্না দেবের প্রচ্ছন্ন উৎসাহ নিশ্চয়ই থাকত। তা না-হলে আমার কয়েকটি বই প্রতিক্ষণ-এর তালিকায় স্থান পেত না।
অসাধারণ ভালো পাঠক ছিলেন স্বপ্নাদি। গত এক দশকের নানা অসুখ-বিসুখে তাঁর বই পড়ার উৎসাহ কমেনি। দেখা হলেই সদ্য-পড়া লেখা নিয়ে আলোচনা করতেন। আমার এক ধারাবাহিক লেখার শেষ পর্ব যে কাগজে বেরিয়েছিল, সেই কাগজটি বাড়িতে আসেনি বলে এত দুঃখ করছিলেন, সেটি শেষ পর্যন্ত আনিয়ে দিতে হয়েছিল অন্য কোথাও থেকে। একইভাবে তিনি তরুণ লেখকদের লেখা আগ্রহের সঙ্গে পড়তেন, ভালো লাগা জানাতেন ফোন করে। অসুস্থতা তাঁর মনের উদ্যম কমাতে পারেনি, কিন্তু প্রিয়ব্রত দেব চলে যাওয়ার পর তাঁর মধ্যে বিচ্ছেদের বিহ্বলতা দেখেছি। যেমন স্নেহপ্রবণ, বিশাল অন্তরের মানুষ ছিলেন, তার যোগ্য ভালোবাসা আর যত্ন তিনি পেয়েছেন পরিবারের কাছে। শুদ্ধব্রত, নন্দিনী, পৌত্রী– প্রত্যেকে তাঁকে আগলে রেখে দিয়েছেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। তিনি ও প্রিয়ব্রতবাবু রয়ে গেলেন সন্তানদের, আত্মজনদের, গুণমুগ্ধদের মধ্যে শাখা-প্রশাখায়। না, প্রতিক্ষণ-এর সূচনাপর্বের সুতো ছিন্ন হয়নি, শুদ্ধব্রত দেবের যোগ্য হাতে তার বিস্তার ও সংহতি– দুই-ই ঘটবে।
ভালোবাসার এক চিরন্তন আলো জ্বেলে সারা জীবন নিজেকে উজাড় করে দিয়েই গিয়েছেন স্বপ্নাদি। কাজ, আবেগ, ভালোবাসা, সাহস, ঋজু মেরুদণ্ড নিয়ে বেঁচে থাকার দৃষ্টান্ত হয়ে।
তাঁর মতো মানুষকে ঘৃণা, হিংসা, আত্মবিক্রয়-লুব্ধ এই পৃথিবী কি আর পাবে কোনও দিন?
——————————-
ছবি ঋণ: প্রতিক্ষণ, ধুলোখেলা
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved