পৃথ্বী থিয়েটারে রতন থিয়াম তাঁর দলবল নিয়ে পারফর্ম করতে এসেছিলেন। তখন তাঁর দুটো নাটকের জন্য ব্যাকস্টেজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই দুই নাটক: ‘উত্তর প্রিয়দর্শী’ এবং ‘অন্ধ যুগ’। যেটুকু বুঝেছিলাম– তিনি খুবই ভদ্রলোক এবং নাটকের খুঁটিনাটি ব্যাপারে ভয়ানক খুঁতখুঁতে। অভিনেতা কিংবা অভিনেতা নয়– এমন লোকজন দিয়েও তিনি করিয়ে নিতে পারতেন থিয়েটারের আশ্চর্য সব কাণ্ডকারখানা– নাচ, অভিনয়– এবং গোটা থিয়েটারটাকেই খুব জ্যান্ত বলে মনে হত। মনে হত, ‘লার্জার দ্যান লাইফ’।
রতন থিয়ামের প্রয়াণ সংবাদ পেয়েছি গতকাল সকালবেলায়। মনটা তখন থেকে খারাপ হয়ে আছে। মনে পড়ছে ‘পৃথ্বী থিয়েটার’-এর কথা। নয়ের দশকের মাঝামাঝি একটা সময়। তখন থিয়েটার করি, যদিও নিজেকে সবসময় ‘সিনেমার লোক’ বলেই ভেবে এসেছি। কিন্তু সেই সময়ে সঞ্জনা কাপুরদের সঙ্গে ভিড়ে গিয়ে পৃথ্বী থিয়েটারে ভলেনটিয়ারের কাজ করছি। মনে আছে, আলোর ঘরে লিয়াকত আর এনায়েত নামের দুই ভাই ছিলেন। তাঁরাই মূলত দেখাশোনা করতেন সবকিছু। আমি হেল্পার গোছের। কেউ কিছু বললে করে দিতাম। যখন ওঁরা কিছু বলত– মইয়ে চড়ে এটা করে দাও, বা ব্যাকস্টেজে এখন এটা লাগবে– আমি মইয়ে চড়ে, দৌড়োদৌড়ি করে, এটা-সেটা এনে দিয়ে সাহায্য করতাম তাঁদের।
এই পৃথ্বী থিয়েটারেই রতন থিয়াম তাঁর দলবল নিয়ে পারফর্ম করতে এসেছিলেন। তখন তাঁর দুটো নাটকের জন্য ব্যাকস্টেজে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই দুই নাটক: ‘উত্তর প্রিয়দর্শী’ এবং ‘অন্ধ যুগ’। যেটুকু বুঝেছিলাম– তিনি খুবই ভদ্রলোক এবং নাটকের খুঁটিনাটি ব্যাপারে ভয়ানক খুঁতখুঁতে। অভিনেতা কিংবা অভিনেতা নয়– এমন লোকজন দিয়েও তিনি করিয়ে নিতে পারতেন থিয়েটারের আশ্চর্য সব কাণ্ডকারখানা– নাচ, অভিনয়– এবং গোটা থিয়েটারটাকেই খুব জ্যান্ত বলে মনে হত। মনে হত, ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। এই কারণেই মনে করি, রতন থিয়াম নাটকের কুরোসাওয়া। যেভাবে তিনি থিয়েটার করতেন, ব্যবহার করতেন নৃত্যশৈলী, নানা খুচরো উপাদান– তা অবিশ্বাস্য। সাধারণ, গড়পরতা কিছু তাঁর নাটকে থাকবে, এরকম ভাবাই যায় না! ‘কাগেমুশা’ (১৯৮০), ‘রান’ (১৯৮৫) ইত্যাদি সিনেমায় যে-কুরোসাওয়াকে আমরা পাই, থিয়েটারে আমি অন্তত রতন থিয়ামকে সেভাবেই পেয়েছি।
‘এনএসডি’-তে ভরতের ‘নাট্যশাস্ত্র’ পড়ানো হত। তা এক কথায় ‘ওল্ড স্কুল’। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, রতন থিয়াম ঘরানার দিক থেকে নাট্যশাস্ত্রর দিকেই ঝুঁকেছিলেন। তিনি একার্থে ধ্রুপদীই। অথচ মণিপুরে বসে, নিজেদের ‘আধুনিক’ নাটককে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। মনে আছে, যে সময় এসব কাজ করছি পৃথ্বী থিয়েটারে, এই সমস্ত অভিজ্ঞতার জেরেই খুব উত্তেজিত হয়ে থাকতাম। যদিও রতন থিয়ামের গোটা নাট্যপদ্ধতিটা আমি কখনও দেখতে পাইনি, শুধুমাত্র শেষমেশ কী দাঁড়াল, তাই-ই দেখেছি। নাটকে খুব সামান্য সরঞ্জাম দিয়েই, নাট্যমুহূর্তকে বিরাট করে তোলার অবিস্মরণীয় ক্ষমতা ছিল রতন থিয়ামের। এ-ও মনে হয়েছে, শুধুমাত্র নাট্যপরিচালক নন, তিনি একজন দুর্দান্ত কোরিওগ্রাফারও বটে! ওঁর থিয়েটারে ব্যবহৃত নৃত্যশৈলী দেখে মনে হত, অনেক বড় স্টেজ দরকার। কী ভালো যে হত, যদি একবার, তাঁর নাটকের রিহার্সাল দেখতে পেতাম।
কোনও সন্দেহ নেই থিয়েটারের ‘জায়েন্ট’ তিনি। ইব্রাহিম আলকাজি, বীণাপানি চাওলা, হাবিব তনভীরের সঙ্গে একই সারিতে থাকবেন। এই সমস্ত ‘জায়েন্ট’-এর কাজ দেখতাম সেসময় আর ‘হাঁ’ হয়ে যেতাম। এখন এঁরা নেই। যদিও রতন থিয়ামের থেকেও হাবিব তনভীরের সঙ্গে বেশি সখ্য ছিল আমার। কারণ হাবিব তনভীরের নাটকের পোস্টার লাগানো থেকে টিকিট বিক্রি– ভার ছিল আমার ওপরেই। কিন্তু এঁদের কারও সঙ্গেই ‘অভিনেতা’ হিসেবে কাজ করার কোনও অভিজ্ঞতা গড়ে ওঠেনি।
ইব্রাহিম আলকাজি, বীণাপানি চাওলা, হাবিব তনভীরের পথ ধরলেন রতন থিয়াম। অনেক সময় বলা হয়, ‘তাঁর চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা ধারার অবসান হল’। আমি বলতে চাই, একটা যুগ ফুরল একে একে এঁদের চলে যাওয়ায়। থিয়েটারের ‘জায়েন্ট’ কেউ কি বেঁচে রইলেন? মনে পড়ছে, রঞ্জিত কাপুরের কথা, কিন্তু তিনিও তো অনেক দিন হল থিয়েটার করেন না। তবে?
আজকের মুম্বইয়ের থিয়েটার এতটাই বাণিজ্যিক হয়ে পড়েছে, যে, সেখানে আর শিল্প নেই, ক্রিয়েটিভিটি নেই। ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ব্যাপারটাই মঞ্চ থেকে উধাও! পুণের মোহিত টাকালকার কিছুটা আশা জাগিয়েছেন। কিন্তু বাকিরা? সেক্স কমেডি থেকে শুরু করে থিয়েটারের মঞ্চে কীসব হয় আজকাল কে জানে!
নিজের যৌবনে এঁদের সঙ্গে সামান্য কাজ করতে গিয়ে, তাঁদের নাটক দেখে, চমকে উঠে ভাবতাম, এঁদের কাজের সঙ্গে আমি কীভাবে জুড়ে গেলাম! নাটকের মঞ্চ থেকে সেই অতিকায় অপূর্ব বিস্ময় হয়তো বিদায় নিল রতন থিয়ামের প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গেই।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved