আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সমালোচিত হয়েছিলেন একটি কবিতা লিখে। তিনি লিখছেন ‘এবার কবিতা লিখে আমি একটা রাজপ্রাসাদ বানাবো/ এবার কবিতা লিখে আমি চাই পনটিয়াক গাড়ি।’ এছাড়াও তিনি চেয়েছিলেন দামি স্কচ, সাদা ঘোড়া, নির্ভেজাল ঘৃতে পক্ক মুরগির ঠ্যাং, সহস্র ক্রীতদাসী– এমন অনেক কিছুই। একজন কবি কেন এমন সাংসারিক সাফল্য চাইবেন? তিনি চির রুগ্ন, তিনি চিরদরিদ্র, হতাশা তার মাথার মুকুট। এমনটাই তো দাবি সমাজের। কবিতার বিচার নয় একটু স্থূল বিচারেই বরং ভাবা যাক। এই যে পনটিয়াক গাড়ি, এই যে সাফল্য তা আসলে একজন কবির বর্ম। সাংসারিক বর্ম। সংসারের শত লাঞ্ছনা, গঞ্জনা তা পেরতে হলে এই সাফল্যের বর্মটি তাকে প্রতি মুহূর্তে বাঁচাবে। সুনীল যা পেরেছেন একজন লোকাল কবি বা লেখক তা পারবেন কীভাবে? যখন সেই সম্ভাবনা নেই তখন আছে উত্তরীয়, মানপত্র, আর টিনের স্মারক। এগুলো একজন লোকাল কবির বর্ম।
খরগোশ আর কচ্ছপের সেই গল্পটি নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে। এই গল্প আপনি যখন শোনেন তখন আপনি নিশ্চয়ই ছিলেন কচ্ছপের দিকে। তার ধৈর্য, তার আত্মবিশ্বাস– এসব নিয়ে আপনি নিশ্চয়ই একটি সদর্থক ভাবনা ভেবে রেখেছিলেন। আজ এতদিন পর সেই গল্পটির কী দশা? গত ৫০ বছর ধরে যুগপৎ সাম্যবাদী এবং ভাববাদী বাঙালি এখন কচ্ছপ আর খরগোশ– দু’জনেরই সমর্থক। খরগোশের গতি এবং আত্মগ্লানি আর কচ্ছপের ধৈর্য এবং বর্মের প্রতি বাঙালির ঝোঁক সর্বাধিক। বাঙালির আরেকটি সর্বব্যাপী দোষ আছে। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে একটি বাণী না-হলে তার চলে না। সেই বাণী যা সত্য থেকে দূরবর্তী-প্রায় মিথ্যার কাছাকাছি। কবিতা থেকে একটি বিচ্ছিন্ন লাইন কিংবা গদ্য থেকে উদ্ধৃত একটি লাইন যা মূল রচনার প্রায় উল্টো কথা বহন করে সেই বাণীটিকেই কাজে এবং জীবনে বাঙালি আপন করে নিয়েছে। তার বিবেকানন্দ রচনাবলির প্রয়োজন নেই। ছোট ছোট বাণী-নির্ভর বই হলেই চলে। মহাপুরুষের জীবন নয়, দু’-এক টুকরো আদি অনন্ত বাণী নিয়ে সে সাংস্কৃতিক তরণি বেয়ে চলেছে। ছোটবেলায় স্কুলের কর্মশিক্ষার ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও’, ‘জীবে প্রেম করে যেই জন’, ‘অন্যায় যে করে আর’ ইত্যাদি বাণী প্র্যাকটিক্যাল খাতায় আটকে শেষ পর্যন্ত সে কলেজে পৌঁছেছে ছাত্র সংসদের কালচারাল সেক্রেটারি হিসেবে। তারপর হয়তো তার নিয়তি বিপুল কর্মক্ষেত্রে একজন ভূমিক্ষয়কারী এলআইসির এজেন্ট হিসেবে। সব ক্ষেত্রেই বাঙালির একটি বর্ম চাই। আগে যা ছিল সাংস্কৃতিক বর্ম, এখন রাজনৈতিক বর্মের দিকে তার পাল্লা ভারী!
কবিরাই বা বাদ যাবেন কেন? তার কেন বর্ম থাকবে না? ইদানীং কবির ধর্ম যদি নাও থাকে বর্মটি জরুরি। এর একটি স্থূল আয়োজন সম্ভবত শুরু হয়েছিল পাঁচ ও ছয়ের দশকে। আজ দিকে দিকে বাঙালি কবির কত না বর্মের আয়োজন! সেই বর্ম কখনও ব্যক্তি, কখনও বৈঠকখানা, কখনও প্রতিষ্ঠান, কখনও প্রকাশনা, এমনকী, লিটল ম্যাগাজিন। এছাড়াও তার আরও চাই। বর্মটি আরও নিখুঁত এবং নিশ্ছিদ্র হওয়া প্রয়োজন। যেন তা ‘বুলেটপ্রুফ’ হয়। আর এই বুলেটপ্রুফ বর্মটি সরকারি, বেসরকারি নানা পুরস্কার। মঞ্চ সভা-সমিতি। নিজের মরণোত্তর স্বীকৃতি জীবন থাকতেই নিশ্চিত করে রাখা। নিজেকে নিয়ে উপহাস করা ঔদার্য একদিন বাংলা ভাষার কবি ও লেখকদের ছিল। আজকের কবি মাত্রই শেষের কবিতার অমিত রায়। নিজেকে নিয়ে উপহাস করার সাহস নেই পাছে লোকে ফস করে বিশ্বাস করে বসে। তাঁর ভাঁড়ারটি কার্যত শূন্য। তাই উপরে ঝুটো মণিমুক্তো সাজিয়ে রাখতে হয়। যাতে মৌমাছির মতো পালে পালে শিষ্য এসে জড়ো হয় পদতলে। মৃত্যুর আগেই সুনীল তাঁর বৈঠকখানায় নিশ্চয়ই দেখে গিয়েছেন কত নবীন কবি ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে’– কিছু একটা ব্যবস্থা করা দরকার। সেই সময় অজস্র তরুণ কবি জেলা শহর মফসসল থেকে তাঁর কাছে দরবার করতেন। ‘দেশ’ পত্রিকায় একটি কবিতা ছাপার আশায়। একবার জীবনে ‘দেশ’ পত্রিকার পাতায় নিজের নাম তুলতে পারলেই সেই কবি একটি অক্ষয় বর্ম পেয়ে যান চিরন্তন স্বীকৃতির। যেন কবিপ্রতিভার এক এবং অন্তিম হলমার্ক। এই আবদার নয়ের দশকে জয় গোস্বামীর কাছেও ছিল। সেই একই বিপুল বেদনায় আর্থিক দারিদ্র আর মনের দারিদ্রের মিশেলে আত্মমর্যাদা শিকেয় তুলে স্বর্ণাক্ষরে একবার নিজের নাম তুলে নেওয়া। তরুণ কবির হ্যাংলামি না হয় বয়সোচিত এবং স্বাভাবিক। কিন্তু যিনি বিপ্লবের বর্ম নিয়ে পঞ্চাশ-ষাট পেরিয়েছেন, তাঁরও এই বর্মের মোহ কিছু কম নয়। জীবনের শেষ পর্বে এসে ‘কিছুই তো হল না’ এই গানটি হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের আবহসংগীত। তখন পাঠক কিংবা ভক্ত পাকড়াওয়ের পালা। তখন নবীন সম্পাদককে চাপ দিয়ে নিজেকে নিয়ে একটি ক্রোড়পত্র বা স্পেশাল ইস্যুর আয়োজন করে নেন তিনি। যে-কোনও সভা-সমিতির ডাক পেলে ছুটে যান উত্তরীয় পরানসখার অমোঘ টানে। এভাবেই প্রবীণ কবির লালার বিগ্রহ বৈঠকখানা থেকে বৈঠকখানা রোড পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে শেষ স্বীকৃতির আশায়। এই বর্মটুকু না জুটলে শেষ পর্যন্ত তিনি বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী হবেন কি না, সেই করাল ভয় তাকে গ্রাস করে। কবির ধর্মের যে নির্জন পথ তার চেয়ে বর্মের প্রতিভায় তার আস্থা বেশি।
…………………………………………..
শঙ্খ ঘোষের হাতে বই– যেন তিনি উদ্বোধন করছেন, এই বর্মটি যে-কোনও ছলে-ছুতোয় তার প্রয়োজন। ঘুম থেকে তুলে তাঁকে বই অর্পণ করতে সে দ্বিধাবোধ করেনি। ছবি তুলতেও ভোলেনি। এ শুধু অলস মায়া নয়, এ সবই বর্মের খেলা। শঙ্খ ঘোষও তা বুঝতেন। অন্তত ছবিটিতে তাঁর মুখভার,অস্বস্তি, উদাসীনতা এড়ানো যায়নি। আজ এআই হয়তো তাঁর মুখে মোনালিসার হাসি ফোটাতে পারত। বাঙালি কবির কাছে এই বর্মেরই সর্বোচ্চ ধাপ ইদানীং এক নিচু স্বগতোক্তি।
……………………………………………
এই তো কিছুদিন আগেও বাঙালির সাহিত্য সংস্কৃতির প্রধান অভিভাবক ছিলেন শঙ্খ ঘোষ। আশ্রয় এবং প্রশ্রয়। যে-কোনও মূল্যে তাঁর বৈঠকখানায় পৌঁছনো ছিল একজন কবির অন্তিম স্টেশন। দীর্ঘদিন শঙ্খ ঘোষই ছিলেন বাংলা ভাষার তরুণ কবির এমনকী, প্রবীণ কবির একটি মজবুত ও অভেদ্য বর্ম। বর্মটি এমনই জরুরি ছিল যে, করোনার দিনগুলিতেও আমরা তাঁকে ছাড়িনি। নিজের খ্যাতির বর্মের জন্য তাঁর মৃত্যু রচনা করতে দ্বিধাবোধ করিনি। যে-কোনও একটি বই প্রকাশমাত্রই শঙ্খ ঘোষের কাছে ছুটে যাওয়া এবং একটি ছবি তুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে দেওয়া বাঙালির লেখকের জীবনধর্ম ছিল। শঙ্খ ঘোষের হাতে বই– যেন তিনি উদ্বোধন করছেন, এই বর্মটি যে-কোনও ছলে-ছুতোয় তার প্রয়োজন। ঘুম থেকে তুলে তাঁকে বই অর্পণ করতে সে দ্বিধাবোধ করেনি। ছবি তুলতেও ভোলেনি। এ শুধু অলস মায়া নয়, এ সবই বর্মের খেলা। শঙ্খ ঘোষও তা বুঝতেন। অন্তত ছবিটিতে তাঁর মুখভার,অস্বস্তি, উদাসীনতা এড়ানো যায়নি। আজ এআই হয়তো তাঁর মুখে মোনালিসার হাসি ফোটাতে পারত। বাঙালি কবির কাছে এই বর্মেরই সর্বোচ্চ ধাপ ইদানীং এক নিচু স্বগতোক্তি। কোনও পাঠকের ব্যক্তিগত মেসেজ কিংবা কোনও বিখ্যাত কবির ফোনালাপটিকে মুহূর্তে সে ফেসবুকে আপলোড করে দিচ্ছে। কেন? ব্যক্তিগত স্বীকৃতিটুকুই তো যথেষ্ট ছিল। তবুও এই যে সে নির্লজ্জ আত্মপ্রচারে শামিল হয়, তার কারণ এটি তার বর্ম। আত্মশক্তি যত কম ,আত্মমর্যাদা যখন বিলুপ্ত তখন প্রবীণ কবির ব্যক্তিগত বার্তাটি সর্বসমক্ষে আনার অর্থ এই– দেখো, আমার একটি শক্তিশালী বর্ম আছে। তুমি কে হে অর্বাচীন পাঠক? আমাকে উপেক্ষা করার প্রতিশোধ নিলুম।
শঙ্খ ঘোষকে বাঙালি একপ্রকার মান্যতা দিয়েছে এবং তা উল্টো রকমের। বাঙালি মহাপুরুষের লেখা গ্রহণ করেছে, নিজের সুযোগ-সুবিধা মতো কেটে-ছেঁটে বাণী করে নিয়েছে। অনেকটা প্রবাসে নিয়ম নাস্তির মতো বিশুদ্ধ উপায়ে। শঙ্খ ঘোষের ‘কঠোর বিকল্পের কোনো পরিশ্রম নেই’ এই উপহাসটিকে নয়। বরং এই বাণীটিকেই সে সার্থক করে তুলেছে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক– যে কোনও দুর্নীতি এই পদ্ধতিতে হয়ে চলেছে। শিক্ষক থেকে কবি– কেউই ব্যতিক্রম নন। একজন তরুণ কবি লিখতে এসেই পাঠক হিসেবে নিজেকে তৈরি করার বদলে দাদার খপ্পরে পড়েন। পরনিন্দা পরচর্চার প্রচারক হয়ে ওঠেন। দাদার হাত ধরে কবিসম্মেলন থেকে সরকারি কবিতা উৎসবে নিজের নামটি অন্তর্ভুক্ত করতে এক গোপন দালালিতে মেতে ওঠেন। অর্থাৎ লিখতে এসেই দ্রুত নাম এবং খ্যাতি চাই । এক্ষেত্রে বাঙালির কবিপ্রতিভা খরগোশের গতির দিকে। এবং পরিনাম শেষ পর্যন্ত গ্লানিময় পরাজয়ে। তার জীবনে খরগোশের দ্রুতগতির শর্টকার্ট আর কচ্ছপের বর্মর কোনও বিকল্প নেই।
…………………………………..
এর পাশাপাশি আমাদের মনে পড়ে ‘বর্ম’ নামে শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতা আছে তাঁর ‘মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়’ কাব্যগ্রন্থে। সেখানে তিনি বলেছিলেন ‘এত যদি ব্যূহ চক্র তীর তীরন্দাজ, তবে কেন/ শরীর দিয়েছ শুধু বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে?’ আজকের তরুণ কবি কিংবা লেখক এই বর্মটিকে ভুল অর্থে ব্যবহার করে চলেছেন। খ্যাপার পরশপাথরের মতো খুঁজে চলেছেন সেই বর্ম যা মুহূর্তে প্রাপ্তির ভাঁড়ারকে অপ্রত্যাশিত উপচে দেবে। আমি যার যোগ্য নই সেটুকু ভাবার অবকাশ নেই। সময়ের সব মূল্যায়ন অন্তত জীবিত অবস্থায় তার কাছে তুচ্ছ!
……………………………………
কথায় কথায় তরুণ কবি শঙ্খ ঘোষ আওড়ায়। আর শঙ্খ ঘোষ ‘কবির বর্ম’ নামক একটি পুস্তিকাই তো লিখেছিলেন ।সেখানে শঙ্খ ঘোষ কবির বর্মের কথা বলেছেন। কেমন সেই বর্ম? যে-কোনও সমালোচনা, পাঠকের, উপেক্ষা, কুৎসার পরেও একজন কবির আত্মবিশ্বাস, যা অবিচল থাকবে এবং প্রস্তুত:
‘‘জানব না কি যে বিনয়ের মধ্যেও একটা সামর্থ্য থাকতে পারে, থাকতে পারে আত্মপ্রত্যয়ের এই সম্ভাবনাময় বীজ, বিপুল এই ঘোষণা যে: ‘দেখো, এই হচ্ছি আমি। এইটুকুই, এর চেয়ে বেশি নয়, কমও নয় এর চেয়ে। আর তারপর কে আমার কী বিচার দিল, সে শুধু তার দায়। সে-বিচারে আমার আমিত্বের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নেই।’ গর্বিত এই বিনয়ের ঘোষণাই যে-কোনো কবির বর্ম। এই বর্ম যদি কবির সঙ্গে থাকে, কোনো সমালোচনাই তবে ধ্বংস করতে পারে না তাঁকে, কোনো উপেক্ষাই উন্মুল করতে পারে না তাঁকে।’’
এর পাশাপাশি আমাদের মনে পড়ে ‘বর্ম’ নামে শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতা আছে তাঁর ‘মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়’ কাব্যগ্রন্থে। সেখানে তিনি বলেছিলেন ‘এত যদি ব্যূহ চক্র তীর তীরন্দাজ, তবে কেন/ শরীর দিয়েছ শুধু বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে?’ আজকের তরুণ কবি কিংবা লেখক এই বর্মটিকে ভুল অর্থে ব্যবহার করে চলেছেন। খ্যাপার পরশপাথরের মতো খুঁজে চলেছেন সেই বর্ম যা মুহূর্তে প্রাপ্তির ভাঁড়ারকে অপ্রত্যাশিত উপচে দেবে। আমি যার যোগ্য নই সেটুকু ভাবার অবকাশ নেই। সময়ের সব মূল্যায়ন অন্তত জীবিত অবস্থায় তার কাছে তুচ্ছ!
ঠিক উল্টো রকমের একটি বর্ম আজকের তরুণ কিংবা প্রবীণ কবি পড়ে আছেন। আত্মবিশ্বাসের বদলে আত্মছলনা, আত্মপ্রেমের বদলে আত্মমুগ্ধতা। বিপুল গৌরবে প্রতি মুহূর্তে সাপলুডো খেলায় তার প্রয়োজন এইসব বর্ম। সঠিক সময়ে তৈলমর্দন বা স্তাবকতায় তার জুড়ি মেলা ভার। প্রবীণ কবির রাজনৈতিক ক্ষমতাটিকে সে কিছুতেই সন্দেহ করে না। তাই তার আবর্জনাময় কবিতার পাশেই সকৃতজ্ঞ মন্তব্য ‘কী করে পারেন এমন!’ বা ‘আপনি আমাদের একমাত্র আশ্রয়’– এইসব। যাতে সরকারি সুযোগ-সুবিধা মঞ্চ সভার আলো থেকে সে বঞ্চিত না হয়। এই বর্মেরই আরেকটি রূপ কোনও গ্রন্থের ভূমিকা লেখা লিখে দেওয়ার আবদার। আগে যা সামলেছিলেন অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমার সেন এখন তা সামলাতে হয় প্রবীণ কবিকে। কতখানি আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকলে কাব্যগ্রন্থের ভূমিকা রচনা করতে হয় তা আপনারা জানেন। ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়ার তরফ থেকে আরেকটি বর্ম রচিত হয়েছে কবি এবং লেখকের জন্য। যার গালভরা নাম ‘নিবিড় পাঠপ্রতিক্রিয়া’। ছদ্মবেশী পাঠককে বই উপহার দিয়ে, বারবার তাগাদা দিয়ে এমনকী, টাকা দিয়ে পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখিয়ে নিজের কবি খ্যাতি টিকিয়ে রাখতে চান অনেকে। আজ সেই পাঠপ্রতিক্রিয়ার ব্যভিচার দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।
ইদানীং কোনও লেখক বা কবির প্রতিভার আরেকটি বর্ম আসলে পিওডির খেলা। বইমেলার মাঠে তার কাব্যগ্রন্থের পাঁচটি সংস্করণ হয়। সাকুল্যে বিক্রি ৪৫ কপি । ছোট প্রকাশক পিওডির সুযোগ নিয়ে একজন মামুলি কবির,অপ্রস্তুত লেখকের অতিকায় মিথ্যে ছায়া নির্মাণ করছেন। মুদ্রণের পর মুদ্রণ– পরে জানা যায় আসলে বন্ধু-পাঠক ,আত্মীয়-স্বজন এসব করেও ১০০ কপিও বই তার বিক্রি হয়নি। আর অচেনা পাঠক পাঁচজনও নয়। এই বর্মটি খুবই সস্তা, প্রকাশক এবং কবিকে হাস্যকর করে তুলেছে। সম্প্রতি আমরা দেখলাম কাশ্মীরের ঘটনায় উগ্র জাতীয়তাবাদ কিংবা দেশপ্রেম কীভাবে একজন কবির বর্ম হয়ে ওঠে। এই বর্মটুকুর বিনিময়ে তিনি রাষ্ট্রের কাছে নিরাপদ থাকতে চান এবং প্রতিবেশী ভিন্নধর্মের মানুষের অনিশ্চয়তাকে অবলম্বন করেই তার এই ভিন্ন বর্ম রচনা। কাছের শত্রু এবং দূরের শত্রু বিচার করে তিনি কখনও সরব বুদ্ধিজীবী এবং নীরব প্রায় মূক কবি। আর কে না জানে তাঁর এই নীরবতাই একখানি মূল্যবান হিরন্ময় বর্ম। শাসকের পায়ে নিবেদিত মরিচার লৌহ-তির।
আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সমালোচিত হয়েছিলেন একটি কবিতা লিখে। তিনি লিখছেন ‘এবার কবিতা লিখে আমি একটা রাজপ্রাসাদ বানাবো/ এবার কবিতা লিখে আমি চাই পনটিয়াক গাড়ি।’ এছাড়াও তিনি চেয়েছিলেন দামি স্কচ, সাদা ঘোড়া, নির্ভেজাল ঘৃতে পক্ক মুরগির ঠ্যাং, সহস্র ক্রীতদাসী– এমন অনেক কিছুই। একজন কবি কেন এমন সাংসারিক সাফল্য চাইবেন? তিনি চির রুগ্ন, তিনি চিরদরিদ্র, হতাশা তার মাথার মুকুট। এমনটাই তো দাবি সমাজের। কবিতার বিচার নয় একটু স্থূল বিচারেই বরং ভাবা যাক। এই যে পনটিয়াক গাড়ি, এই যে সাফল্য তা আসলে একজন কবির বর্ম। সাংসারিক বর্ম। সংসারের শত লাঞ্ছনা, গঞ্জনা তা পেরতে হলে এই সাফল্যের বর্মটি তাকে প্রতি মুহূর্তে বাঁচাবে। সুনীল যা পেরেছেন একজন লোকাল কবি বা লেখক তা পারবেন কীভাবে? যখন সেই সম্ভাবনা নেই তখন আছে উত্তরীয়, মানপত্র, আর টিনের স্মারক। এগুলো একজন লোকাল কবির বর্ম। সংসারকে উপেক্ষা করে সাহিত্যচর্চা করতে গেলে যতই ঝুটো হোক, এইটুকু বর্ম তার প্রয়োজন হয়। ইদানীং প্রচুর মধ্যবয়সি মহিলা বইমেলায় জড়ো হচ্ছেন কবি হিসেবে। তাদের কবিত্ব আছে কি না তার চেয়েও বড় কথা তাদের একটি ফাঁদে ফেলে নিয়ে আসেন কোনও প্রকাশক বা সম্পাদক। তারপর সেলফি, ছবি, সার্টিফিকেট এবং প্লাস্টিকের স্মারক। এটিই আসলে তার বর্ম বা লাইসেন্স ।সংসারকে উপেক্ষা করে সে এসেছে বইমেলায় কাজেই এই স্মারকটি সে বর্ম হিসেবে পেশ করবে সংসারের কাছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বহুদিন ধরে ব্যবহৃত একটি বর্ম যার নাম পুরস্কার। প্রতি মুহূর্তে সরকারি কিংবা বেসরকারি পুরস্কার পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি। পুরস্কার তা যতই তুচ্ছ হোক সেটুকু পাওয়ার জন্য অবিরত লালা ঝরে তার। অজস্র কলকাঠি নড়ে। আমরা জানি, যে-কোনও পুরস্কারের নেপথ্যে আছে মনন এবং মনোবিকার। মননের ছবি তালিকা দেখলে বোঝা যাবে এবং মনোবিকারের ছবিও তালিকা দেখলে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। আজ কমল দাশ বা সতীকান্ত গুহ কোথায়? পুরস্কার দিয়ে তাদের যে বর্মটি রচিত হল তা শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌঁছল? ‘দেশ’ পত্রিকার পাতায় প্রতি মুহূর্তে নাম তুলেও বটকৃষ্ণ দে’র লেখা কে পড়ছে আজ? তাই আজ ভাবার সময় এসেছে কোন বর্মটি আপনার চাই? প্রতিষ্ঠানের স্নেহ, পুরস্কার, মঞ্চ কিংবা বাউন্সার কে বাঁচাবে আপনাকে? ধর্মহীন এই বর্ম নিয়ে আপনি কতদূর যাবেন? জানি, ‘সাধনা’ কথাটি মরীচিকা। নির্জন সাধনা ইদানীং বই বিক্রির একটি ছলনা। তবু নিজের কাছে স্পষ্ট থাকা উচিত। আজ প্রতি মুহূর্তের কবিসভায় নিজের জন্য আমাদের সেই সময়টুকুই নেই। বরং নির্লজ্জ এক আত্মপ্রচার, উলঙ্গ এক কাদা ছোড়াছুড়ি– এই হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলা ভাষার একজন কবির ভবিতব্য। তার মোটা চামড়ায় আজ কোনও শাসনের দাগ পড়ে না।
শঙ্খ ঘোষকে খানিকটা বিকৃত করে আজকের যে-কোনও পাঠক তার উদ্দেশে হয়তো বলতে পারে, ‘শরীর দিয়েছ শুধু চর্মখানি ভুলে গেছ দিতে!’
প্রথমবার মহিষাসুরমর্দিনী প্রযোজনা করেন জগন্নাথ মুখোপাধ্যায় ও মালতী বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনে করেছেন– কল্যাণ ঘোষ, প্রদ্যোৎ, বিভাস পাল এবং বহুবার পঙ্কজদা, শর্মিষ্ঠাদি। প্রদ্যোৎ যেবার প্রযোজনা করেছিল সেবার দুর্গার চরিত্রে রূপদান করেছিলেন হেমা মালিনী।