মায়েরা কোনও গল্পের মধ্যে থাকেন না– তাঁরা থাকেন নেপথ্যে, যেখানে ক্যামেরা পৌঁছয় না। তাঁদের কণ্ঠস্বর ছেঁটে দেওয়া হয় সন্তানের সম্ভাবনার গল্পে, তাঁদের ক্লান্তি চাপা পড়ে যায় ঐতিহাসিক পুরুষতান্ত্রিক উদযাপনে। হান্না চ্যাপলিনের কণ্ঠ হারানো, তাঁর মঞ্চ থেকে সরে যাওয়া, তাঁর ‘পাগল’ হয়ে যাওয়া– এইসব গল্প আমার গলায় কাঁটার মতো আটকে থাকে। একজন শিল্পীর, একজন মায়ের, একজন পরিত্যক্ত নারীর গল্প– যাঁকে সময়, সমাজ, সন্তান– কেউই দু’-দণ্ড দাঁড়িয়ে শুনল না। আজ তাঁর জন্মদিন। আমি ভাবি, আমরা কাদের জন্মদিন পালন করি, কাদের স্মরণে লেখা হয়, আর কাদের জীবন নিঃশব্দে ফুরিয়ে যায়। আজ যখন চার্লি চ্যাপলিনের স্ট্যাচু মেট্রো স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে, যখন স্কুলপাঠ্যে ‘দ্য কিড’ বা ‘মডার্ন টাইমস’ শেখানো হয়, তখন তাঁর মায়ের কণ্ঠ কোথায় হারিয়ে যায়– সেই প্রশ্নটাই আমি তোলার চেষ্টা করছি এখানে।
নিশুতি রাতের মতো গলা ছিল তাঁর– একদিন হঠাৎ সেই সুর নিভে গেল। শব্দ ছিল না, শুধু কাঁপা কাঁপা নিশ্বাস পড়ে রইল। হান্না চ্যাপলিন– চার্লি চ্যাপলিনের মা, একজন পারফর্মার, একজন নারী, এবং শেষে এক ‘পাগল’। অথচ আমার চোখে, তিনি প্রথমে ছিলেন একজন গায়িকা, যাঁর গান কেউই ঠিকমতো শুনলই না। তিনি সেই মা, যাঁর নৈঃশব্দ পরবর্তীতে জন্ম দিল একটি গোটা ‘নীরব’ চলচ্চিত্র জগৎকে, অথচ যাঁর নিজস্ব কণ্ঠ কোথাও আর শোনা গেল না। চার্লির জীবনের আলোতে যে নারী ছিলেন ছায়ার মতো, সেই ছায়াটির কথা আজ লিখছি। কারণ আমি জানি, এই পৃথিবীতে যত বিপ্লবই হোক না কেন, একজন নারীর ভাঙা গলার গল্প কেউ ঠিকমতো লেখে না।
আর মায়েরা তো এমনিতেই গল্পের মধ্যে থাকে না– তাঁরা থাকেন নেপথ্যে, যেখানে ক্যামেরা পৌঁছয় না। তাঁদের কণ্ঠস্বর ছেঁটে দেওয়া হয় সন্তানের সম্ভাবনার গল্পে, তাঁদের ক্লান্তি চাপা পড়ে যায় ঐতিহাসিক পুরুষতান্ত্রিক উদযাপনে। আমার নিজের জীবনেও একসময় এমন সময় এসেছে– যখন কথা বলতে গেলেই গলা কেঁপে উঠত, বুক শুকিয়ে যেত, মনে হত একটামাত্র শব্দ বললেই সব ভেঙে পড়বে। হয়তো সেই কারণেই হান্নার জীবনের সঙ্গে আমার এই অদ্ভুত সংযোগ। তাঁর কণ্ঠ হারানো, তাঁর মঞ্চ থেকে সরে যাওয়া, তাঁর ‘পাগল’ হয়ে যাওয়া– এইসব গল্প আমার গলায় কাঁটার মতো আটকে থাকে। একজন শিল্পীর, একজন মায়ের, একজন পরিত্যক্ত নারীর গল্প– যাঁকে সময়, সমাজ, সন্তান– কেউই দু’-দণ্ড দাঁড়িয়ে শুনল না।
আজ তাঁর জন্মদিন। আমি ভাবি, আমরা কাদের জন্মদিন পালন করি, কাদের স্মরণে লেখা হয়, আর কাদের জীবন নিঃশব্দে ফুরিয়ে যায়। আজ যখন চার্লির স্ট্যাচু মেট্রো স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে, যখন স্কুলপাঠ্যে ‘দ্য কিড’ বা ‘মডার্ন টাইমস’ শেখানো হয়, তখন তার মায়ের কণ্ঠ কোথায় হারিয়ে যায়– সেই প্রশ্নটাই আমি তোলার চেষ্টা করছি এখানে।
হান্না চ্যাপলিন, যাঁর আসল নাম ছিল হান্না হিল, ছিলেন দক্ষিণ লন্ডনের এক গরিব ঘরের মেয়ে। নাম বদলে হয়েছিলেন ‘লিলি হার্লি’– এক উঠতি মিউজিক হল পারফর্মার, ক্যাবারে ও ভডেভিলের জগতে এক ক্ষণিকের উজ্জ্বল আলো। গান গাইতেন, অভিনয় করতেন, মঞ্চে দাঁড়াতেন। তাঁর গলায় ছিল একরকম কাঁচ ভাঙার মতো শব্দ– যা দর্শকদের চামড়ার নিচে গিয়েও বসে থাকত। কিন্তু এই শিল্পজগৎ ছিল পুরুষ-নির্মিত, আর নারীর শরীর এখানে ছিল সবচেয়ে সহজপাচ্য বস্তু। প্রেম এসেছিল, প্রতারণা এসেছিল, সন্তান এসেছিল– কিন্তু স্থিতি আসেনি।
একটা সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় সোনার খনির খোঁজে প্রেমিকের হাত ধরে হান্না পাড়ি দেন, আর ফিরে আসেন সিফিলিস ও দারিদ্র নিয়ে। কেউ বলে পতিতাবৃত্তি করতেন, কেউ বলে প্রতারিত হয়েছিলেন। কী সত্যি, কী মিথ্যে– সে ব্যাখ্যা এখন ইতিহাসবিদদের কাজ। আমার কাছে হান্নার শরীর একটা যুদ্ধক্ষেত্র, যার প্রতিটি ক্ষত একেকটা রাজনৈতিক দলিল। হুইলার, সিডনি, আর চার্লি– তিনটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তিনি, তিনজনেরই বাবা ভিন্ন, তিনজনের বাবাই তাঁকে ছেড়ে গেছে। এইরকম একসময় হঠাৎ একদিন তাঁর গলা বসে যায়। তাই হান্না চ্যাপলিনের গল্পে আমি শুধু ইতিহাস পড়ি না, নিজের প্রতিচ্ছবি দেখি। হান্নার যখন গলা বসে যায়, তিনি তখন মঞ্চে। তার মানে কেবল গান থেমে যাওয়া নয়– তার মানে রোজগার বন্ধ হওয়া, ঘর ভাড়া দিতে না পারা, সন্তানদের জন্য দুধ কিনতে না পারা।
সেদিন দর্শকাসন থেকে ভেসে এসেছিল হাসির রোল। তারা চায় বিনোদন, চায় ‘পারফরম্যান্স’। কিন্তু মঞ্চে দাঁড়িয়ে একজন নারী হঠাৎ নিঃশব্দ হয়ে যান– তাঁর স্বর ভেঙে যায়, গলায় রক্ত জমাট বাঁধে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকে একটি পাঁচ বছরের শিশু– চার্লি। সে তখন নিজের মায়ের অপমান দেখে, অপারগতা দেখে, সমাজের নির্দয়-চোখ দেখে।
আর সেই ছোট্ট ছেলেটাই সেই মুহূর্তে উঠে যায় মঞ্চে। চার্লি সেই অসমাপ্ত গানের শেষ লাইনটা গাইতে শুরু করে– নিজের জন্য, মায়ের গলা হয়ে। কিন্তু তাতেই শুরু হয় এক ভিন্ন পথ– চার্লির নিজস্ব পরিণতির, আর হান্নার এক দীর্ঘ নিঃশব্দ পতনের। একজনের কণ্ঠ হারালে আরেকজনের কণ্ঠ তৈরি হয়– এই বিনিময়ই কি পিতৃতন্ত্র চায়? পুঁজিবাদ চায়? এক নারীর নীরবতাই কি পুরুষের কিংবদন্তির জন্ম দেয়?
আমরা তো প্রায়ই দেখি– নারীর কণ্ঠ বন্ধ হয়, আর তার জায়গায় তৈরি হয় পুরুষের ইতিহাস। একদিকে হান্নার নিঃস্বতা, অন্যদিকে চার্লির প্রতিভা। কিন্তু কে সেই ‘প্রতিভা’র ভিত্তি নির্মাণ করে? সমাজ কীভাবে ভাঙা গলাকে অপদার্থতা ভাবে, অথচ সেই কণ্ঠ হারানোর মধ্য দিয়েই তো তৈরি হয় এক ট্র্যাজিক মুখাভিয়ন। চার্লি নিজেই বলেছিলেন, ‘My mother taught me not through speech, but through silence.’
তাঁর ‘silence’-টা কীভাবে তৈরি হল? কে জানে?
চার্লির বয়স যখন মাত্র আট, যখন তাঁর মাকে প্রথমবার অ্যাসাইলামে পাঠানো হয়। মেডিক্যাল সার্টিফিকেটে লেখা হয়– ‘Hannah Chaplin is suffering from a mental disorder. She must be removed from home to an institution.’ কিন্তু কে লিখল এই সার্টিফিকেট? কারা সিদ্ধান্ত নিল যে হান্নার ‘চুপ করে থাকা’ পাগলামি, আর তাঁর দুঃখ, তাঁর গলা হারানো, তাঁর ক্লান্তি– সবই চিকিৎসার বিষয়?
১৮৯৮ সালে তাঁর নির্দিষ্ট ডায়াগনোসিস হয়: tertiary syphilis। মানে, শরীরের ভেতরে একটা দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ, যা একসময় স্নায়ুতন্ত্র, ভাষা ও মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। অনেকে বলেন, এই অসুখ হান্নার দক্ষিণ আফ্রিকার জীবনের ফল– সেই সময় তিনি গোল্ড রাশের দেশ উইটওয়াটারস্র্যান্ডে এক প্রেমিকের সঙ্গে গিয়ে প্রতারিত হন, নিরুপায় হয়ে পড়েন। কেউ বলেন, তিনি পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য হয়েছিলেন, কেউ বলেন এটা কুৎসা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে– একজন দরিদ্র, একক মা ও শিল্পীর কাছে আর কী বিকল্প ছিল?
জীবনের পরবর্তী সময়গুলোতে হান্না একটি ফাইল নম্বরে পরিণত হন। তাঁকে বারবার ভর্তি করা হয় Cane Hill Lunatic Asylum-এ। রোগীর নামের পাশে ওষুধের ডোজ লেখা থাকে, ঘুমের সময় নির্ধারিত হয়, কথা বলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিনি তখন আর মা নন, শিল্পী নন, এমনকী মানুষও নন– তিনি হয়ে ওঠেন একটি ‘প্রাতিষ্ঠানিক শরীর’।
চার্লি তখন ছোট্ট একটা খুপরিতে ভাই সিডনিকে নিয়ে বাস করছে, কখনও পিতৃস্থানীয়দের কাছে, কখনও স্ট্রিট পারফরম্যান্স করে। নিজের মায়ের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ দেখে সে শিখে নেয়– মানুষকে হাসানো মানেই বাঁচা, না হলে সমাজ তোমাকে সরিয়ে দেবে। চার্লির প্রতিটি চরিত্র– লিটল ট্র্যাম্প, ‘দ্য কিড’-এর কাঁদতে থাকা মা, ‘সিটি লাইটস’-এর নীরব ভালোবাসা– সব যেন একেকটা স্পষ্ট ইঙ্গিত হান্নার ছায়ার দিকে।
তবু প্রশ্ন থেকে যায়: কে শুনেছিল হান্নার গলা বসে যাওয়ার গল্পটা? কে শুনেছিল তাঁর দমবন্ধ করা চুপ করে থাকার ইতিহাস? তাঁর কণ্ঠ, তাঁর চাহিদা, তাঁর ইচ্ছা– সব যেন এতটাই অপ্রয়োজনীয় যে, তাঁর জীবন থেকেও সমাজ মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল।
এই জায়গাটাই খুব চিন্তার। কারণ আজও আমরা মানসিক সমস্যাকে বলি– ও তো ঠিকঠাক নয়। আমরা বলি– ও তো কিছুতেই খুশি না। কিন্তু আমরা ভাবি না– কোন পরিস্থিতি একটা মানুষকে কণ্ঠহীন করে দেয়? কীভাবে একটি নারী নিজের শেষ অবলম্বন– তাঁর কণ্ঠ হারিয়ে ফেলে সমাজের চাপ আর একাকিত্বের মধ্যে?
এই হান্না চ্যাপলিনদের গল্পই ভুলে যাই আমরা।
১৯২১ সাল। চার্লি তখন বিশ্বখ্যাত। নিজে ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকেন, স্টুডিও বানিয়েছেন, ট্র্যাম্প চরিত্র তখন সিনেমার ইতিহাসে এক কিংবদন্তি। সেই সময় তিনি নিজের মাকে ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকায় নিয়ে আসেন– সফরটা সহজ ছিল না, কারণ তখনও হান্না ছিলেন মানসিকভাবে অস্থির, তাঁর চিকিৎসা চলছিল।
তবে সেই সময় চার্লির একটা সিদ্ধান্ত আজও নারীবাদী ইতিহাসে এক দৃষ্টান্ত হয়ে রয়ে গেছে। তিনি হান্নার জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার সমুদ্রের ধারে একটা ছোট্ট বাড়ি কেনেন। সেখানে থাকতেন একজন প্রশিক্ষিত নার্স, আর এক দম্পতি, যাঁরা সারাক্ষণ তাঁর খেয়াল রাখতেন। হান্না পুরোপুরি সুস্থ হননি কখনও, কিন্তু জীবনের শেষ ক’বছর তিনি পেয়েছিলেন সেই নীরব সম্মান– যেটা তাঁর মঞ্চের জীবন তাঁকে দিতে পারেনি।
তবে সবচেয়ে স্পর্শকাতর ঘটনা ঘটেছিল একদিন লস অ্যাঞ্জেলেসের এক দোকানে। হান্না হঠাৎই প্রচুর রঙিন সিল্কের কাপড় কিনে ফেলেন– শত শত গজ সিল্ক, যেগুলো তিনি কোনও দিন ব্যবহার করবেন না, এমনটাই ছিল ধারণা। প্রথমে চার্লি এগুলো ফেরত পাঠাতে বলেন। পরে নিজেই থেমে গিয়ে বলেন– ‘Let her have all that and more… Let her have ten times what she ordered.’ তারপর কেঁদে ফেলেন।
এই ঘটনা ছোট হলেও, এর ভেতর লুকিয়ে থাকে একটা বিশাল প্রশ্ন: কেন একটা নারী, যিনি সারা জীবন শুধু সংগ্রাম করেছেন, হঠাৎ এত সিল্ক কিনে ফেলেন? কারণ তিনি ছোটবেলা থেকেই চেয়েছিলেন শিল্পী হতে, সাজতে, গান গাইতে, স্টেজে উঠতে। তাঁর কাছে সিল্ক মানে স্বপ্নের রং, যা তিনি কোনও দিন ছুঁতে পারেননি। চার্লি বুঝেছিলেন– এইসব ফ্যাব্রিক আসলে তাঁর মায়ের হারিয়ে যাওয়া পরিচয়ের টুকরো।
সেই জায়গাটাতেই চার্লি উত্তর দিয়ে ফেলেন– তিনি মায়ের ইচ্ছেকে ‘অবাস্তব’ না বলে, তাকে পূর্ণতা দেন। কারণ এতদিন তো সমাজ হান্নাকে কিছুই দেয়নি।
তবে এখানেই প্রশ্ন জাগে– আমাদের সমাজ আজও কি হান্নাদের কথা শোনে? যারা শিল্পী হতে চেয়েছিলেন কিন্তু দারিদ্র, পিতৃতন্ত্র, যৌন হিংসা, আর রাষ্ট্রীয় মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে চুপ করে গেছেন? আজও তো কত হান্না চ্যাপলিন আমাদের চারপাশে আছেন– যাঁদের কণ্ঠ ভেঙে গেছে, যাঁরা সাহায্য চায়নি কারণ জানতেন সাহায্য চাইলে আরও বড় শাস্তি আসবে।
এই লেখাটা তাই শুধু একটা মায়ের প্রতি উৎসর্গীকৃত নয়। এটা একটা নারীবাদী চাহিদা– একজন নারী, এক শিল্পী, এক মা, এবং এক সমাজের ভুলে যাওয়া শরীরের স্মৃতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা।
তাঁর মৃত্যুর গল্প যেন কোনও শেষাংশ নয়, বরং একটা অসমাপ্ত চিঠির মতো– যার শেষ লাইন আমরা এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছি।
হান্না চ্যাপলিন ১৯২৮ সালের আগস্ট মাসে ক্যালিফোর্নিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। চার্লি তখনও তাঁর ছায়া থেকে পুরোপুরি বেরতে পারেননি– বরং সেই ছায়াটাকেই সঙ্গী করে বানিয়ে চলেছেন একের পর এক ছবি, একের পর এক নায়িকা, একের পর এক ‘silent’ মুহূর্ত।
‘সিটি লাইটস’-এর শেষ দৃশ্যে সেই ফুলওয়ালি মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা ট্র্যাম্প চরিত্রটিকে যদি মনে করি– তাহলে বোঝা যাবে, হান্নার চোখের প্রতিফলন কীভাবে ফিরে ফিরে আসে চার্লির ছবিগুলোর ভেতরে। চার্লি নিজেই বলেছিলেন, “My mother’s eyes were the most haunting I have ever seen.” শুধু চোখ নয়, তাঁর মুখ, তাঁর নির্জনতা, তাঁর অসমাপ্ততা– সবই চলচ্চিত্রের পর্দায় ধীরে ধীরে নিজের রূপ নিয়েছে।
তাঁর মৃত্যুর সময় তাঁর আশপাশে ছিল একজন নার্স, আর চার্লি কেবল বলেছিলেন, Look up, Hannah– এই লাইনটাই পরে চলে আসে তাঁর সিনেমার এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে। এই ‘look up’ যেন কেবল একজন সন্তানের আহ্বান নয়, বরং ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে থাকা এক নারীবাদী প্রস্তাব– যেখানে আমরা সেইসব নারীদের দিকে তাকাই, যাঁরা মঞ্চে উঠতে চেয়েছিলেন কিন্তু পৌঁছতে পারেননি, যাঁরা গান গাইতে চেয়েছিলেন কিন্তু গলা বসে গিয়েছিল, যাঁরা সন্তানের মা হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সমাজ বলেছিল– উন্মাদ, অযোগ্য, অস্থির।
আমরা হান্নার কথা স্মরণ করি না। তাঁর কোনও বড় প্রতিমা নেই, তাঁর কথা কোনও স্কুলপাঠ্যে নেই, তাঁর গল্প কেবলই থেকে গেছে ব্যক্তিগত স্মৃতিতে, তাঁর ছেলেমেয়ের আত্মজীবনীতে, কিংবা কোনও সস্তা গসিপ ম্যাগাজিনে।
কিন্তু একজন নারীবাদী হিসেবে আমি এই লেখাটাকে শুধু শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে দেখি না। এটা আসলে এক দাবি– যে শিল্প আর স্মৃতির মধ্যে কোনও মা, কোনও নারীর কণ্ঠ যেন নিঃশব্দ হয়ে না যায়।
এটা হান্না চ্যাপলিনের জন্য লেখা, কিন্তু একইসঙ্গে সেইসব নারীদের জন্য, যারা কখনও ‘ভুল সময়’-এ জন্মেছেন, ‘ভুল সম্পর্ক’-এ আটকে পড়েছেন, ‘ভুল সমাজ’-এর সঙ্গে লড়েছেন।
আমি তাঁদেরই জন্য লিখি।
……………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন
……………………………..