আজ অ্যান ফ্রাঙ্কের জন্মদিন। মাত্র ১৬ বছর বেঁচেছিল অ্যান ফ্রাঙ্ক। সে জানিয়ে গেছিল গণহত্যার রোজনামচা। সেই ডায়েরির মুখোমুখি দাঁড়াতে কত মানুষ ভয় পেয়েছিল। আজও পায়। কিন্তু তবুও, গণহত্যা অব্যাহত। গাজায়, খান ইউসুফে, রাফায়। প্যালেস্তাইন দেশটা মানচিত্র থেকে মুছে দিতে শিশুদের গলা কেটে দিচ্ছে ইজরায়েলি সৈন্যরা। তবুও প্যালেস্তাইন আজ একটা অনুভূতির নাম, যেখানে ধ্বংস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়েও প্রতিবাদ জেগে ওঠে রোজ নতুন করে। অ্যান ফ্রাঙ্কও যেভাবে মারা যাওয়ার আগের দিন অবধি বেঁচে ছিল প্রতিবাদে ও ভালোবাসায়। অ্যান ফ্রাঙ্কের জন্মদিনে লেখা হল গাজার আসমা ফারুনের ডায়রি। পাঠক, আসমা ফারুনের ডায়েরির সামনে দাঁড়াতে পারবেন তো!
১০ অক্টোবর, ২০২৩
ঠিক এক ঘণ্টা সময় পেয়েছিলাম। এমনকী, বিকেল থেকে যখন বারবার টিভি নিউজ আর ওয়াটস আপ মেসেজে ‘এসকালেশন’, ‘আনসেফ জোন’ শব্দগুলো ঘুরে ফিরে আসছে তখনও বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু আব্বু যখন ঘরে এসে শান্ত গলায় বলল, ‘ব্যাগ গুছিয়ে নাও। শুধু সবচেয়ে জরুরি জিনিসগুলো নেবে। এক ঘণ্টার মধ্যে।’ আর ওমিও আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল ‘চল, একসঙ্গে গোছাই। হিসেব রাখতে সুবিধে হবে।’ তখনই বুঝেছিলাম, আসলে গাজায় স্বাভাবিক পরিস্থিতি বলে কিছু হয় না।
সবচেয়ে অসুবিধে হয়েছিল মানারাকে ক্যারিয়ার বাক্সে ঢোকাতে। এছাড়া আমি স্কুল ব্যাগ আর একটা ছোট ডাফেল ব্যাগ নিয়েছি। ওমি জোর করে চারটে পড়ার বই ঢুকিয়ে দিয়েছে। ঠিক দেড় ঘণ্টার মাথায় আব্বু বিল্ডিং-এর তলা থেকে ফোন করে বলল শিগগির নেমে আসতে। ট্যাক্সি অপেক্ষা করছে। দুটো সুটকেস, ওমির বিগশপার, মানারার ক্যারিয়ার– এই সব নিয়ে কোনওমতে সিঁড়ি বেয়ে নামলাম। বাকি ফ্ল্যাট থেকেও দলে দলে লোক নামছে। ভিড় ঠেলে আমরা যখন ট্যাক্সিতে উঠলাম, ততক্ষণে সাইরেনের আওয়াজ শুরু হয়ে গ্যাছে। অন্ধকারে অসংখ্য অলিগলি পেরিয়ে আমাদের ট্যাক্সি কোথায় যাচ্ছে বুঝিনি তখনও। প্রায় মিনিট চল্লিশেক চলার পর একটা উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে ট্যাক্সি থামল। দেখলাম দরজায় আহমেদ কাকু দাঁড়িয়ে। আহমেদ কাকু আব্বুর কলেজের বন্ধু। এর আগে বহুবার আমাদের বাড়িতে এসেছে। ট্যাক্সি থেকে নামতেই আহমেদ কাকু আব্বুকে জড়িয়ে ধরল। আর ঠিক তক্ষুনি প্রথম বোমাটার শব্দ পেলাম আমি।
১১ অক্টোবর, ২০২৩
ওপরে ওপরে সকলেই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। বিশেষত আমার সামনে। আহমেদ কাকু আর সারাহ কাকিমা এমনিতে যত্নের ত্রুটি রাখছে না। আমাদের তিনজনকে নিজেদের বেডরুম ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি ওমিকে রান্নাঘরে লুকিয়ে কাঁদতে দেখেছি। আমি জানি এক্ষুনি এক্ষুনি আমাদের বাড়ি ফেরা হবে না। বড়রা সারাদিন চেনা লোকেদের ফোন করে বাকিদের খবর নিচ্ছে। সুয়াদ আর হাইফাও নিজেদের বাড়ি ছেড়ে অন্যদের বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। আমাদের পাড়ার দিকটা নিরাপদ নয় একেবারেই। সারারাত কপ্টার আর বোমার শব্দ। তার সঙ্গে দূরে আগুনের শিখা। ঘুমোনো একপ্রকার অসম্ভব। কিন্তু আমি খুব কষ্ট করে ঘুমের ভান করে থাকলেও ওমি আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখে। হয়তো ওমির মন একটু ভালো করার জন্যই পড়ার বইগুলো নাড়াচাড়া করব ভেবেছিলাম। তখনই পিছনের চেন খুলতে বইটা আবিষ্কার হল। ‘দ্য ডায়রি অফ আ ইয়ং গার্ল’। আমার মনে পড়ল গত মাসে আমার জন্মদিনে বইটা আব্বু কিনে দিয়েছিল আমায়। স্কুলে বাকিদের দ্যাখাতে নিয়ে গেছিলাম। তারপর নিজেই ভুলে গেছি। কিন্তু এখন আর লেখা সম্ভব নয়। সাইরেনের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।
১৪ অক্টোবর, ২০২৩
হাইফা এর মাঝে ফোন করে খুব কান্নাকাটি করেছে। ও শুনেছে শেষ এয়ার রেডের পর ওদের বাড়িটাই আর নেই। সুয়াদ বলল ওরা রাফা চলে যাওয়ার কথা ভাবছে। আমি মন শান্ত করতে বইটা পড়ছি। সত্যি বলতে, আমার অ্যানকে হিংসে হচ্ছে খানিক। ওরা তো কতদিন ধরে পরিকল্পনা করে ওদের সব আসবাব আর ঘরের জিনিস একটু একটু করে অ্যানেক্সে নিয়ে আসতে পেরেছিল! আর আমরা পেয়েছি এক ঘণ্টা! মাত্র এক ঘণ্টায় কেউ পারবে নিজের গোটা অস্তিত্বকে একটা ঘর থেকে উপরে আনতে?
১৫ অক্টোবর, ২০২৩
আহমেদ কাকু বাজারে একটা লিফলেট কুড়িয়ে পেয়েছে। ওগুলো ইউনিকপ্টার থেকে ফ্যালে। জানলা দিয়ে আমিও দেখেছি। ওখানে আরবি আর ইংরেজিতে লেখা আছে সব্বাইকে গাজা শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে। আব্বু শহর ছাড়তে চায়। আহমেদ কাকুরা চায় না। ওমি ক্রমাগত পরিচিতদের ফোন করে জিজ্ঞাসা করছে সাউথ গাজায় তিনজনের মতো একটা থাকার জায়গা জোগাড় করা সম্ভব কি না। শেষটায় সারাহ কাকিমা, যাকে একদিনে একবারের জন্যও গলার স্বর তুলতে শুনিনি প্রায় চিৎকার করে ডুকরে উঠলো– ‘না আমি যাব না! আমি জানি, একবার চলে গেলে কেউ আর কক্ষনও ফেরত আসতে পারে না!’
২ নভেম্বর, ২০২৩
এই নিয়ে তিন নম্বর বাসা বদল। আব্বু কোনওমতে একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা করেছিল। গোটা রাস্তা জুড়েই মানুষের মিছিল। সবাই দক্ষিণে যাচ্ছে। মোটরে, না হলে গাধায় টানা এক্কায়, নয়তো স্রেফ পায়ে হেঁটে। আমরা এখন খান ইউসুফে। যাদের বাড়িতে উঠেছি তারা পরিচিতর পরিচিত। সব মিলিয়ে বাড়িতে সদস্য সংখ্যা ছয়। এঁরাও একটা আলাদা একচিলতে ঘর ছেড়ে দিয়েছেন। নতুন ঘটনা বলতে কারেন্ট নেই। তার মানে ফ্যান নেই, ফ্রিজ নেই, রাতে আলোও নেই। ওমি খুব করে বোঝাচ্ছে আমায়, তাও তো আমাদের স্কুল বা ক্যাম্পগুলোয় উঠতে হয়নি! সেখানে এক একটা ঘরে ৭০-৮০ জন মিলে গাদাগাদি করে থাকছে! আমার অসম্ভব কান্না পাচ্ছে। ভয় করছে তার চেয়েও বেশি। বইটা খুব অল্প অল্প করে পড়ছি। বা পড়ার চেষ্টা করছি। অ্যানও ভয় পাচ্ছে এখন। আমার কেনও বারবার মনে হচ্ছে, বইটা একবার ফুরিয়ে গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে?
৪ নভেম্বর, ২০২৩
গতরাতে মানারা পালিয়ে গেছিল। ওকে দোষ দেবই বা কী করে? বিড়াল তো বারবার নতুন নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে না! ওমিই প্রথম খেয়াল করে হাউমাউ করে উঠেছিল। তারপর অন্ধকারের পরোয়া না করেই বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা। মানারার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে, হোঁচট খেতে খেতে গলিতে ছুটছি আর বুকে যেন কেউ হাতুড়ি পিটছে! আশপাশের কয়েকটা বাড়ির জানলা খুলে দু’-একজন তখন চেঁচিয়ে বলছে, রাতে এভাবে বাইরে বেরনো কতটা বিপজ্জনক। কিন্তু মানারাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে, অন্য অনেকেই বেরিয়ে এল। শেষটায় পাশের বাড়ির একটা বাচ্চা ছেলে চিৎকার করে উঠল– ‘পেয়েছি! পেয়েছি!’ একটা গাড়ির নিচে ঢুকে ভয়ে কাঁপছিল বেচারি! আমি ছুটে গিয়ে কোলে তুলে নিলাম। মানারাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকার কথা ভাবতে পারি না আমি! অ্যান কী করে মুর্জেকে ফেলে এসেছিল? নেট থাকলে গুগল করতাম, ওয়াট হ্যাপেনড টু অ্যান ফ্রাঙ্কস ক্যাট?
১০ নভেম্বর, ২০২৩
অ্যানরা কেউ বাইরের খবর পেত না। আর আমি বাইরের কোনও খবর পেতে চাই না। কারণ গাজায় কোনও ভালো খবর নেই। কিন্তু না চাইতেও যতটুকু সময় নেটওয়ার্ক থাকে, ফোনে আর মেসেজে একের পর এক দুঃসংবাদ বিরামহীন ভাবে আসতেই থাকে।
সুয়াদ এসএমএস করে জানিয়েছে, ওর বাড়ির লোক দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবছে। সুয়াদের বাবার ডুয়াল সিটিজেনশিপ। আমি জানি না, ওর সঙ্গে আর কোনওদিন দেখা হবে কি না। তাও জোর করে কান্না চেপে লিখলাম, যে করে হোক চলে যাক। আমাদের তিন বন্ধুর কেউ একজন অন্তত নিরাপদে থাকুক! এক হপ্তা যাবৎ হাইফার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই।
২৩ নভেম্বর, ২০২৩
অবশেষে ‘সিজফায়ার’। সকলেই আশায় বুক বাঁধছে। হয়তো পরিস্থিতি বদলাবে ধীরে ধীরে! আজ ওমির সঙ্গে বাইরে বেরিয়েছিলাম। গোটা শহরটার চেহারাই হলিউডের ডিস্টোপিয়ান সিনেমার মতো। সমুদ্রের তীর লোকে লোকারণ্য। অনেকে ওই জলেই কাপড় কাচছে, বাসন মাজছে… এমনকী স্নানও করছে! পরিষ্কার স্নানের জল এখন বিলাসিতা। কিন্তু এসবের মধ্যেও পাঁচ-ছ’টা বাচ্চা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে! স্বাভাবিক ঘুড়ি নয়। খাতার পাতা ছিঁড়ে নাইলনের তার জড়িয়ে নিজেরাই বানিয়েছে! নীল আকাশে ওদের হোমওয়ার্ক উড়ছে! অ্যান যেন কী লিখেছিল আকাশ নিয়ে? আমস্টারডামে কি সমুদ্র আছে?
৩ ডিসেম্বর, ২০২৩
আমি জানি না, শেষ পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকব কি না। আমাদের ফ্ল্যাটে লোকসংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন ১২। তাও সেটা চরম সৌভাগ্যের ঘটনা কারণ, আমাদের এখনও রাস্তায় থাকতে হচ্ছে না। ক্যাম্পগুলোতেও আর জায়গা নেই। স্কুলগুলোর বাইরে হাতে লেখা নোটিশ ঝুলছে ‘জায়গা নেই। অত্যন্ত দুঃখিত’। আব্বু আর দু’জন সেই ভোরবেলা বেরিয়েছে রুটির খোঁজে। কপাল ভালো থাকলে পাঁচ ঘণ্টা, ছ’ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে হয়তো এক বেলার মতো কিছু একটা জোগাড় হবে। প্রায় প্রতিদিনই গড়ে একবেলা খাচ্ছি আমরা।
৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩
বইটা আজ শেষ হয়ে গেল। আজ বছরও ফুরোবে। গোটা পৃথিবীর প্রত্যেক কোণায় এখন নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর তোড়জোড় চলছে। গাজা বাদে। আমাদের কথা কেউ মনে রাখেনি। আমি জানি অ্যান শেষটায় ধরা পড়ে গিয়েছিল। আমিও কি ধরা পড়ে যাব? মোবাইলটা যদি উদ্ধার হয়? এই লেখাগুলো পড়লে কি বাকিদের গাজার কথা মনে পড়বে?
আজ আব্বু একটা মজার কাণ্ড করেছে। সন্ধেবেলা ওমিকে দিয়ে ক’টা মোমবাতি জ্বালিয়ে দুই হাত উঁচু করে লিভিংরুমে এসে বলছে ‘সারপ্রাইজ! এই হল আমাদের নিউ ইয়ার্স ইভের ইনভিজিবল কেক!’ আমি ভেবেছিলাম বাকিরা এসব ছেলেমানুষিতে খুব বিরক্ত হবে। কিন্তু দেখলাম সকলেই হাসছে! আমারই বয়সি একটা ছেলে, কোত্থেকে এক প্যাকেট উনো কার্ড জোগাড় করেছে। আর একজন তিনটে পাড়া উজিয়ে একজনের সোলার প্যানেলে একটা ব্লু টুথ স্পিকার চার্জ করে এনেছে। অদৃশ্য কেক সমেত পার্টি জমেই গেল শেষমেষ। সুয়াদ একটা ছবি পাঠিয়েছিল ওয়াটসআপে। বলল নেদারল্যান্ডের কোনও এক শিল্পীর কাজ। দুই ঘণ্টা লাগল লোড হতে। দেখলাম ওটা অ্যান ফ্রাঙ্কের ছবি। আর অ্যানের গলায় অভ্রান্তভাবে পেঁচিয়ে রাখা একটা টকটকে লাল আর সাদা চেক তোলা প্যালেস্তাইনের কেফিয়া স্কার্ফ। আর জানি না কেন, অ্যাদ্দিনে এই প্রথম একদম বাচ্চাদের মতো ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললাম আমি!
(ঋণস্বীকার: সুয়াদ আমিরি, যাঁর লেখা না পড়লে আসল প্যালেস্তাইনকে চিনতাম না কোনও দিন।
মোহাম্মদ মুসা আর ‘গাজা পোয়েটস সোসাইটি’র বাকি সদস্যরা, আক্ষরিক অর্থেই ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কবিতা লেখা কাকে বলে যাঁদের থেকে প্রতিদিন নতুন করে শিখছি।
জিয়াদ, যাঁর ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত ‘গাজা ডায়রি’-র ৪৮ টি কিস্তি এ লেখায় বর্ণিত ঘটনাপরম্পরার মূল অনুপ্রেরণা। )