
রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিতে যেসব ভাষ্য উঠে আসে সেখানে মনে পড়ে যায়– ‘জিন্দান কি এক শাম’ বা ‘না গাওয়াও নাওকে নিম কশ’-এর মতো ওঁর লেখা যেগুলো রাষ্ট্রের হাতে অন্যায়ভাবে বন্দি মানুষের মুক্তির কথা বলে। কয়েক বছর আগে, একজন বন্দির মুক্তির দাবিতে আয়োজিত ওয়েবিনারের শিরোনাম ছিল, ‘চন্দ রোজ অউর’। নিজে জেলবন্দি থাকাকালীন লিখেছিলেন এই কবিতা। বন্দিদশার যন্ত্রণা এবং একইসঙ্গে আগত দিনের জন্য আশা রাখা– দুইয়ের অনুভূতিই কবিতাটার মধ্যে ধরা পড়েছে। এখানে অবশ্যই উল্লেখ্য, ১৯৭৬-এ নাইয়াজ নূরের কণ্ঠে রেকর্ড করা গান ‘আজ বাজার মে পা বজোলাঁ চলো’।
ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে, রুখে দাঁড়ানো একদল মানুষ, অধিকাংশই ‘গণিকা/বাইজি’, তাঁদের বসবাস আর ব্যবসার এলাকা ‘হীরামণ্ডি’-কে (লাহোরের এক নিষিদ্ধপল্লি) বাঁচিয়ে রাখতে একজোট হয়েছেন– মশাল জ্বালিয়ে, তেরঙা পতাকা উড়িয়ে, মিছিলে হাঁটছেন গান গাইতে গাইতে ‘হমে দেখনি হ্যায় আজাদি’। সঞ্জয় লীলা বনশালি পরিচালিত নেটফ্লিক্সে মুক্তিপ্রাপ্ত সিরিজ ‘হীরামণ্ডি’র (মে, ২০২৪) ক্লাইম্যাক্সে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে, বলা ভালো শুনতে শুনতে, অনেকেরই মনে পড়বে, ফৈয়জ আহমেদ ফৈয়জের লেখা, ইকবাল বানোর গাওয়া ‘হাম দেখেঙ্গে’ গজলটির কথা, যাকে বলা হয় ‘অ্যান্থেম অফ প্রোটেস্ট’। একথাও বলা যায় যে, ফৈয়জের নামের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে ‘হাম দেখেঙ্গে’। এই গান আজ কিংবদন্তি। কেন, কীভাবে তৈরি হয়েছিল গানটি, কীভাবে পারফর্মড হয়েছিল, এই ইতিহাস অনেকেরই জানা। ১৯৪৭-এর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিকায় বানানো আখ্যান বলতে গিয়ে ১৯৮৫ সালের এই গজল ঢুকে পড়ছে স্থান-কালের হিসেব গুলিয়ে দিয়ে, এমনই এই অ্যান্থেমের জোর। কলেজ-ইউনিভার্সিটির ফেস্ট বা ছাত্র-আন্দোলন, মিটিং, মিছিল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বন্ধুবান্ধবের আড্ডা, নানারকম পরিসরে অসংখ্যবার গাওয়া হয়েছে এই গজল– সেই অগণিত ‘শোনার’ স্বাদকে খানিক উসকে দেওয়ার জন্যই বনশালির এই নির্বাচন। বিস্তর বাকবিতণ্ডাও চলেছে গজলটিকে নিয়ে, কিন্তু সেদিকে আর কথা এগব না। ‘হাম দেখেঙ্গে’কে একটু সরিয়ে রেখে ভাবার চেষ্টা করব– মৃত্যুর ৪১ বছর পরও, ফৈয়জকে আমরা আজ কেন পড়ব? কেন শুনব তাঁর গান?

আমি কত্থক-শিল্পী হিসেবে সবচেয়ে বড় যে সংকট অনুভব করি তা হল, ইতিহাস থেকে মুঘলদের কথা মুছে দেওয়ার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, মুসলমান ধর্মাবলম্বী বলে বহু শিল্পীদের অবদান ভুলিয়ে দেওয়ার প্রয়াস, উর্দু-আরবি-ফারসি ভাষার প্রতি অবজ্ঞা আর বিদ্বেষ বাড়িয়ে তোলার পরিকল্পিত প্রচেষ্টা। দেশে ইসলাম-বিদ্বেষের আবহে তাহলে কত্থকের ইন্দো-ইসলামিক মেলবন্ধনের কথা বলব কীভাবে? এই নিয়ে খুব সরব হতে দেখি না বেশিরভাগ শিল্পীদের! কিন্তু ভুলিয়ে দেওয়ার জিনিসগুলোকে আরও বেশি করে আগলে রেখে, সদা স্মরণে রাখার চর্চায় ব্রতী থেকেই এর একপ্রকার মোকাবিলা করা যেতে পারে। তাই কলকাতার একটি কত্থক প্রতিষ্ঠান, ‘বৃন্দার’-এর ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে সদ্য অনুষ্ঠিত উৎসবে তৎকার-প্রিমেলূর মতো কত্থকের ‘ট্র্যাডিশনাল’ উপকরণের পাশাপাশি ফৈয়জের গানের পারফরম্যান্স হতে দেখে, উৎসাহ বাড়ে!
২০০৮ সালের এক অনুষ্ঠানের স্মৃতি ফিরে আসে। কলকাতার উইভারস স্টুডিও-তে পল্লবী চক্রবর্তী (সোওর্থমোর কলেজে ডান্স স্টাডিজের শিক্ষক ও কত্থক শিল্পী), ফৈয়জের ‘গুল হুই যাতি হ্যায়’ গজলে নেচেছিলেন। কয়েক বছর আগে, কাজাকিস্তানে ভারতীয় দূতাবাসে নৃত্য-শিক্ষিকা হিসেবে চাকরি করা কালীন এক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিপর্বে আমাকে জানানো হয়, ফৈয়জের গানে নাচা যাবে না! মিটিং করেও গোল মিটছে না দেখে, আমি শেষে (খানিক রেগে) রাহাত ফতেহ আলির গানে নাচ করে অনেক প্রশংসা কুড়োই। পাঠকগণ রগড়টা আপনারা নিজ দায়িত্বে বুঝে নিন। আমি বিগত কয়েক বছর ধরে নিজের মতো করে ফৈয়জের (এবং অন্যান্য উর্দু-আরবি-ফারসি টেক্সট) কবিতা-গজল নিয়ে নাচ শেখানো এবং পারফর্ম করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, বিস্মৃতি থেকে বাঁচতে।
আসলে একজন কমিউনিস্ট, মার্ক্সিস্ট, জেল-খাটা, নির্বাসনে থাকা, রাজনীতি করা মুসলমান ব্যক্তির ‘পাকিস্তানি’ পরিচয়টাই বাকি সব পরিচয়গুলোকে গৌণ করে দেয়! একজন স্বঘোষিত বামপন্থী, যিনি কিছু সমালোচকের মতে, পরবর্তীকালে ইসলামীয় সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলেন, বামপন্থার স্পেকট্রামে তাঁর অবস্থান নিয়ে নানা মতানৈক্য চলবেই, কিন্তু যাঁর কলমে বারবার উঠে এসেছে শোষিতদের কথা, স্বৈরাচারীর বিরোধিতার কথা, আজকের ভারত তথা সমগ্র বিশ্বে তাঁর কাজ ফিরে ফিরে আসবেই আমাদের কাছে।

রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিতে যেসব ভাষ্য উঠে আসে সেখানে মনে পড়ে যায়– ‘জিন্দান কি এক শাম’ বা ‘না গাওয়াও নাওকে নীম কশ’-এর মতো ওঁর লেখা যেগুলো রাষ্ট্রের হাতে অন্যায়ভাবে বন্দি মানুষের মুক্তির কথা বলে। কয়েক বছর আগে, একজন বন্দির মুক্তির দাবিতে আয়োজিত ওয়েবিনারের শিরোনাম ছিল, ‘চন্দ রোজ অউর’। নিজে জেলবন্দি থাকাকালীন লিখেছিলেন এই কবিতা। বন্দিদশার যন্ত্রণা এবং একইসঙ্গে আগত দিনের জন্য আশা রাখা– দুইয়ের অনুভূতিই কবিতাটার মধ্যে ধরা পড়েছে। এখানে অবশ্যই উল্লেখ্য, ১৯৭৬-এ নাইয়াজ নূরের কণ্ঠে রেকর্ড করা গান ‘আজ বাজার মে পা বজোলাঁ চলো’।
দাঁতের যন্ত্রণায় ভুগতেন ফৈয়জ। একবার জেল থেকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওঁকে। টাঙ্গাতে বসে আছেন, হাত বাঁধা, সঙ্গে পুলিশ। জনবহুল রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় লোকে তাঁকে চিনে ফেলে, হাত নাড়ে, শুভেচ্ছা জানায়– এ দৃশ্যই পরে ফৈয়জের কলমে উঠে এসেছে, যেখানে তিনি সরাসরি রাস্তায় নামার ডাক দিচ্ছেন। এই গজলটিরও অনেক রেন্ডিশন পাওয়া যায়। কয়েকটা জনসভায় এটিতে পারফর্ম করার সুযোগ আমার ঘটেছে।

মনে রাখতে হবে, জেলের মধ্যেও হত মুশায়েরা, যেখানে ফৈয়জ নিজের লেখা কবিতা পাঠ করতেন। কিন্তু সেই লেখায় কোনও উসকানি বা সরকারের বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্রের আভাস আছে কি না, তা আগে খতিয়ে দেখতেন জেলের বড়বাবুরা, তারপর মিলত মুশায়েরার অনুমতি। গবেষকদের মতে, ‘গুলোঁ মে রং ভরো’ এমনই একটি কবিতা (পরে গজল তৈরি হয়) যেখানে আপাতদৃষ্টিতে প্রকৃতির কথা বলছেন, নানা রঙে সাজিয়ে তুলতে বলছেন চারপাশ, অথচ তার মধ্যেই নিহিত, একজোট হয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সংকেত, জেল-ফেরত আবার তাঁর কমরেডদের সঙ্গে মিলিত হবেন, সেই বার্তাই! মেহেদি হাসানের কণ্ঠে এই গজল চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
‘গুলোঁ মে রং ভরে
বাদ-এ-নৌ বাহার চলে
চলে ভি আও কে
গুলশন কা কারোবার চলে’
‘হ্যামলেট’-এর অ্যাডাপ্টেশনে বানানো, বিশাল ভারদ্বাজের ফিল্ম ‘হায়দর’-এ, রূহদার, হায়দারকে তার নিখোঁজ পিতার সন্ধানে সাহায্য করার ইঙ্গিত দিয়ে, সত্যর উদ্ঘাটনে উৎসাহিত করে পথে নামার কথা বলতে গিয়ে, এই গানের পঙ্ক্তিগুলো বিড়বিড় করে। এই ছবিরই শেষে, টাইটেলে রেখা ভারদ্বাজের কণ্ঠে বেজে ওঠে ফৈয়জেরই আরেকটি নজম ‘আজকে নাম’ (‘ইন্তিসাব’ শীর্ষক নজম যার অর্থ ‘উৎসর্গ’)। এই মর্মন্তুদ গান, গল্পের ট্র্যাজেডির শিকার সব চরিত্রদের উদ্দেশে গাওয়া, যা একাধারে কাশ্মীরের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর অশান্তির ফলস্বরূপ নিত্যদিনের ট্রাজেডির মধ্যে বাস করা কাশ্মীরিদের প্রতি উৎসর্গ করা গানও বটে– ‘উন বেওয়াও কে নাম’, ‘উন হাসিনাও কে নাম’, ‘পঢ়নেবালো কে নাম…’।

আবার এই নজমে যখন পড়ছি– ‘উন দুখি মাওঁ কে নাম/ রাত মে জিনকে বচ্চে বিলকতে হ্যাঁয় আউর/ নিন্দ কি মার খায়ে হুয়ে বেযুবাঁ সে সম্ভলতে নেহি/ দুখ বতাতে নেহি…’ তখন প্যালেস্টাইনের গণহত্যার বলি আর রিফিউজি ক্যাম্পে থাকা মানুষগুলোর যে ভিডিও রোজ ভেসে আসছে সোশ্যাল মিডিয়াতে, তাদের কথাই অব্যর্থ মনে পড়ছে। প্যালেস্টাইনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে রেডিও আলহারার জন্য রেকর্ড করা, বেথলহেম থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল ফৈয়জের নির্বাচিত কিছু গান।
মনে রাখতে হবে, ১৯৪৭-’৪৮-এর দেশভাগের সময়, দাঙ্গা-বিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে এবং কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে যে হানাহানি, তার প্রেক্ষিতে লেখা ‘সুবহা-এ-আজাদি’, যেখানে এই ঝুটা আজাদির তীক্ষ্ণ সমালোচনায় বলছেন–
‘আভি গিরানি-এ-শব মে কমি নেহি আয়ি
নিজাত-এ-দিদা-ও-দিল কি ঘড়ি নেহি আয়ি
চলে চলো কে বোহ মঞ্জিল আভি নেহি আয়ি’
এর প্রায় ৬০ বছর পর গোধরা দাঙ্গার ওপর বানানো নন্দিতা দাসের ফিল্ম ‘ফিরাক’-এ (২০০৮), খানসাহেবের (নাসিরুদ্দিন শাহ) গলায় আরেকবার শুনব সুবহা-এ-আজাদি কবিতা।

প্রেমের ভাষ্যেও ফৈয়জের উজ্জ্বল উপস্থিতি যেমন– ‘দশ্ত-এ-তনহাই’, ‘ভুলি বিস্রি চন্দ উমিদেঁ’, ‘ইয়ে জফা-এ-গম কা চারা’, ‘ইঁউ সজা চাঁদ’ ইত্যাদি। মেহেদি জাহিরের সুর দেওয়া, ‘ইয়াদ’ নজম-এ বিরহের এমন তীব্র আকুতি যা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে শ্রোতাদের মনে। ইকবাল বানো বা টিনা সানির মতো গজল-শিল্পী থেকে, মিশা শফির মতো অভিনেত্রী-মডেল, এই শিল্পীদের রেন্ডিশনে গানটা শুনতে পাওয়া যায়। জেলবন্দি একজন, আর তার বাইরে থাকা মানুষের থেকে বিচ্ছেদ, কোভিডের সময় বিচ্ছিন্ন থাকা পরিবারের লোকেদের একে অপরের থেকে বিচ্ছেদ, পেটের দায়ে ঘরছাড়া পরিযায়ী শ্রমিকের বিচ্ছেদ– ‘দশ্ত-এ-তানহাই’-এ বর্ণিত বিরহ এই প্রতিটা বিচ্ছেদের অভিঘাত নিয়ে আসে আমার কাছে।
আমরা যারা ফৈয়জের লেখা পড়ি/ শুনি সবাই– ভাষাটা পুরোপুরি সবসময় বুঝে উঠতে পারি, তা কিন্তু নয়। তাহলে বোঝাপড়াটা হয় কী করে? সেটা হয় কারণ আমাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতায়– সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা, স্বৈরাচারের বিরোধিতা, মজদুর-আন্দোলন, ছাত্র-আন্দোলন, প্রান্তিক মানুষদের নিপীড়ন, জনসংহতি, আশা-নিরাশা, গ্লানি, ক্রোধ, ভালোবাসা এসব অনুভূতি খুঁজে পাই ফৈয়জের লেখায়। বই-ফিল্ম-টিভি-থিয়েটার-সোশাল মিডিয়া-জমায়েত-আড্ডা থেকে পরিচয় হয় ফৈয়জের সঙ্গে, ধীরে ধীরে একাত্মতা গড়ে ওঠে। তাই ২০২৪-এর মে দিবসের উদ্যাপনে, এ এম কয়ার, মিউজিক ভিডিওতে গেয়ে ওঠে ‘আজ বাজার মে’, ২০২০ সালের আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসে, অধ্যাপক তৈমুর রেহেমানের ইউটিউব চ্যানেলে দেখি-শুনি ‘ইন তারিখ রাঁহো পে’ গানটি। কত্থকের ছন্দময় বোল যেমন আবেশ তৈরি করে, ফৈয়জের লেখাও তেমন অমোঘ হয়ে আসে আমার কাছে, যখন উনি বলেন–
‘বোল কে লব আজাদ হ্যায় তেরে
বোল জুবাঁ অব তক তেরি হ্যায়’
………………………
রোববার.ইন-এ পড়ুন শ্রুতি ঘোষ-এর লেখা
………………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved