ঠেলাঠেলি চলত। চলত হাসাহাসি। কে কার অবিচুয়ারি লিখবে। বেশ জমিয়ে! এই ক’দিন আগে রাহুল যখন মধুসূদনের নামাঙ্কিত সম্মাননা পেল, আমি ঝাঁঝিয়ে উঠে বললাম, টুপিতে তো ক্রমাগত পালক জুটছে, অতশত মনে রেখে তোর অবিচুয়ারি আমি লিখতে পারব না বাপু! আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাসী নই। তবে এটা ভাবতে ভালো লাগে, রাহুল, জয়দেব এরা মিলে প্রাক্ শরতের রুপোলি মেঘে বসে বসে ছিপ ফেলছে। ফাতনা নড়লেই গভীর দৃষ্টিপাত। কোন বন্ধুটি উঠে আসবে এবার মেঘে। তারপর নরক, সরি, স্বর্গ গুলজার হবে!
প্রচ্ছদের ফোটোগ্রাফ: সন্দীপ কুমার
স্মৃতিতে আজকাল বড় কুয়াশা নামে। তবু দেখতে পেয়ে যাই কুয়াশার পথ চিরে চিরে কাদাজল ভেঙে লাফাতে লাফাতে রাহুল আসছে আমার ঈশ্বরচন্দ্র নিবাসের আস্তানার দিকে। সেটা, ১৯৯০। মা চলে যাওয়ার পর আমার প্রথম জন্মদিন। বারান্দায় আছি। বিষণ্ণতায় আছি। রাহুল এল। তুমুল হুল্লোড় তুলে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল… অন্তত এই ছবিটার স্মৃতি প্রতারক হবে না আমার মৃত্যু অবধি।
এ পর্যন্ত লিখলাম ঘোরের মধ্যে। কারণ, ২৫ জুলাই, দুপুরবেলায় রাহুল, রাহুল পুরকায়স্থ কোথায় একটা যেন চলে গেছে। ওর শাসন, তর্জনগর্জন, আক্রমণ ও আদরের মুঠি আলগা করে দিয়ে চলে গেছে।
আলাপ হয়েছিল সে কতকাল আগের কথা! আমি বলেছিলাম, বিয়েতে নেমন্তন্ন করলে না তো? মুচকি হেসে বেশ ভদ্রসভ্য ভাবেই (তখনও বন্ধু হইনি যে) সে বলল, ‘পরেরবার করব।’ ব্যস, ওই শুরু!
যেমন লগ্নে থাকে চাঁদ, তেমনই ওর লগ্নে আছে কবিতা। লেখায়। নেশায়। আর আছে মস্ত বড় দীঘির মতো একটা হৃদয়। অল্পবিস্তর ইগোও আছে বইকী। অসম্মান বিন্দুমাত্র সইতে পারে না ও। তাতে যদি আখেরে ক্ষতি হয়, হোক! আর আমরা, মানে ওর খুব কাছের বন্ধুদের, কারও প্রতি কিংবা কোনও প্রতিষ্ঠানের প্রতি হাবভাব যদি ওর নির্লজ্জ বলে ধারণা হয়, সামনে থাকলে তখনই, না-হলে ফোন করে গালাগালির বন্যা বইয়ে দেবে। হ্যাঁ, কথা-কাটাকাটি থেকে মুখ দেখাদেখি বন্ধ তো আমাদের প্রায়শই হয়ে থাকে। আবার কোনও এক আয়োজনে দেখা হল। তখন আবার আমরা নতুন করে বন্ধু হয়ে গেছি!
যেদিন ঘুম ভেঙে বাসিমুখে টেলিফোনে কবিতা শোনাত রাহুল, কান সজাগ রেখে শুনতাম। একটাও কথা যাতে ফসকে না যায়। শুনতাম আর আমার সকাল, আস্তে, ফুটে উঠত গুর্জরি টোড়ির মতো। না, ওর কবিতা কেমন, কীভাবে ওই সমাসবদ্ধ শব্দের মধ্যে দিয়ে তরঙ্গ লাফিয়ে ওঠে, নশ্বরতা থেকে নব ঐশ্বর্যে গমন করে, তা নিয়ে কিছু বলতে চাই না আমি। মূল্যায়নের জন্য পণ্ডিতরা আছেন। তরুণ কবিরাও নিশ্চিতভাবে আছেন।
সামনে গন্তব্য নেই। বেবিফুড কিনে বাড়ি ফিরে আসা নেই। প্রিমিয়াম গোনা নেই, কিন্তু এসবের থেকে মুখ ফিরিয়েও সামাজিক ভূমিকা, রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য লেখা বেঁচে আছে। আছে শুধু অহোরাত্র কবিতাজীবন। কবিতা রাহুল পুরকায়স্থকে অনেক দিয়েছে। আলোর ফুলকির মোরগের মতো পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় সোনারং ঢেলেছে। কিন্তু খেয়ে নিয়েছে অনেকখানি আয়ু।
বলছিলাম রাহুলের মস্ত হৃদয়ের কথা। যার ৯০ ভাগ জুড়ে আছে বন্ধুবান্ধব। মাসিমা মানে, রাহুলের মা বলতেন, অনেক ছোটবেলায় বন্ধুদের বাড়িতে আসতে বারণ করলে ও কেঁদে ফেলত। ওর বারোমাস্যায় কত যে দিনযাপন ও নিশিযাপন, শুধুই বন্ধুদের সঙ্গে। একদিন দুপুরে খাওয়ার সময় মাসিমা কিছু না ভেবেই মাছের একটু ছোট টুকরো দিয়ে ফেলেছিলেন আমার পাতে, রাহুল খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়ে আর কী! এই গোঁয়ারগোবিন্দ বন্ধুটির জন্য তখন আমার অপ্রস্তুতের একশেষ অবস্থা! আমরা বলতাম, রাহুলের বাড়ি তো নয়, ধর্মশালা! যখন খুশি যে কেউ আসছে। খাচ্ছে। উৎকৃষ্ট গানবাজনা শুনছে, রাতে ঘুমিয়েও পড়ছে নির্বিকার চিত্তে!
একসময় ওর অফিস আর আমার অফিস কাকতালীয়ভাবে কাছাকাছি ছিল। তো, পাশের পানশালাতে আমরা দু’টিতে গুটিগুটি গিয়ে বসতাম। মদ্যপরিবেশনকারী প্রৌঢ় আমাদের এত ভালোবেসে ফেলেছিলেন, ব্যাপারটা যখন রুটিনে দাঁড়াল, তখন গেলেই তাড়াতেন। এখন না, এখন না, তোরা সন্ধের পর আসবি।
………………………………
আরও পড়ুন হিরণ মিত্র-র লেখা: রাহুল যে অর্থে কবি, আমি হয়তো সেই অর্থে শিল্পী
………………………………
ঠেলাঠেলি চলত। হাসাহাসি চলত। কে কার অবিচুয়ারি লিখবে। বেশ জমিয়ে! এই ক’দিন আগে রাহুল যখন মধুসূদনের নামাঙ্কিত সম্মাননা পেল, আমি ঝাঁঝিয়ে উঠে বললাম, টুপিতে তো ক্রমাগত পালক জুটছে, অতশত মনে রেখে তোর অবিচুয়ারি আমি লিখতে পারব না বাপু!
আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাসী নই। তবে এটা ভাবতে ভালো লাগে, রাহুল, জয়দেব এরা মিলে প্রাক্ শরতের রুপোলি মেঘে বসে বসে ছিপ ফেলছে। ফাতনা নড়লেই গভীর দৃষ্টিপাত। কোন বন্ধুটি উঠে আসবে এবার মেঘে। তারপর নরক, সরি, স্বর্গ গুলজার হবে!
স্মৃতি জমে জমে ফুল হয়। সেই ফুলে মালা গেঁথে আজ রতনবাবুর ঘাটে রাহুলকে পরিয়ে দিলাম।
পুনশ্চ: খেয়াল করলাম, এই লেখায় অতীত ক্রিয়াপদ ব্যবহার করিনি বললেই চলে। আমার অজান্তেই বুঝি!
…………………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
…………………………………..
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved