Robbar

‘রাশভারী বাবা’ই কমল মিত্রর একমাত্র পরিচয় নয়

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 8, 2025 9:12 pm
  • Updated:December 9, 2025 1:04 am  

১৯১২ সালে, ৯ ডিসেম্বর, জন্মেছিলেন অভিনেতা কমল মিত্র। তিনি ‘নায়ক’ ছিলেন না ঠিকই। কিন্তু পর্দায় তাঁর আবির্ভাব বহু নায়কের উপস্থিতিকেই ম্লান করে দিত। কমল মিত্র যেসব ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, সে সবক’টিতেই তিনি ছিলেন অবিশ্বাস্যরকম বিশ্বাসযোগ্য! কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘টাইপকাস্ট’– রাশভারী বাবার রোলে। জন্মদিনে, তাঁকে সমগ্রতায় দেখার এক চেষ্টা।   

আবীর ভট্টাচার্য

উচ্চতায় ছ’-ফিট-দুই ইঞ্চি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো চুল, মুখে পাইপ, পরনে আজানুলম্বিত ড্রেসিং গাউন কিংবা স্যুট-প্যান্ট, আর সেই সঙ্গে গমগমে কণ্ঠস্বর: এইটুকু বিবরণ শুনলে পুরনো বাংলা ছবির যে কোনও ভক্ত এক ঝটকায় ধরে ফেলবেন কার কথা বলা হচ্ছে! তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের এক অনন্য আইকন কমল মিত্র, পর্দার ওপর যার দাপটে এক সময় বাঘা বাঘা শিল্পীদের তটস্থ হয়ে থাকতে হত।

তাঁর চেহারা, অভিনয়, হাঁটা-চলা, কথাবার্তায় ছিল এমন এক ঋজু ব্যক্তিত্বের দাপট ও আভিজাত্য, যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাবার চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে কমল মিত্রের জুড়ি মেলা ভার ছিল। ব্যক্তিজীবনে কমলবাবুর সঙ্গে তাঁর এই অন-স্ক্রিন অবতারের খুব বেশি ফারাক ছিল না, বিশেষত বাচনভঙ্গি ও কড়া ধাতের দিক দিয়ে। অভিনেতার স্ত্রী অর্চনা দেবী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি বলতুম তোমাকে তো অভিনয় করতে হয় না, তুমি বাড়িতে যা ফিল্মেও তাই।’

চলচ্চিত্র জগতে কাউকে ‘টাইপকাস্ট’ করতে বিশেষ দেরি লাগে না। কমল মিত্রও তার ব্যতিক্রম নন। প্রায় দুশোরও বেশি ছবি করা এই অভিনেতাকে বারবার সেই রাশভারী পিতার ভূমিকাতেই দেখা গিয়েছে। এর সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ বোধহয় ‘দেয়া নেয়া’, যেখানে তাঁর অভিনীত চরিত্র শিল্পপতি বি.কে. রায় নিজের একমাত্র ছেলেকে গান গাওয়ার অপরাধে বাড়ি থেকে বের করে দেন। এর বাইরে উল্লেখ করা যেতে পারে ‘সাবরমতী’-র, যেখানে তাঁর শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে কন্যা সুপ্রিয়া দেবী বাড়ি ছেড়ে পালায়; আবার ‘পিতাপুত্র’-এ দীর্ঘ ভুল বোঝাবুঝির শেষে তিনি পুত্র স্বরূপ দত্তকে এক থাপ্পড় মেরে বুকে জড়িয়ে ধরেন। রামমোহনের নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পিতা রামকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়– যে ছেলের ধর্মীয় মতাদর্শ এক মুহূর্তও সহ্য করতে পারেন না– সেই ভূমিকাতেও যথারীতি তিনিই। দীর্ঘ বিরতির পর তরুণ মজুমদারের ডাকে তিনি শেষবারের মতো ফিরেছিলেন যে ছবির মাধ্যমে, সেই ‘খেলার পুতুল’-এও তিনি সেজেছিলেন নায়কের চিরচেনা কঠোর বাবা। 

‘খেলার পুতুল’- জীবনের শেষ অভিনয়

খুঁজে বেড়ালে এরকম উদাহরণ মিলবে বিস্তর, কিন্তু সত্যিই কি তিনি শুধু সেই জাঁদরেল বাবার ভূমিকাতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন? একটু ফিরে তাকালেই বোঝা যাবে– এই অনমনীয় পিতার কাঠামোর আড়ালে লুকিয়ে আছে তাঁর অজস্র বৈচিত্রময় চরিত্রাভিনয়। যেমন চলচ্চিত্রে, তেমন মঞ্চে।

অভিনয়ের জগতে তাঁর প্রথম পাঠই এসেছিল নাট্যমঞ্চ থেকে। থিয়েটারের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা এমন পর্যায় ছিল যে, বাবার দাহকার্য সেরে শ্মশান থেকে ফিরে তিনি ‘স্টার’-এর ডাবল শো করতে মঞ্চে উঠেছিলেন। স্টুডিওপাড়ায় অতি পরিচিত মুখ হয়েও তিনি স্বেচ্ছায় শিশিরকুমার ভাদুড়ির ‘শ্রীরঙ্গম’-এ প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে যোগ দেন, শুধুমাত্র নিজেকে আরও শাণিত করে তুলতে। সেখানে নাট্যাচার্য্যের কাছে নিয়ম করে শিখেছিলেন শেক্সপিয়র, ব্ল্যাঙ্ক ভার্স পড়ার কৌশল ইত্যাদি।

অভিনয় জীবনের একেবারে শুরু থেকেই কমলবাবু নিজের সক্ষমতা ও অক্ষমতা– দুইয়ের ব্যাপারেই ভীষণ সচেতন ছিলেন। চিরাচরিত নায়কের চরিত্রে তাঁর কোনও দিনই তেমন আগ্রহ ছিল না। ‘কমলবাবু, আপনি কোনও দিন নায়ক করবেন না, ওতে আপনাকে মানাবে না। আপনি চরিত্রাভিনয় করবেন।’ দেবকী বসুর দেওয়া এই স্পষ্ট উপদেশ তিনি মনের গহীনে চিরদিনের জন্য গেঁথে নিয়েছিলেন। 

‘সব্যসাচী’র হিন্দি ভার্সনের বিজ্ঞাপন

অনুভা গুপ্তর প্রথম ছবি ‘সমর্পণ’ (১৯৪৯)-এ তিনি ঈষৎ রোম্যান্টিক চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বটে, কিন্তু খাতায়-কলমে নায়ক হলেও তাঁর বেশিরভাগ ভূমিকাই ছিল প্রথাগত নায়কসুলভ ছাঁচের বাইরে। যেমন ‘পথের দাবি’র হিন্দি সংস্করণ ‘সব্যসাচী’তে তিনি মুখ্য ভূমিকায় দেখা দেন। আবার ‘রাত্রি’তে তাঁর চরিত্র কিছুটা রবিন হুড সুলভ– সাহসী, ন্যায়পরায়ণ, নীরব রক্ষাকর্তা।

‘সংগ্রাম’-এর সেই কবিতা প্রিয় প্রৌঢ়

প্রথম যেই দু’টি চরিত্রের মাধ্যমে তিনি পরিচিতি লাভ করেন, তা ছিল একেবারে অন্য ধাঁচের। ‘সংগ্রাম’ ছবিতে তাঁকে দেওয়া হয়েছিল একেবারে রবিঠাকুর সদৃশ রূপ। হালকা কমিক চালে নির্মীত সেই রসিক বৃদ্ধের চরিত্র আবার কথায় কথায় কবিতা আওড়ায়। অন্যদিকে, ‘সাত নম্বর বাড়ি’-র অমরনাথ (যা ছিল তাঁর প্রথম বড় চরিত্র) করতে গিয়েই তিনি জীবনে প্রথম ও শেষবারের জন্য গানে লিপ দেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘ফেলে আসা দিনগুলি মোর’ গানটির সঙ্গে কমলবাবুর লিপ এমন নিখুঁতভাবে মিলে গিয়েছিল যে বহু লোকই ধরে নিয়েছিলেন, গানটি অভিনেতারই গাওয়া। একবার এক আউটডোর শুটিংয়ে তো অনেকে তাঁকে সেই গান গেয়ে শোনাতে অনুরোধও করেন! বুদ্ধি খাটিয়ে অনুরোধকারী সবাইকে হারমোনিয়াম-তবলা জোগাড়ে ব্যস্ত রেখে, ঝটপট শুটিং সেরে ট্রেনে চেপে পালিয়ে সে যাত্রায় বেঁচেছিলেন!

শুরুর দিকে হাতে গোনা কয়েকটি ভিন্নধর্মী চরিত্র পেলেও, পরে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে অধিকাংশ পরিচালকই তাঁকে ভিলেন কিংবা বদমেজাজি ভূমিকাতেই ভাবতে শুরু করলেন, এবং তাও আবার প্রায়শই এমন সব চরিত্র, যাদের বয়স বাস্তবে তাঁর চেয়ে অনেকটাই বেশি।

তাঁর নিজের কথায় ‘‘প্রথম যৌবনে অভিনয় করতে এসে ‘সংগ্রাম’-এ সাজতে হোল ছবিদার শ্বশুর। ‘তপোভঙ্গ’ ছবিতে সুলালদার (জহর গাঙ্গুলির)। এর কিছুদিন বাদে ‘সতী’ ছবিতে ধীরাজ ভট্টাচার্যের বাবা। শুধু বাকী ছিল অহীন্দ্র চৌধুরীর বাবা সাজা, সে সুযোগও এসেছিল, শৈলজানন্দর ‘ঘুমিয়ে আছে গ্রাম’ ছবিতে, দু’দিন কাজও করেছিলাম, কিন্তু মতান্তর হওয়ায় আমি কাজটা ছেড়ে দিই।” অভিনেতার এই মন্তব্যের সঙ্গে আরেকটি নজির জুড়ে দেওয়া যায়: ‘হসপিটাল’ ছবিতে তিনি অশোককুমারের বাবার ভূমিকায়ও অভিনয় করেছিলেন। এসবের অন্যথা ঘটেছিল অন্তত দু’বার– যখন তিনি নিজের চাইতে অনেক ছোট সুচিত্রা সেন (‘একটি রাত’) ও সবিতা চ্যাটার্জির (‘আত্মদর্শন’) স্বামী সেজেছিলেন।

‘কঙ্কাবতীর ঘাট’-এ ‘নন্দুয়া গুণ্ডা’র চরিত্রে কমল মিত্র

খল চরিত্রেও কমল মিত্র নিজের স্বাতন্ত্র্য অটুট রেখেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘আলাদিন ও আশ্চর্য প্রদীপ’-এর সেই নিষ্ঠুর জাদুকরের ভূমিকায় তাঁর দাপুটে উপস্থিতি। আবার ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’ নাটকে তাঁর অভিনীত ‘নন্দুয়া গুণ্ডা’ এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে পরে একই নাটক অবলম্বনে সিনেমা হলে সেই ভূমিকায় আবারও তাঁকেই নেওয়া হয়। ভিলেন বলতে মনে পড়ে ‘পরিণীতা’-র নির্মম তেজারতি কারবারি নবীন রায়কে, যে দরকারে বেআইনি পথেও অন্যের বাড়ি দখল করতে পিছপা হন না। কে ভুলতে পারে ‘বিভাস’-এর সেই তারকেশ্বর রায়কে– অচিনপুরের সহজ-সরল গ্রামবাসীদের অশিক্ষাকে হাতিয়ার করে যিনি নিঃশব্দে আত্মসাৎ করে চলেন তাঁদের ধনসম্পত্তি। কিংবা ‘বর্ণালী’র ত্রিদিব চৌধুরী, অথবা ‘থানা থেকে আসছি’র চন্দ্রমাধব সেন, যাদের কাছে মানুষের মূল্য নির্ধারিত হয় শুধুই অর্থ ও সামাজিক অবস্থানের মাপে। 

‘শেষ অঙ্ক’র সুরেন উকিল

তাঁর কিছু ভিলেন চরিত্র সত্যিই হাড়হিম করা। যেমন ‘জোড়াদিঘির চৌধুরী পরিবার’-এর সেই ডাকাত-জমিদার– রাতের অন্ধকারে বজরায় চড়াও হয়ে যিনি ভুলবশত নিজের জামাতাকে হত্যা করেন। এরপর সদ্যবিবাহিতা কন্যার শোচনীয় পরিণতি চোখের সামনে ভেসে উঠতেই তিনি মুহূর্তে আত্মহননের পথ বেছে নেন।

ডাকাতের ভূমিকায় তাঁর অন্যতম মর্মস্পর্শী কাজ ‘লৌহকপাট’-এর বদরুদ্দীন মুন্সী রূপে। ডাকাতির সময় কন্যাসম এক তরুণীকে দেখে হঠাৎই যার মনে পড়ে যায় নিজের প্রয়াত এক প্রিয়জনের কথা। পরে যখন তাঁরই দলের এক সদস্য সেই মেয়েটির সম্মানহানি করে, বদরুদ্দীন তা মেনে নিতে পারেন না। সঙ্গীদের না ফাঁসিয়ে, সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে তিনি ধরা দেন। শেষমেশ তাঁর মৃত্যু হয় জেলখানার চার দেওয়ালের মধ্যে, গলায় দড়ি দিয়ে।

‘কংস’-তে নাম ভূমিকায়

কমল মিত্রকে দেখা গিয়েছিল একের পর এক পৌরাণিক ছবিতে– ‘মহিষাসুর বধ’-এর মহিষাসুর, ‘কংস’-এর নামভূমিকায়, আবার ‘সতীর দেহত্যাগ’, ‘শ্রী শ্রী তারকেশ্বর’, ‘সাবিত্রী সত্যবান’, ‘মা অন্নপূর্ণা’, ‘দাতাকর্ণ’, ‘শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণ’, ‘ত্রিনয়নী মা’ থেকে ‘শ্রীবৎস চিন্তা’– সবখানেই তাঁর উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

‘আলাদিন ও আশ্চর্য প্রদীপ’ চলচ্চিত্রে কমল মিত্র

পূর্বে উল্লেখিত ‘সংগ্রাম’-এর মতো আরও কিছু হালকা হাসির চরিত্র করেছিলেন তিনি। ‘সহযাত্রী’-তে তাঁকে দেখা গিয়েছে উত্তমকুমারের মজাদার জামাইবাবু হিসেবে– চা-বাগানের সেই রসিক ম্যানেজার। স্মরণে আসে ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’-এর সেই যমরাজকে, যিনি ভানুর পোষা ষাঁড়ের গুঁতোর ভয়ে যমলোক ছেড়ে বিষ্ণুলোকে পালিয়ে আশ্রয় নেন।

‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’-এ যমরাজের চরিত্রে

স্ক্রিন-টাইম কম থাকলেও যে কমল মিত্র দাগ কাটতে জানতেন, তার উজ্জ্বল উদাহরণ ‘বিপাশা’-র সর্দার হরদয়াল সিং– যিনি ১৯৪৭-এর দাঙ্গার মধ্যে সদ্য পিতৃহারা বিপাশাকে নিজের প্রাণ বাজি রেখে শিয়ালকোট থেকে দীর্ঘ বিপদসঙ্কুল পথ পায়ে হেঁটে অমৃতসরে পৌঁছে দেন। পাঁচের দশকের প্রথম ভাগে উত্তম-সুচিত্রার ব্লকবাস্টার দু’টি ছবি– ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ও ‘শাপমোচন’-এ তিনি সেজেছিলেন নায়িকার স্নেহশীল, নরম মনের বাবা। একই ধারায় এর পরের দশকের বক্স অফিস রেকর্ড সৃষ্টিকারী ‘মণিহার’-এ-ও তিনি হয়েছিলেন সন্ধ্যা রায়ের সন্তানবৎসল পিতা।

‘বিপাশা’য় সুচিত্রা সেনের সঙ্গে

নিজের চিরাচরিত ইমেজ ভেঙে ‘বধূ’-তে বাড়ির পুরনো বিশ্বস্ত ভৃত্যের ভূমিকাভিনয় তাঁর মুকুটের আরেকটি উজ্জ্বল পালক বিশেষ। শোনা যায়, ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে বাজি ধরে তিনি এই চরিত্রটি করেছিলেন। ছবিবাবু নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন তাঁর দিকে, আর কমলবাবু সসম্মানে তা গ্রহণ করে অর্জন করেছিলেন অনেক সুনাম।

‘বিদ্যাসাগর’-এ রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন

শ্রীমিত্রের অভিনয় ভাণ্ডারে নানা ধরনের চরিত্রের অনন্য দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে। যেমন– ‘রাজদ্রোহী’-র সেই কর্তব্যপরায়ণ, ন্যায়নিষ্ঠ রাজ সেনাপতি তেজসিংহ, যে নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে লড়াই করেও ব্যক্তিত্বহীন রাজার হুকুম মেনে চলে। ‘শেষ অঙ্ক’-এর সেই হিমশীতল, ডাঁটিয়াল আইনজীবী সুরেন বাঁড়ুয্যে, যিনি কোর্টরুমের প্রতিটি মুহূর্তে উত্তমকুমার ও উৎপল দত্তের মতো অভিনেতার সঙ্গে স্ক্রিন ভাগ করেও স্বকীয় উজ্জ্বলতা বজায় রাখেন। ‘বিদ্যাসাগর’ বায়োপিকে তাঁর রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় যেন যথাযথ। তৎকালীন হিন্দু সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ আলোচনা এখনও সোশ্যাল মিডিয়ায় রিল হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয়।

‘রাজদ্রোহী’ তেজসিংহ

‘পরশ পাথর’-এর সেই ককটেল পার্টির দৃশ্যে তিনি আবির্ভূত হন তাঁর সেই স্বভাবসিদ্ধ গাম্ভীর্য নিয়ে। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে এই তাঁর একমাত্র কাজ। শেঠজির জমজমাট পার্টিতে তাঁদের মতো রইস লোকজনের ভিড়ে পরেশ-রূপী তুলসীর উপস্থিতি যে শুরু থেকেই মিস্টার মিত্র রূপী কমলবাবুর ভালো লাগেনি– তা তাঁর মুখাভঙ্গি আর আচরণেই স্পষ্ট ফুটে ওঠে। এরপর মদ্যপান করে বেসামাল হয়ে ওঠা তুলসী চক্রবর্তীকে আক্ষরিক অর্থে তিনি ঘাড়ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন। 

‘লৌহকপাট’-এ বদরুদ্দীন মুন্সী ও জেলর

এই দৃশ্যগ্রহণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি মজার ঘটনা, যা না বললেই নয়। প্রযোজক প্রমোদ লাহিড়ীর অনুরোধে কমলবাবু এই বিশেষ দৃশ্যে অভিনয় করতে রাজি হন– প্রায় একই সময়ে নির্মিত ‘লৌহকপাট’-ও ছিল প্রমোদবাবুরই প্রযোজনা। যাই হোক, শুটিংয়ে এসে শ্রীমিত্র দেখলেন তাঁর চরিত্রের ভূমিকা একেবারেই নগণ্য, নিছক ক্যামিও। তাঁকে রাগতভাবে ফ্লোরে বসে থাকতে দেখে এক সাংবাদিক সত্যজিৎ রায়কে জিজ্ঞেস করেন, ‘মনে হচ্ছে কমলবাবুর মেজাজ খারাপ, ব্যাপারটা কী?’ অসামান্য রসবোধ-সম্পন্ন সত্যজিৎবাবু অভিনেতাকে শুনিয়েই উত্তর দেন– ‘ও কিছু না, অভিনয়ের আগে চরিত্রটাতে নিজেকে কনসেন্ট্রেট করাচ্ছেন।’

‘নববিধান’-এর শৈলেশ

সবশেষে আসা যাক ‘নববিধান’-এর কথায়। চরিত্রটি ছিল আদ্যোপান্ত শরৎচন্দ্রীয় ঘরানার দ্বিধাগ্রস্ত নায়কের। দোষে-গুণে মেশানো এই অধ্যাপক নিজের দুর্বলচিত্ততা আর বোনের মন্ত্রণার জালে জড়িয়ে নিজের নবগঠিত সংসারটিকে প্রায় হাতছাড়া করতে বসেছিলেন। শৈলেশ যে কমল মিত্তির অভিনীত বাকি সব চরিত্রের তুলনায় আলাদা, তা বোঝাতে একটি দৃশ্যের বর্ণনাই যথেষ্ট। বিপত্নীক অধ্যাপকের পুনর্বিবাহ নিয়ে তাঁর কাছে যখন ঘনিষ্ঠজনেরা মত জানতে চায়, তিনি মাথা নিচু করে লাজুকভাবে বলেন, ‘তোরা যখন বলছিস, তখন…।’ তাঁর বিস্তৃত কর্মজীবনে এরকম সংকোচ-লজ্জায় ভরা দৃশ্য আর কোনও আছে কি না সন্দেহ! কমল মিত্র সাধারণত নিজের ছবি দেখতেন না– রাশ প্রিন্ট তো নয়ই– কিন্তু কানন দেবীর অনুরোধে এই ছবি একবার দেখেছিলেন, এবং মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছিলেন যে, ছবিটি তাঁরও দর্শকদের মতো ভালো লেগেছে।

স্ত্যানিস্লাভস্কির আদলে ‘মায়ার সংসার’ ছবিতে

দেশ-বিদেশের নানা বই পড়ে তিনি নিজেকে প্রস্তুত রাখতেন। জীবন সায়াহ্নে নিজের লাইব্রেরির অধিকাংশ বই তিনি নন্দনে দান করে যান। অভিনয়ের সঙ্গে তিনি মেকআপ-কস্টিউম নিয়েও ভাবতেন গভীরভাবে। হিন্দি ‘সব্যসাচী’-র জন্যে তিনি নানা রকমের সাজ-সজ্জা, কেশ-বিন্যাস ও পোশাক ব্যবহার করেন। ‘মায়ার সংসার’-এ তাঁর চরিত্রের মেকআপ-চুল ও চশমা নিজে তদারকি করে বানিয়েছিলেন বিশ্ববিখ্যাত রাশিয়ান নাট্যগুরু স্ত্যানিস্লাভস্কির আদলে। আর ‘শেষ অঙ্ক’-এ সুরেন উকিলের সাজের বেলা তিনি হুবহ নকল করেন নিজের পিতা নরেশচন্দ্র মিত্রকে, যিনি এককালে ছিলেন বর্ধমানের প্রখ্যাত আইনজীবী।

সন্তানের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে

না– তিনি ‘নায়ক’ ছিলেন না ঠিকই। কিন্তু পর্দায় তাঁর আবির্ভাব বহু নায়কের উপস্থিতিকেই ম্লান করে দিত। কমল মিত্র যেসব ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, সেসব কটিতেই তিনি ছিলেন অবিশ্বাস্যরকম বিশ্বাসযোগ্য। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে তিনি নিজেকে বারবার ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বলেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে কিংবা তলিয়ে যাননি– বরং স্বমহিমায় নিজের জায়গা ধরে রেখেছিলেন, এবং অভিনয়ের আঙ্গিনা থেকে বিদায়ও নিয়েছিলেন নিজের মর্জিমাফিক, নিজের শর্তে।