
ছত্রিশগড়ের রাজনন্দগাঁওয়ের বাসিন্দা বিনোদ কুমার প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন আর তাই পরিবেশ সংরক্ষণের দায় ও দায়িত্বের কথা জোর দিয়েই শুনিয়েছিলেন। জীব ও জড়ের প্রতি অকৃপণ ভালোবাসা তাঁর লেখায় ফিরে ফিরে এসেছে। কারণ তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, যে-ধ্বংসকর্ম আমরা বাইরে ঘটিয়ে থাকি, তা উল্টো দিকে আমাদের ভিতরেও ধ্বংসকার্য চালায়।
হিন্দি কবি ও কথাকার বিনোদ কুমার শুক্ল ৮৮ বছর বয়সে গত ২৩ ডিসেম্বর চলে গেলেন। তাঁর যাওয়ার সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে একটা আন্দোলন জুড়ে গেল। উত্তর-পশ্চিম ভারতের আরাবল্লি পর্বতমালা রক্ষার জন্য পরিবেশবিদ থেকে সাধারণ মানুষজন পথে নেমেছেন। সত্যিই যদি খনিজ পদার্থ উত্তোলনের জন্য ১০০ মিটারের কম উচ্চতার সব পাহাড় ভেঙে ফেলা হয় তাহলে ৬৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ পর্বতমালার অনেকটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সে সঙ্গে এইসব পাহাড়ের আদিবাসী ও অন্যান্য বাসিন্দা-সহ জলবায়ু এবং জীবনবৈচিত্র সংকটের মুখে পড়বে। প্রশ্ন হল, প্রকৃতির ওপর জেসিবি আর বুলডোজারের এই শ্যেন দৃষ্টি কেন? এর কারণ মানুষের সীমাহীন চাহিদা আর প্রাকৃতিক সম্পদের চড়া বাজার দর। ঠিক এই কথাটাই বিনোদ কুমার শুক্ল আমাদের অনেক দিন আগে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন।

ছত্রিশগড়ের রাজনন্দগাঁওয়ের বাসিন্দা বিনোদ কুমার প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন আর তাই পরিবেশ সংরক্ষণের দায় ও দায়িত্বের কথা জোর দিয়েই শুনিয়েছিলেন। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘উন্নয়নের ভাবনা বহন করে মানবিকতা ধ্বংসের বীজ। সবাইকেই সচেতন থাকতে হবে যাতে এক খণ্ড পাথর, এক টুকরো ঘাস কিংবা একটা সবুজ পাতাও অপচয় না হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাঁচলেই তবে এই পৃথিবী বাসযোগ্য থাকবে।’ জীব ও জড়ের প্রতি অকৃপণ ভালোবাসা তাঁর লেখায় ফিরে ফিরে এসেছে। কারণ তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, যে-ধ্বংসকর্ম আমরা বাইরে ঘটিয়ে থাকি, তা উল্টো দিকে আমাদের ভিতরেও ধ্বংসকার্য চালায়। একটু অন্যভাবে বললে, প্রতিটি আঘাত তার বিপরীত ও সমান প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্তির ভিতরেও আঘাত হানে। এর ফলে একক ব্যক্তি থেকে একটি গোষ্ঠী ও জাতিরও আত্মহনন ঘটতে পারে।

জয় করার নেশা যখন মনের উপর ভর করে, তখন প্রকৃতি, ভূখণ্ড, দেশ, মানুষ থেকে চারপাশের সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করার অশুভ ইচ্ছে জাগে। আমি আর তুমি-র মধ্যে দ্বন্দ্বের সূচনা ঘটে। এর শুরু অবশ্য আমাদের শৈশবেই যখন ব্যাকরণের পাঠ থেকে শিখি যে, ‘আমি’ হলাম উত্তম আর ‘তুমি’ হলে দ্বিতীয় পুরুষ। এই বিভাজনের রাজনীতি ও সমাজরীতি ভেঙে দেওয়ার জন্যে বিনোদ কুমার শুক্লের মতো কবিদের দরকার হয়। প্যালেস্টাইন আর বাংলাদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত উন্মত্ততার বিপরীতেও যে বাঁচার বিকল্প দর্শন আছে তা কবিতার পঙক্তিতে আবিষ্কার করি । ছত্রিশগড়ের রাইপুরের মতো একটা ছোট জায়গার কবি বিশ্বজোড়া মন নিয়ে লেখেন–
আমার নিজের পা দুটো দিয়ে নয়
আমি সবার পা দিয়ে
সক্কলের সঙ্গে হাঁটছি,
দেখছি সবার চোখ দিয়ে।
সকালে উঠি সবার ঘুম ভাঙার মধ্যে দিয়ে
ঘুমোতেও যাই সবার জোড়া চোখের পাতার নিচে
আমার একাকিত্ব নেই
আমি নিজেই একটা বিশাল জমায়েত
আর সে জমায়েতের প্রত্যেকটি মানুষ আমি।
আমাকে খুঁজতে যেও না।
যদি খুঁজে পেয়েও যাও
দেখবে বাকি সবাইকেও পেয়ে গেছ।
তুমি আলাদা করে আমাকে আদৌ খুঁজে পাবে না
আমার বদলে তোমার দেখা হবে
তোমার নিজের উত্তম পুরুষের সঙ্গে।

বিনোদ কুমার শুক্লের প্রথম বই ‘লগভগ, জয় হিন্দ’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে। তখন তাঁর বয়স ৩৪ বছর। আমাদের দেশের অনেক কবি এই বয়সে আট-দশটা বই লিখে ফেলেন। বিনোদ কুমারের কোনও তাড়া ছিল না। তিনি কী লিখবেন, কতটুকু লিখবেন আর কেমনভাবে লিখবেন, তা নিয়ে ভাবছিলেন। নিজেকে ভাঙাগড়া করছিলেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নৌকর কি কমিজ’ (চাকরের জামা) ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি অবলম্বনে মণি কাউল একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। দু’-বছর পরে নতুন কবিতার বই প্রকাশ পেয়েছিল। ১৯৮৮ সালে পাঠকদের হাতে এসেছিল তাঁর গল্পের সংকলন ‘পেড় পর কমরা’ (গাছের উপর ঘর)। কবিতার বইয়ের পাশাপাশি দু’টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল গত শতকের নয়ের দশকে। একটি হল ‘খিলেগা তো দেখেঙ্গে’ আর অন্যটি ‘দিওয়ার মে এক খিড়কি রহতি থি’ (দেওয়ালে একটা জানালা থাকত)। পরের বইটির জন্যে ১৯৯৯ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন। সে উপন্যাসে বিনোদ কুমার এক নব-দম্পতির কথা শোনান যাদের জীবনে বাঁচার উপকরণ বিশেষ কিছুই ছিল না। একটি ছোট কলেজের পড়ানোর ফলে মাসে ৮০০ টাকা মাইনে মিলত আর একটা ছোট ঘরে সংসার পেতে তারা থাকত। ঘর ছোট কিন্তু রঘুবীর প্রসাদ আর সোনসী মিলে কল্পনা আর বাস্তবতা মিশিয়ে এমন এক জগৎ তৈরি করে ফেলেছিল যে, তাকে চার দেওয়ালে আটকানো যেত না। ঘরের জানলার মতো সেটি হয়ে ওঠে তাদের কল্পনা, বাস্তবতা ও আশার পথ।

কল্পনা, বাস্তবতা আর আশার ত্রিধারা হল বিনোদ শুক্লের কথাসাহিত্যের প্রাণ। তিনি অতি সাধারণ মানুষজনকে তাঁর গল্প-উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে তুলে ধরেছেন। এদের মধ্যে চাকর, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক, দোকানদার, পাহারাদারের মতো অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষ চরিত্র হিসেবে উঠে এসেছে। কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও সেসব চরিত্র বাঁচার আনন্দ উপভোগ করে কারণ তাদের স্বপ্ন ও কল্পনা আছে। সেইসঙ্গে সবাইকে নিয়ে বাঁচার ইচ্ছে ও ক্ষমতা আছে। তারা অবশ্য ক্ষমতার কেন্দ্রগুলিকে ভয় পায়। যেমন তাঁর একটি কাহিনির এক জায়গায় আছে, পুলিশ ফাঁড়ি এক বছর আগে উঠে গেলেও সেদিকে কেউ যেতে চায় না। এমনকী, ছাগলগুলো পর্যন্ত সেই পরিত্যক্ত বাড়িটার দিকে পা বাড়ায় না। তারা ঝাঁপিয়ে প্রাইমারি স্কুলের দুয়ারে উঠে ক্লাসঘরে ঢোকে, যদিও স্কুলের শিক্ষকদের কাজে বাধা দেওয়ার কোনও ইচ্ছেই তাদের নেই।

বিনোদ কুমার শুক্লকে প্রথম সামনাসামনি দেখি সাহিত্য অকাদেমির পুরস্কার অর্পণ অনুষ্ঠানে। তাঁর সাহিত্যযাত্রার কথা তাঁর নিজের মুখে শোনার সুযোগ ঘটেছিল। বক্তৃতাটি ছিল ছোট, কিন্তু সবাইকে স্পর্শ করেছিল। সহজ জীবনের মধ্যে যে বৈভব থাকে, তা সেদিন প্রকাশ করেছিলেন তাঁর অনুচ্চ কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণে। বিনোদ কুমার শুক্ল বেশি বই লেখেননি। সব মিলে ২০টার মতো। তাতেই জ্ঞানপীঠ-সহ দেশি-বিদেশি নানা পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। আসলে তাঁর বাঁচার অভিনব দর্শন, আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি, অনুচ্চ কণ্ঠস্বর, শব্দের সংঘবদ্ধতা আর জীবনের প্রতি ভালোবাসা পাঠকদের গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়। তার প্রমাণ বর্তমান বছরে পাওয়া তাঁর রয়েলটির হিসেব। মূলত ‘দিওয়ার মে এক খিড়কি রহতি থি’ উপন্যাসের জন্য ২০২৫ সালের প্রথম ছ’ মাসে তিনি পেয়েছিলেন ৩০ লক্ষ টাকা।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved