Robbar

‘হিন্দু’ বা ‘মুসলমান’ নয়, ধর্ম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে তবসসুম বলতেন ‘মনুষ্যত্ব’

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 18, 2025 2:39 pm
  • Updated:November 18, 2025 5:20 pm  
Tabassum Govil remembered on her death anniversary by Udayan Ghosh Choudhuri

যে ইন্ডাস্ট্রিতে ছদ্মনামে কাজ করাটা প্রায় একটা রেওয়াজ– মহম্মদ ইউসুফ খান হয়ে যান ‘দিলীপ কুমার’; মেহেজাবিন বানো হয়ে যান ‘মীনা কুমারী’; মমতাজ জাহান দেহলবি হয়ে যান ‘মধুবালা’– বুঝতে নিশ্চয়ই অসুবিধা হয় না, সেই রেওয়াজের পিছনে নানা ব্যক্ত কারণ থাকলেও, কোনও অব্যক্ত অঙ্গুলিহেলনে সেইসব নাম প্রায়শ হয়ে যায় ‘হিন্দু’; কারণ, দুর্ভাগ্যজনকভাবে শব্দের উঠোনে আর ভাষার দেওয়ালে আমরা পুঁতে রেখেছি ধর্মের আমূল পেরেক– সেই রেওয়াজের ঠিক উলটো পথে হেঁটে, আসগারি আর অযোধ্যানাথ ছোট্ট কিরণবালার নাম রাখলেন খাঁটি আরবি শব্দে, ‘তবসসুম’।

উদয়ন ঘোষচৌধুরি

করাচির এক মৌলবি, তাজ মহম্মদের মেয়ে আসগারি যখন কোরান শরীফের পাশাপাশি আরবি আর ফারসি ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১২ বছর। এবার তিনি চাইলেন সংস্কৃত শিখে বেদ আর উপনিষদ পড়বেন। বেঁকে বসলেন ধর্মান্ধ মৌলবি। জোর করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন তিনি; ভাবলেন, সংসারের জাঁতাকলে পড়লে ওসব পড়াশোনার ভূত মাথা থেকে নেমে যাবে।

আসগারি বেগম

ভুল ভেবেছিলেন তিনি। ওইটুকু বয়সেই আসগারি বুঝে গিয়েছিলেন, ধর্মের ঘেরাটোপে কোনও ভাষাকে বা বইকে আটকে রাখলে, আখেরে নিজেরই লোকসান। একদিন, বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে এলেন দিল্লি। পৌঁছলেন আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা দয়ানন্দ সরস্বতীর শিষ্য স্বামী শ্রদ্ধানন্দের আশ্রয়ে। শ্রদ্ধানন্দ তখন স্বাধীনতা আন্দোলন আর হিন্দু সমাজ সংস্কারের পাশাপাশি বহু মুসলমান আর খ্রিস্টানকে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করছেন; নাম দিয়েছেন ‘শুদ্ধিকরণ’। তিনি আসগারি বেগমের নতুন নাম রাখলেন ‘শান্তি দেবী’।

এক সময়ে শ্রদ্ধানন্দের বন্ধু হলেও, তাঁর এই ধর্মান্তরিত করার অভিযান মেনে নিতে পারেননি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি। তাঁর নিজের পত্রিকা ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’-তে ১৯২২ সালে তিনি লিখেছিলেন: Swami Shraddhananda has also become a character of disbelief. I know that his speeches are often provocative. Just as most Muslims think that every non-Muslim will one day convert to Islam, Shraddhananda also believes that every Muslim can be initiated into the Aryan religion.

আসগারির এই ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই অসন্তুষ্ট হয়ে উঠল অবিভক্ত ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়। তাঁর পরিবারের লোকেরা করাচি থেকে এলেন মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। শ্রদ্ধানন্দ বললেন, মেয়ে নিজের বাড়িতে যেতে চাইলে তাঁর কোনও আপত্তি নেই; কিন্তু কোনও জবরদস্তি তিনি বরদাস্ত করবেন না। জন্মসূত্রের ঘরে আর ফিরতে চাইলেন না আসগারি নিজেই। এবার, শ্রদ্ধানন্দের বিরুদ্ধে মামলা করলেন তাঁরা। আদালত ঘোষণা করল, শ্রদ্ধানন্দ নির্দোষ। রায় বেরনোর তারিখটা ছিল ডিসেম্বর ৪, ১৯২৬। এর ঠিক কয়েক দিন পর, ডিসেম্বরের ২৩ তারিখে খুন হলেন তিনি। বলা বাহুল্য, আসগারির ঘটনাটাই ছিল খুনের কারণ।

সেই সময়ের অধিকাংশ তরুণ-তরুণীর মতো আসগারিও নাম লিখিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের খাতায়। আন্দোলনের পাশাপাশি লেখালেখি শুরু করলেন তিনি। রোজগারের জন্য ঢুকলেন দিল্লির ‘তেজ’ পত্রিকায়, সাংবাদিক হিসেবে। সেখানেই আলাপ হল আরেক স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সাংবাদিক অযোধ্যানাথ সচদেবের সঙ্গে। শোনা যায়, বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের পাশাপাশি লড়াই করেছিলেন অযোধ্যানাথ। সমাজের চোখরাঙানিতে ভ্রুক্ষেপ না করে, তাঁকে এবার স্বেচ্ছায় বিয়ে করলেন আসগারি।

বিয়ের পর দু’জনে চলে এলেন বম্বে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জনরোষ চাঙ্গা রাখার জন্য গড়ে তোলা আন্ডারগ্রাউন্ড কাগজ ‘দ্য ইনকিলাব’-এর প্রতিষ্ঠাতা আর ‘মিড-ডে গ্রুপ অফ পাবলিকেশনস’-এর চেয়ারম্যান খালেদ আনসারির বাবা, আবদুল আনসারির সহযোগিতায় একটা মাসিক পত্রিকা বের করতে শুরু করলেন আসগারি; নাম, ‘তনবির মান্থলি’। সেই পত্রিকায় লিখতেন সাহির লুধিয়ানভি, মজরুহ সুলতানপুরি, কাইফি আজমি, জিগর মুরাদাবাদির মতো মান্যগণ্য লেখকরা। কিছুদিনের মধ্যে, আসগারির কোলে এল ফুটফুটে এক কন্যা; মেয়ের নাম রাখলেন তিনি, কিরণবালা।

চারের দশকের গোড়া থেকে হিন্দি ফিল্মের মক্কা-মদিনা হয়ে উঠল বম্বে। বম্বে টকিজের কিংবদন্তি সাফল্যের পাশাপাশি চলছিল চন্ডুলাল শাহের রঞ্জিত মুভিটোন। এবার, পুনের প্রভাত ফিল্মস থেকে বেরিয়ে, ভি. শান্তারাম খুললেন রাজকমল কলামন্দির; বাবুরাও পাই শুরু করলেন ফেমাস পিকচার্স; শশধর মুখার্জি বানালেন ফিল্মিস্তান; মেহেবুব খান তৈরি করলেন মেহেবুব স্টুডিওজ। মুখ্য চরিত্রে নার্গিসকে নিয়ে ফেমাস পিকচার্সে কাজ চলছিল ‘নার্গিস’ ছবির (১৯৪৭)। লেখক রাজেন্দ্র কৃষাণ ছিলেন অযোধ্যানাথের বন্ধু। বন্ধুকে রাজেন্দ্র জানালেন, এই সিনেমায় একজন শিশুশিল্পী লাগবে; কিরণবালা একদম উপযুক্ত হবে সেই চরিত্রে। ওদিকে মেয়ের মাত্র বছর তিনেক বয়স। এইটুকু মেয়েকে সিনেমায় কাজ করাতে রাজি হলেন না অযোধ্যানাথ।

গোটা দুনিয়া তখন ধুঁকছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝামেলায়। ‘তনবির মান্থলি’ প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে; কারণ, পত্রিকা চালানোর কাঁচামাল হিসেবে কাগজের দাম আগুনছোঁয়া। সংসারের খরচ জোগাতে শেষমেশ নিমরাজি হলেন আসগারি। ভাবলেন, এই একটা ছবিতে কাজ করুক মেয়ে; এরপর আর নয়। পর্দার পৃথিবীতে মেয়ের নতুন নাম রাখলেন অযোধ্যানাথ, তবসসুম। প্রথম সিনেমায় পারিশ্রমিক হিসেবে ছোট্ট কিরণবালা ওরফে বেবি তবসসুম পেল ৫,০০০ টাকা!

অযোধ্যানাথ, তবসসুম, আসগরি

পরিচালক-প্রযোজক সোহরাব মোদী একদিন এলেন তাঁদের বাড়ি; তাঁর পরবর্তী সিনেমা ‘মঝধার’-এর (১৯৪৭) জন্য শিশুশিল্পী দরকার। সোজা ‘না’ বলে দিলেন মেয়ের বাবা-মা। রাজেন্দ্র কৃষাণ বললেন, এরকম মুখের ওপর ‘না’ বলাটা ঠিক নয়; বরং, বেশি টাকা চাইলে আর কেউ ধারেকাছে আসবে না। সেই পরামর্শে, সোহরাবের কাছে ১০,০০০ টাকা চাইলেন তাঁরা। চুক্তিতে সই করে দিলেন প্রযোজক, তবসসুম এবার পাবে ১২,০০০ টাকা!

নতুন শিশুশিল্পীর কাজ দেখে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন সমালোচকরা। বিশেষত, তার উর্দু উচ্চারণ ঘোল খাইয়ে দিল বাঘা-বাঘা অভিনেতাকে। আর, হবে না-ই বা কেন! সেই সময়ের খ্যাতনামা অভিনেতা-প্রযোজক অরুণ আহুজা (নয়ের দশকের স্টার গোবিন্দার বাবা) আর দেব আনন্দের কেরিয়ারের প্রথম নায়িকা কমলা কোটনিসকে উর্দু পড়াতেন আসগারি। মায়ের ক্লাসরুমে বসেই উর্দুতে মিষ্টিমুখ হয়েছিল তবসসুমের।

হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে শিশুশিল্পী হিসেবে হু হু করে বাড়তে থাকল তার জনপ্রিয়তা। একের পর এক সুপারহিট সিনেমা– ‘বড়ি বেহেন’ (১৯৪৯), ‘সংগ্রাম’ (১৯৫০), ‘জোগন’ (১৯৫০), ‘আফসানা’ (১৯৫১), ‘দিদার’ (১৯৫১), ‘বৈজু বাওরা’ (১৯৫২)। শুধু দর্শকের সমাদর নয়, ইন্ডাস্ট্রির ভেতরের মানুষদেরও মনজয় করল সে। নার্গিস, মীনা কুমারী, মধুবালা, সুরাইয়া– এঁদের কোলে চড়ে ঘুরত ছোট্ট মেয়েটা। তার জন্য চকলেট নিয়ে আসতেন রাজ কাপুর। বৈজয়ন্তীমালা তাকে ডাকতেন ‘পাপা’ বলে; কারণ, দক্ষিণ ভারতের কোনও কোনও জায়গায় বাচ্চাদের আদর করে ‘পাপা’ বলা হয়।

বিমল রায়ের সঙ্গে বেবি তবসসুম

বিমল রায়ের স্ত্রী, মনোবীণার খুব প্রিয় ছিল মোপাসাঁ-র লেখা ‘সাইমন’স পাপা’। ‘পরিণীতা’ (১৯৫৩) আর ‘দো বিঘা জমিন’ (১৯৫৩) বানানোর তুমুল ব্যস্ততার মাঝেই বিমল রায় হাত দিলেন পরবর্তী সিনেমায়, সেই বিদেশি গল্পের অবলম্বনে– নাম, ‘বাপ-বেটি’ (১৯৫৪)। প্রধান চরিত্রে কাজ করল বেবি তবসসুম। কিন্তু, সিনেমাটা তৈরি হওয়ার মাঝপথে, ফান্ডের অভাবে গায়েব হয়ে গেলেন প্রযোজক। টেকনিশিয়ানদের পয়সা না দিতে পেরে, রেগেমেগে বিমল রায় তাঁদের বললেন সেটের সব প্রপ তুলে নিয়ে যেতে। সেটটা ছিল বাচ্চাদের একটা স্কুল। আর, সত্যিই তাই হয়েছিল। পরে, ওই ছোট ছোট চেয়ার-টেবিল শোভা পেত বিমল রায়ের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ও জনপ্রিয় কমেডিয়ান অসিত সেন-সহ অন্যদের বাড়িতে।

‘বাপ-বেটি’ কোনওরকমে মুক্তি পেলেও, সম্ভবত এদিক ওদিক কয়েকটা টুকরো দৃশ্য ছাড়া, এখন কিছুই আর নেই। যদিও, পাঁচের দশকের নিরিখে যথেষ্ট ব্যতিক্রমী ছিল সেই ছবি। মুখ্য চরিত্রে এক স্কুল-পড়ুয়া মেয়ে আর তার মা, যে কি না ‘সিঙ্গল মাদার’। তাছাড়া, সেভাবে কোনও স্টারও ছিল না। আফসোস, এভাবেই মহাকালে তলিয়ে গিয়েছে বেবি তবসসুমের শেষ সিনেমা।

এর কয়েক বছর পর, পড়াশোনা শেষ করে, ‘বেবি’ বিশেষণ মুছে, আবার যখন ইন্ডাস্ট্রিতে ফিরলেন তবসসুম– ভাগ্য আর আগের মতো সহায় হল না। ঠিকঠাক প্রোজেক্ট পেলেন না। প্রযোজক-পরিচালক সুভাষ ঘাই তখন চেষ্টা করছেন অভিনেতা হওয়ার। তাঁর সঙ্গে নায়িকার কাজ করলেন ‘ভারত কে শহিদ’ সিনেমায়। সেটা কোনও দিন রিলিজ হল না। সালমান খানের বাবা, লেখক সেলিম খান তখন ঘুরছেন নায়ক হওয়ার আশায়। তাঁর সঙ্গে কাজ করলেন ‘দারা সিং’ ছবিতে; সেটাও বিশেষ কোনও সাড়া ফেলল না। 

একটু মুষড়ে পড়লেন তবসসুম; কিন্তু, ভেঙে পড়ার মানুষ তিনি কখনও ছিলেন না।

২.

পশ্চিম বান্দ্রার লাকি হোটেল ট্র্যাফিক সিগন্যালে একদিন ভিক্ষা করছিলেন পরশুরাম। চারের দশক থেকে ছয়ের দশক পর্যন্ত হিন্দি ও মারাঠি সিনেমার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা হয়তো তাঁর নাম শুনে থাকতে পারেন। অসংখ্য হিট সিনেমায় তিনি কাজ করেছেন। মাত্র একটা উদাহরণ দিই। ‘বসন্ত বাহার’ সিনেমায় (১৯৫৬) একটা দৃশ্যে রাজদরবারে দু’জন গাইছেন– একজন, ভারত ভূষণ; অন্যজন, পরশুরাম। গানটা গেয়েছেন ভীমসেন জোশি এবং মান্না দে, ‘কেতকী গুলাব জুহি চম্পক বন ফুলে…’। ভেবে দেখুন, কতটা দক্ষ অভিনেতা হলে এই দুই গায়কের যুগলবন্দিতে পর্দায় মেলানো যায় ঠোঁট ও শরীর।

ছয়ের দশকের শেষদিকে একটা দুর্ঘটনায় পা ভেঙে যায় পরশুরামের। তারপর থেকে ভাঁটা পড়ে যায় ফিল্মের অফারে; কয়েকটা সিনেমায় এক্সট্রা হিসেবে কাজ করেছিলেন, তা-ও ক্রেডিট দেওয়া হয়নি। এমনকী, তাঁর স্ত্রী-সন্তানও ছেড়ে চলে যায় তাঁকে। চূড়ান্ত হতাশায় ও অবসাদে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। সস্তা মদ কেনার টাকাও ছিল না তাঁর কাছে। তাই, আক্ষরিক অর্থে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করে জোগাড় করতেন মদের খরচ।

সেদিন, গাড়িতে যেতে যেতে, হঠাৎ তবসসুমের নজর পড়ল সেই ভিখারির দিকে। সাংঘাতিক নোংরা পোশাক পরা, এলোমেলো হয়ে যাওয়া মানুষটাকে মুহূর্তে চিনতে পারলেন তিনি। বেবি তবসসুমের অনেক চরিত্রের বাবার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন পরশুরাম। বড়পর্দার সেই ছোট্ট মেয়েটা এখন ছোটপর্দার স্টার। তখুনি গাড়িতে বসিয়ে, তাঁকে টিভি স্টেশনে গিয়ে গেলেন তবসসুম; স্নান করিয়ে, খাইয়ে, নতুন জামাকাপড় পরিয়ে, বসালেন তাঁর প্রোগ্রামে– ‘ফুল খিলে হ্যায়ঁ গুলশন গুলশন’। সেই ইন্টারভিউ টেলিকাস্ট হওয়ার পর বহু মানুষ বাড়িয়ে দিল সাহায্যের হাত, বর্ষীয়ান অভিনেতার দিকে। মুখ্যমন্ত্রীর ফান্ড থেকে অনুদান দিলেন মহারাষ্ট্রের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শঙ্কররাও চহ্বান। শিবসেনার তরফে ঘোষণা করা হল, এবার থেকে প্রতি মাসে ১০০ টাকা পেনশন পাবেন পরশুরাম। 

বেবি তবসসুম

মাত্র ৩ বছর বয়সে বেবি তবসসুম শুধু ক্যামেরার সামনেই দাঁড়ায়নি– ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র একটা শো, ‘ফুলওয়ারি’-তেও কাজ করত সে। রেডিওর পক্ষ থেকে তখন একটা পত্রিকা প্রকাশিত হত; ১৯৪৮ সালের একটা সংখ্যার প্রচ্ছদে ছিল তার মুখ। বড়বেলায় যখন তবসসুমের দিন কাটছে অগোচরে, সংসার-সন্তান এইসব নিয়ে– তখন একদিন আমিন সায়ানি তাঁকে বললেন আবার রেডিওতে ফিরতে। রেডিও সিলোনে সুযোগ করে দিলেন তিনি; হালকা হাসি-মজার প্রোগ্রাম; নাম, ‘মারাঠা দরবার কি মেহেকতি বাতেঁ’। টানা ১৮ বছর এই প্রোগ্রাম হোস্ট করেছিলেন তবসসুম।

বম্বেতে দূরদর্শন কেন্দ্র খুলেছিল অক্টোবর ২, ১৯৭২-এ। এর ঠিক এক সপ্তাহ পর, অক্টোবরের ৮ তারিখে শুরু হয় এ দেশের প্রথম টেলিভিশন টক-শো ‘ফুল খিলে হ্যায়ঁ গুলশন গুলশন’– হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির তাবড় তাবড় স্টারদের ইন্টারভিউ। সেই শো একাই সামলাতেন তবসসুম। সামলানো মানে, কোন এপিসোডে কে আসবেন, তাঁকে নিয়ে রিসার্চ করা, তাঁর সঙ্গে কো-অর্ডিনেট করা, লেখা– সবকিছু।

এই কাজটা করতে সেই সময় তাঁর থেকে পারঙ্গম সম্ভবত আর কেউ ছিলেন না। কারণ, শিশুকাল থেকেই ইন্ডাস্ট্রিতে বড় হওয়ার সুবাদে তাঁর সঙ্গে পরিচয় ও হৃদ্যতা ছিল সকলের। যেমন, ‘সংগ্রাম’ সিনেমায় (১৯৫০) নায়িকা নলিনী জয়ন্তের ছোটবেলা করেছেন তিনি আর নায়ক অশোক কুমারের ছোটবেলা করেছেন শশী কাপুর। বা, ‘জোগন’ সিনেমায় (১৯৫০) বছর পাঁচেকের মেয়েটা যখন কিছুতেই উচ্চারণ করতে পারছে না ‘ওম প্রভু শান্তি’, বারবার বলে ফেলছে ‘ওম প্রভু শান্তি’, আর চেঁচামেচি জুড়েছেন পরিচালক কেদারনাথ শর্মা– তখন পরিত্রাতা হিসেবে এগিয়ে এসেছেন নায়ক দিলীপ কুমার। বা, ছোটবেলায় বাইকুলা-গিরগাঁও এলাকায় একসঙ্গে খেলাধুলো করেছেন তিনি, জিতেন্দ্র, জয় মুখার্জি আর পরীক্ষিৎ সাহানি। অশোক কুমারের বাড়িতে বসত গল্পদাদুর আসর। দিলীপ কুমারের বাড়িতে গিয়ে অবাক মেয়েটা দেখত, দিব্যি সিঁড়িতে বসেই পুদিনার চাটনি দিয়ে খিচুড়ি খাচ্ছেন ‘দ্য কিং অফ ট্র্যাজেডি’।

সঞ্জয় দত্তর সঙ্গে তবসসুম

শুধু তাঁরাই নন, তাঁর বন্ধুত্ব ছিল পরবর্তীকালের শত্রুঘ্ন সিনহা বা অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গেও; বা আরও পরবর্তীকালের সঞ্জয় দত্ত বা শাহরুখ খানের সঙ্গেও। শত্রুঘ্ন যখন কাজ খুঁজছেন ইন্ডাস্ট্রির গোলকধাঁধায়, তখন থাকতেন খারের টোয়েন্টি-নাইন্থ রোডে; আর তাঁর পড়শি ছিলেন তবসসুম। মায়ানগরে নবাগত তরুণকে মাঝেমাঝেই খেতে ডাকতেন তিনি। সেই সম্পর্ক কোনও দিন ভোলেননি শত্রুঘ্ন। সম্মুখানন্দ হলে একদিন একটা অনুষ্ঠান চলছিল। হুইলচেয়ারে বসে অনুষ্ঠান চালনা করছিলেন তবসসুম; ক’দিন আগেই তাঁর পা ভেঙেছে। হঠাৎ আগুন লেগে গেল। সবাই চমকে উঠে শুরু করল হুড়োহুড়ি দৌড়। যে যার প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত; কারওর খেয়াল নেই, তবসসুম উঠে হাঁটতেও পারবেন না। ব্যাক-স্টেজ থেকে এগিয়ে এলেন অমিতাভ বচ্চন; হুইলচেয়ার সমেত তাঁকে বাইরে নিয়ে আসলেন বিগ বি। 

বিগ বি, তবসসুম, দিলীপ কুমার

তবসসুমের ম্যানেজার একদিন সম্মুখানন্দ হলের বাইরের রাস্তায় দেখতে পেলেন, অঙ্গভঙ্গি করে পথচলতি লোকজনকে হাসাচ্ছেন এক বেঁটেখাটো যুবক। নাম, জন প্রকাশরাও জানুমালা। তিনি তাঁকে নিয়ে এলেন তবসসুমের কাছে। তাঁর আশ্চর্য হাসানোর ক্ষমতায় মুগ্ধ হলেন তবসসুম। নিজের স্টেজ শো-তে তাঁকেও সুযোগ দিলেন তিনি। তবসসুমের পরিচালনায় একমাত্র সিনেমা, ‘তুম পর হম কুরবান’-এ (১৯৮৫) প্রথমবার পর্দায় এলেন জন জানুমালা ওরফে জনি লিভার। কুলভূষণ খারবান্দাকে নিয়ে আরেকটা সিনেমা বানিয়েছিলেন তবসসুম, ‘করতুত’ (১৯৮৭); সেটা কখনও রিলিজ হয়নি।

জনি লিভার ও তবসসুম

দিল্লিতে একটা অনুষ্ঠানে এক নাছোড় বালিকা বারবার অনুরোধ করছিল তাঁকে, তাঁর সঙ্গে স্টেজে উঠে গান গাইবে সে। রাজি নন তবসসুম। শেষমেশ, সেই মেয়ে তাঁকে গিয়ে ধরল টয়লেটে; বলল, আমার গান একবারটি শুনেই দেখুন! বলেই, গাইতে আরম্ভ করল সে। মোহিত হলেন তবসসুম। তার বাবাকে নিজের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে, মেয়েকে নিয়ে বম্বে আসতে বললেন তবসসুম। 

বালিকা যেদিন বম্বে পৌঁছল, সেদিন ছিল কল্যাণজি শাহের (সুরকার কল্যাণজি-আনন্দজি জুটির একজন) জন্মদিন। কল্যাণজিকে ফোন করে তবসসুম বললেন, জন্মদিনের উপহার পাঠাচ্ছেন তিনি। মেয়েকে ও তার বাবাকে পাঠালেন কল্যাণজির কাছে। সেদিনের সেই ১১-১২ বছরের বালিকার নাম, সুনিধি চৌহান। ‘গুলাম’ সিনেমার (১৯৯৮) বিখ্যাত ‘আতি ক্যা খান্ডালা…’ গানের কোরিওগ্রাফার, ললিপপ প্রধানও ছিলেন তবসসুমের আবিষ্কার।

সুনীতি চৌহানের সঙ্গে তবসসুম

‘ফুল খিলে হ্যায়ঁ গুলশন গুলশন’ চলেছিল ১৯৭২ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত, টানা ২১ বছর। দূরদর্শন অফিসের বাইরে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির স্টাররা অপেক্ষা করতেন, একটিবার সেই শো-তে ডাক পাওয়ার জন্য। অন্যান্য টিভি শো আর সিরিয়ালে অভিনয় করা ছাড়াও, টানা ১৫ বছর ‘গৃহলক্ষ্মী’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন তবসসুম। লিখেছেন অনেক কবিতা ও কৌতুকের বই। শেষ বয়সে খুলেছিলেন নিজের ইউটিউব চ্যানেল, ‘তবসসুম টকিজ’। জীবনের প্রথম ৩-৪টে বছর ছাড়া, সারাটা জীবন তিনি কাটিয়েছেন বিনোদনের বিভিন্ন শাখায়– ফিল্ম, রেডিও, টেলিভিশন, স্টেজ, পাবলিকেশন। এমন রেকর্ড সম্ভবত দুর্লভ।

ভাবলে আশ্চর্য লাগে, কী দুর্দম সাহসী ছিলেন তাঁর বাবা-মা। যে ইন্ডাস্ট্রিতে ছদ্মনামে কাজ করাটা প্রায় একটা রেওয়াজ– মহম্মদ ইউসুফ খান হয়ে যান ‘দিলীপ কুমার’; মেহেজাবিন বানো হয়ে যান ‘মীনা কুমারী’; মমতাজ জাহান দেহলবি হয়ে যান ‘মধুবালা’– বুঝতে নিশ্চয়ই অসুবিধা হয় না, সেই রেওয়াজের পিছনে নানা ব্যক্ত কারণ থাকলেও, কোনও অব্যক্ত অঙ্গুলিহেলনে সেইসব নাম প্রায়শ হয়ে যায় ‘হিন্দু’; কারণ, দুর্ভাগ্যজনকভাবে শব্দের উঠোনে আর ভাষার দেওয়ালে আমরা পুঁতে রেখেছি ধর্মের আমূল পেরেক– সেই রেওয়াজের ঠিক উলটো পথে হেঁটে, আসগারি আর অযোধ্যানাথ ছোট্ট কিরণবালার নাম রাখলেন খাঁটি আরবি শব্দে, ‘তবসসুম’। যদিও, সব অফিশিয়াল ডকুমেন্টে আজীবন তাঁর নাম কিরণবালাই ছিল, কিন্তু ধর্ম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে তিনি স্পষ্ট বলতেন, ‘মনুষ্যত্ব’। 

তবসসুম

শেষ করি আর একটা কথা বলে। তিনি বিয়ে করেছিলেন অরুণ গোভিলের দাদা, বিজয় গোভিলকে। অরুণ গোভিল, অর্থাৎ যিনি খ্যাতির শীর্ষে উঠেছিলেন রামানন্দ সাগরের ‘রামায়ণ’-এ (১৯৮৭-’৮৮) রামের চরিত্রে অভিনয় করে। আশঙ্কা হয়, এখন যদি ওই ‘রামায়ণ’-এর কাজ চলত, আর হিংসার একনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা ঘুণাক্ষরে জানতে পারত বিবাহসূত্রে অরুণের পরিবারেই আছেন আরবি নামধারী মানুষ, যাঁর ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র আছে করাচির মুসলমান পরিবারের সঙ্গে– তাহলে ফেসবুকীয় ফতোয়া আর ঘৃণার ঘেউ ঘেউ ছড়িয়ে পড়তে নির্ঘাত বেশি সময় লাগত না।

তথ্যসূত্র

১) ‘পরশুরাম, এ ফরগটেন জেম’, অরুণকুমার দেশমুখ, মেমসাব’স স্টোরি, জানুয়ারি ২৩, ২০১৩
২) ‘খালেদ আনসারি: এ জার্নি ফ্রম ইনকিলাব টু মিড ডে’, ফারুক লকমন, আরব নিউজ, এপ্রিল ১২, ২০১৩
৩) তবসসুমের সাক্ষাৎকার, প্যাটসি এন., রেডিফ, অক্টোবর ২৯-৩০, ২০১৪
৪) ‘স্বামী শ্রদ্ধানন্দ অ্যান্ড মহাত্মা গান্ধি’, ডঃ বিবেক আর্য, আর্য সমাজ, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৪
৫) ‘দ্য বাপ বেটি স্টোরি’, রিঙ্কি রায় ভট্টাচার্য, বিমল রায় মেমোরিয়াল সোসাইটি, মার্চ ৬, ২০২১
৬) ‘হোয়েন তবসসুম’স মাদার আসগারি বেগম বিকেম শান্তি দেবী’, সঞ্জীব নেওয়ার এবং স্বাতী গোয়েল শর্মা, স্বরাজ্য, নভেম্বর ২২, ২০২২
৭) ‘তবসসুম ওয়াজ অলওয়েজ সো হিট অ্যান্ড ফিট: শত্রুঘ্ন সিনহা’, রশ্মিলা ভট্টাচার্য, রেডিফ, নভেম্বর ২২, ২০২২