Robbar

কখন অন্যকে ‘না’ বলতে হবে, আর কখন নিজেকে ‘হ্যাঁ’ বলতে হবে– এটা জেনে ফেলাই আলোকপ্রাপ্তি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 3, 2024 6:21 pm
  • Updated:December 3, 2024 6:27 pm  

সূক্ষ্ম যৌন ঈর্ষা থেকে যৌনতা উদযাপন এবং যৌন সঙ্গী নির্বাচনের সিদ্ধান্তের সবটাই এখানে এই ছবির তিন নারী চরিত্রের হাতে। তিনজনের ভেতরে যে অল্পবয়সি মেয়েটি বাড়ি ফিরে জামা ছেড়ে, ব্রা খুলে নাইটি গলিয়ে নিয়ে স্বচ্ছন্দ হয়, সেইই যখন স্বেচ্ছায়, স্বাধিকারে খোলা প্রকৃতির মধ্যে মিলিত হয় তাঁর ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে, তখন তাঁর ব্রায়ের স্ট্র্যাপ তাঁর মিলনের আনন্দ গ্রহণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। যখন বৃষ্টি ভেজা রাতে বাড়ি ফেরার পথে প্রৌঢ় মহিলা বলে ওঠেন যে, আজ তো করবই, আর তার পরেই ঢিল ছোড়েন বহুতল আবাসনের সুন্দর বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডে, কারণ এই আবাসনের জন্যই তাঁর নিজের এই শহরের একমাত্র মাথা গোঁজার আশ্রয়টা ছেড়ে যেতে হচ্ছে! দু’জনেই তারপর হাসতে হাসতে ঢিল ছোড়ে, এই প্রতিবাদের অসারতা জেনেও এটুকু করে।

মৌপিয়া মুখোপাধ্যায়

সকালে শীতকালের ফুলকপি-আলু দিয়ে রুই মাছের ঝোল রাঁধতে রাঁধতে ফুরফুরে মনে গান গাইছিলাম। এখন সারা বছর ফুলকপি পাওয়া গেলেও আমি খুব একটা আনিও না, খাইও না– এই যে শীতের অপেক্ষাটুকু– ভালো লাগে। চেষ্টা করি সেই ছোটবেলার স্বাদ আর গন্ধ ফিরে ফিরে পেতে। আর এই আসা যাওয়ার মাঝে মাঝে অনেক নতুন-পুরনো কথাবার্তা উঁকি দেয় হৃদ-মাঝারে। যেমন বেশ কয়েক বছর আগে একটা ছবি বেশ ভালো লাগলেও, দেখতে দেখতে আমি  খুঁতখুঁত করছিলাম– গরমকালে ফুলকপি দিয়ে মাছের ঝোল রাঁধল কেন? কারণ যে সময়ের পটভূমি, সেই সময় তো কলকাতায় বা পশ্চিমবঙ্গে সম্বৎসর ফুলকপি পাওয়া যেত না! আসলে যে ছবি ভালো লাগে, মন ছুঁয়ে যায়, সেখানে এসব খুঁটিনাটি নিয়ে সামান্য খুঁত হলেও আমার মন ভারি খচখচ করে। অনেকেই ধর্ত্যবে আনেন না এসব ‘মেয়েলি’ সমালোচনা, কিন্তু আমার বদভ্যাস!  

Director Payal Kapadia arrives with 'All We Imagine as Light' - Los Angeles Times
পায়েল কাপাডিয়া

ফুলকপি সংবাদ সেই ছবির ক্ষেত্রে আমার কাছে প্রাসঙ্গিক ছিল খুঁটিনাটির প্রতি মনোযোগ জনিত কারণে। আর দিন চারেক আগে পায়েল কাপাডিয়ার নতুন ছবি ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ ছবিতে দেখলাম এইসব খুঁটিনাটি যাপন বড় যত্নে তুলে ধরা হয়েছে। এ ছবিতে নারীর যৌনতা এসেছে স্বাভাবিকভাবে। অপর্ণা সেন পরিচালিত ‘পারমিতার একদিন’ আমার মনে পড়া প্রথম বাংলা ছবি, যেখানে পারমিতার নিজের পছন্দে করা দ্বিতীয় বিয়ের পরে, যৌন মিলনের সময় তাঁকে দেখি মিলনের স্বাভাবিক আনন্দে স্বেচ্ছায় অংশীদার হতে। দেখি নারীর শরীর পুরুষ শরীরের নীচে নয়। বরং ওপরে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলাম। এই দৃশ্যটি খুব সাহসী মনে হয়েছিল নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। পায়েলের ছবি দেখতে গিয়ে আমার মনে সেই ছবির সেই দৃশ্যটি একঝলক উঁকি দিয়ে যায়। অনেক ছোট ছোট ভালো লাগার হয়তো বা ‘মেয়েলি’ মুহূর্ত ঘুরেফিরেই আসে ছবিতে। এখানে ছবির গল্প বা মূল চরিত্র তিন নারীর নাম ইচ্ছে করেই উহ্য রাখলাম। ইতিমধ্যে অনেক কথা হয়েছে সেসব নিয়ে। কিন্তু, স্থান-কাল-পাত্র বা শ্রেণিগত ভেদে মেয়েদের ক্ষমতা পরিকাঠামোয় ভিন্ন অবস্থান থাকলেও, আমার কাছে এই ছবিতে যেভাবে তাঁদের যৌনতার স্বীকৃতি, যৌন অবদমন এবং নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অথবা যৌন সুখের স্বাভাবিক চাওয়া, পাওয়া, পরিতৃপ্তি বা ফ্যান্টাসির অধিকারের বয়ান যেভাবে ‘স্বাভাবিক’ ভাবে এসেছে, মনে হয়েছে এই ছবির আখ্যান যেন আমাদের দক্ষিণ-এশিয়ার বহু মেয়েরই আখ্যান। সরকারি হাসপাতালের অল্পবয়সি এক নার্সের মুখের সামান্যতম পেশিও পরিবর্তন হয় না যখন সে শোনে তার কাছে আসা মহিলা বলছে যে তার বর ভ্যাসেক্টমি করাবে না। এটা এতই স্বাভাবিক তার কাছে যে, সে শুধু উঠে গিয়ে সেই মহিলার জন্য হাসপাতালের ফ্রি স্যাম্পেলের স্টক থেকে একপাতা গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট নিয়ে এসে ধরিয়ে দেয় বিনামূল্যেই। একটা অযথা অকারণ শব্দও সে খরচ করে না এই নিয়ে। মহিলা কীভাবে বরকে রাজি করাবে বা বর রাজি হচ্ছে না কারণ তার পৌরুষে ঘা লাগছে– এসব নিয়ে নারীবাদী কোনও জ্ঞানও দেয় না!   

All We Imagine as Light
‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ সিনেমার একটি দৃশ্য

সূক্ষ্ম যৌন ঈর্ষা থেকে যৌনতা উদযাপন এবং যৌন সঙ্গী নির্বাচনের সিদ্ধান্তের সবটাই এখানে এই ছবির তিন নারী চরিত্রের হাতে। তিনজনের ভেতরে যে অল্পবয়সি মেয়েটি বাড়ি ফিরে জামা ছেড়ে, ব্রা খুলে নাইটি গলিয়ে নিয়ে স্বচ্ছন্দ হয়, সেইই যখন স্বেচ্ছায়, স্বাধিকারে খোলা প্রকৃতির মধ্যে মিলিত হয় তাঁর ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে, তখন তাঁর ব্রায়ের স্ট্র্যাপ তাঁর মিলনের আনন্দ গ্রহণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। যখন বৃষ্টি ভেজা রাতে বাড়ি ফেরার পথে প্রৌঢ় মহিলা বলে ওঠেন যে, আজ তো করবই, আর তার পরেই ঢিল ছোড়েন বহুতল আবাসনের সুন্দর বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডে, কারণ এই আবাসনের জন্যই তাঁর নিজের এই শহরের একমাত্র মাথা গোঁজার আশ্রয়টা ছেড়ে যেতে হচ্ছে! দু’জনেই তারপর হাসতে হাসতে ঢিল ছোড়ে, এই প্রতিবাদের অসারতা জেনেও এটুকু করে। যেমন মাঝবয়সি নার্সের প্রত্যাখ্যানে তার প্রবাসী বরের কিছু যায় আসে না জেনেও সে যখন সজোরে জানাতে পারে যে ওই লোকটার স্পর্শের প্রত্যাশী সে নয় আর, তখনই কি আবার আলো জ্বলে ওঠে না? বোঁচকা বুঁচকি নিয়ে গ্রামে ফিরে আসা প্রৌঢ়া সহকর্মীকে ছাড়তে আসা অসম বয়সি সহকর্মীদ্বয় দুপুরে জমিয়ে কাঁকড়া খায়। তারপর প্রৌঢ়া যান নতুন কাজের জায়গায় দেখা করতে, অল্পবয়সি মেয়েটি যায় অভিসারে আর মাঝবয়সি মেয়েটি সমুদ্রের তীরে এক অচেনা অজানা প্রায় মৃত, সমুদ্রে ডুবে যাওয়া এক পুরুষ মানুষের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে, মুখে নিঃশ্বাস ভরে দিয়ে, হৃদপিণ্ডে ঘা মেরে মেরে বাঁচায়। তারপর তার সেবা করতে করতেই বুঝতে পারে যে, এবার ‘না’ বলা উচিত অচেনা, অজানা হয়ে যাওয়া স্বামী নামের পুরুষ মানুষটাকে, যে কিনা হঠাৎ করে বলা নেই কওয়া নেই একটা রাইস কুকার পাঠিয়ে দায় সেরেছে কিছুদিন আগেই। এই যে কখন কোথায় ‘না’ বলতে হবে, আর কখন নিজেকে ‘হ্যাঁ’ বলতে হবে আর তখন আলো জ্বলে উঠবে আমাদের মেয়েদের ঋতুকালীন, প্রাক-ঋতুবন্ধ বা ঋতুবন্ধ হয়ে যাওয়া শরীরের মনে– সেই আলোর রেশটুকু এই ছবি দেখার শেষে রয়ে যায়।  

All We Imagine As Light review: A masterpiece with strong content and performances - The South First
‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ সিনেমার একটি দৃশ্য

ছবির শেষে, হলের বাইরে যখন পায়েলের সঙ্গে কথা হল, বললাম যে, প্রতিটা চরিত্রের নখের খুঁটিনাটি এত যত্ন করে করা হয়েছে দেখে আমি খুব আপ্লুত। শুনে উনি খুব খুশি হয়ে ‘থ্যাংক ইউ’ বলে একগাল হেসে জানালেন যে, এর পিছনে প্রচুর খাটতে হয়েছে। বিশেষ করে, যখন খোলা প্রকৃতির কোলে যৌন মিলনের সময় প্রেমিক পুরুষটির দৈহিক সৌষ্ঠবের খুঁটিনাটি আমরা প্রেমিকার চোখ দিয়ে দেখি, তখন তার ময়লা ভর্তি কালো নখও দেখতে পাই। দেখার পরেই আমার এক বন্ধুর অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল। না, মিলন-টিলন অবধি বিষয়টা এগোতেই পারেনি, কারণ আড়চোখে সিনিয়র সহপাঠীর অপরিষ্কার নখ দেখেই সেই ‘ভালো লাগা’র ইতি হয়েছিল। আমার ‘মেয়েলি’ পর্যবেক্ষণ শুনে যে পরিচালক উজ্জ্বল হাসির আলো ছড়ান, তাঁর ‘নারীবাদী’ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না। পায়েলের ‘দ্য নাইট অফ নোয়িং নাথিং’ ছবির মতো এই ছবিতেও অনেক ভাষার আনাগোনা হয়তো অন্য এক ভাষ্যের দাবি রাখে! হয়তো আগামী গ্রীষ্মে কচি পটলের ডালনা রাঁধতে-রাঁধতে অন্য কোনও ভাষ্য আমার মনেও এসে যাবে! আপাতত এটুকু বলা যায়– দেখার চারদিন পরে রান্না করার সময় যে ছবির বিভিন্ন মুহূর্ত ছুঁয়ে যায় আমায়, আমি নিশ্চিত, সেই ছবি আমি মনে রেখে দেব।

…………………………………………..

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

…………………………………………..