অপরাধ ঢাকতে নারীতে পাল্টে যাওয়া যে ছবির বিষয়, সেখানে চাপা রূপান্তরকাম-বিদ্বেষ থেকে যায়
Published by: Robbar Digital
Posted on: February 27, 2025 7:47 pm
Updated: February 27, 2025 7:51 pm
পৃথিবী জুড়ে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের নিয়ে নানা সিনেমা বা সিরিজ তৈরি হওয়া একটা নবীন ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে কিন্তু সিনেমায় যৌনসংখ্যালঘু মানুষের প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজনীয়তা ও তার গুরুত্ব টপকে তা যদি অসংবেদনশীলতায় পর্যবসিত হয়, তা হলে মুশকিল। ‘এমিলিয়া পেরেজ়’ অবশ্য পুরস্কার পাচ্ছে অনেক। গত বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিল এ-ছবি। এ-বছরের অস্কারেও বহু পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। অ-ইংরেজি ছবি হিসেবে মনোনয়নের ইতিহাস গড়েছে। এমনকী ‘এমিলিয়া পেরেজ়’ চরিত্রে অভিনয়ের সূত্রে অস্কারের ইতিহাসে কার্লা সোফিয়া গ্যাসকিয়ন প্রথম কোনও রূপান্তরকামী-নারী যিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী’র মনোনয়ন পেয়েছেন। কিন্তু সেই চরিত্রের যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে।
ভাস্কর মজুমদার
তাঁর মা ছিলেন কনসার্টের পিয়ানোবাদক। সাত-আট বছর আগে গত হয়েছেন। বাবা আগাগোড়া একজন তোলাবাজ। বিভিন্ন ধরনের ঠকবাজির সঙ্গে যুক্ত। এখন ছেলেকে তিনি নানা রকমের অন্যায় কাজে নিযুক্ত করেন, যেগুলোর মধ্যে সবথেকে বেশি হল অসহায় মানুষদের মেরে ধরে বাড়ি খালি করানো। সেই ছেলেটি, টম, মায়ের স্মৃতি বুকে নিয়ে ঘোরে কিন্তু তার এখনকার জীবনযাপনের সঙ্গে মায়ের আদর্শের আর কোনও যোগই নেই। কেবল একদিন এক অনুষ্ঠানে মায়ের প্রাক্তন ম্যানেজারের সঙ্গে তার রাস্তায় হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। দু’-একটি বাক্যালাপের পর প্রবৃদ্ধ ম্যানেজার ব্যক্তিটি টমকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার তো ছোটবেলায় পিয়ানোর ভালো হাত ছিল? এখন আর প্র্যাকটিস করো না?’
ব্যস, এই কথাটা টমের জীবন পুরোপুরি বদলে দেয়। সে পাগলের মতো পিয়ানো বাজানোর প্রতি মশগুল হয়ে যায়। তার তোলাবাজি-প্রোমোটারির জীবন, বন্ধুর বউয়ের সঙ্গে প্রেম, প্রতিদিনকার হিংসাশ্রয়– এ-সবকিছু পিছনে পড়ে যায়। উত্তরণের গল্প যে কী অপূর্ব গাঁথা যায়, তা জ্যাক ওদিয়র আমাদের দেখিয়েছিলেন সেই ২০০৫ সালে তাঁর ‘দ্য বিট দ্যাট স্কিপড মাই হার্ট’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। তারপর ২০০৯ সালে এল তাঁর আরেকটি অনবদ্য নির্মাণ ‘আ প্রফেট’। মাঘরেবি বংশোদ্ভূত মালিক নামক যুবকটি কীভাবে করসিকান কয়েদিদের সঙ্গে টিকতে পারল আর কীভাবেই বা সে হয়ে উঠল এক দৈবজ্ঞ– সে কাহিনি যে না দেখেছে, তার পক্ষে সে-নির্মাণের রসাস্বাদন সম্ভব নয়। ‘রাস্ট অ্যান্ড বোন’ (২০১২) কিংবা ‘ধীপন’ (২০১৫) সিনেমা দিয়ে জ্যাক ওদিয়রের বলিষ্ঠ ছবি-করিয়ে হিসেবে যে খ্যাতি, তা বেড়েছে। সমাজের তলানিতে থাকা মানুষগুলোর কথা, একটা সরলরেখা গল্পের সিনেমাশৈল্পিক নানা দিক খুলে যাওয়া, প্রতিটি চরিত্রের সঙ্গে ক্যামেরার লেপ্টে থাকা, এক যন্ত্রণাঘন সঙ্গীত আবহ– এসব যেন জ্যাক ওদিয়রের হস্তাক্ষর হয়ে উঠেছে ক্রমশ। বড় বড় ফিল্মোৎসব থেকে তাঁর পুরস্কারও কিছু কম জোটেনি। তিনি অচিরেই আমাদের প্রিয় ও আধুনিক কালের এক অনন্যসাধারণ ‘অটার’ হয়ে উঠেছেন।
‘এমিলিয়া পেরেজ’-এর একটি দৃশ্য
কিন্তু অনেক বিষয় থাকে, যা অতি বড় পরিচালক হলেও যে খুব সঠিক সঞ্চালনা করে উঠতে পারেন, তা নয়। সাম্প্রতিক ‘এমিলিয়া পেরেজ’-এ জ্যাক ওদিয়র অনেক কিছু একসঙ্গে মেলাতে গিয়ে যারপরনাই গোল বাঁধিয়েছেন। প্রথমত মিউজিক্যাল ব্যাপারটা তাঁর আসে না। মিউজিক্যাল নির্মাণ করা এত সহজও না। আমরা বব ফসে (অল দ্যাট জ্যাজ), বাজ় লাড়ম্যান (মুলাঁ রুজ) কিংবা রব মার্শাল (শিকাগো বা নাইন) যা মিউজিক্যাল সিনেমা দেখেছি, তাতে লক্ষ করেছি তাঁরা প্রধানত কোরিওগ্রাফার ছিলেন। পরে যখন ফিল্মপরিচালক হয়েছেন, তাঁদের সিনেমাশিল্পে মিউজিক্যাল তৈরি করার ক্ষমতা ও পরিবেশনা সার্থকভাবে মিশে গেছে। এমনকী লার্স ভন ত্রিয়ের-এর ‘ডান্সার ইন দ্য ডার্ক’-এও মিউজিক্যাল যে কাঠামো, তাও অপূর্ব সুন্দর কারণ সেখানে প্রধান চরিত্র তীব্র দারিদ্র-দুর্ভাগ্যের মধ্যেও সঙ্গীতশিল্পী হতে চায়। কিন্তু জ্যাক ওদিয়রের ‘এমিলিয়া পেরেজ’-এ তেমন কোনও সংগীতের সাব-প্লটই নেই, অথচ চরিত্রেরা হঠাৎ হঠাৎ গান গেয়ে উঠছেন অনেকটা ভারতীয় সাত-আটের দশকের সিনেমার মতো!
তবু ধরা গেল পরিচালকের ইচ্ছা হয়েছে তিনি একটি মিউজিক্যাল তৈরি করবেন, তাই করেছেন। তাতে আমাদের অসুবিধা থাকার কথা নয়। কিন্তু সে-কারণে যে গল্প তিনি নির্মাণ করেছেন তা বেশ দুর্বল। মেক্সিকোর একজন ড্রাগ-কার্টেল মালিক হুয়ান মানিতাস দেল মোন্তে (কার্লা সোফিয়া গ্যাসকিয়ন) নিজের পরিচয় গোপনের জন্য শল্যচিকিৎসার সাহায্যে নারীতে পরিণত হবেন। তিনি রিতা মোরা কাস্ত্রো (জো সালদানা) নামক একজন উকিল ঠিক করেন, যে সারা পৃথিবী ঘুরে তেল আভিভ থেকে এক শল্যচিকিৎসক প্রায় ধরে আনে। যিনি মানিতাসকে নারীতে পরিণত করেন। কাহিনির এ-জায়গাটা এত দুর্বল যে মনে হয় রূপান্তরকামিতা জিনিসটা যেন কত সহজ। যে চাইবে যখন তখন লিঙ্গ বদলে নিতে পারবে। যদিও ‘জেন্ডার ডিসফোরিয়া’-র একটা ছোট সাব-প্লট আছে, তবু মানিতাসের ‘এমিলিয়া পেরেজ’-এ পরিণত হওয়াটা দেখে মনে হয় পরিচালক যেন জানেনই না আজও পৃথিবীতে একজন রূপান্তরকামী মানুষের জীবন কতটা দুর্বিসহ। একজন পুরুষ নিজের অপরাধমূলক কার্যকলাপ ঢাকতে নারীতে পাল্টে যাচ্ছে যে ছবিতে দেখানো হয়, তাতে অল্প হলেও চাপা রূপান্তরকামী-বিদ্বেষ যে রয়ে যায় তা নিয়ে সন্দেহ থাকে না। তাও না হয় বোঝা গেল যে ছবির সংলাপ মানে অকারণ গান সেখানে গল্পের গরু যে-কোনও গাছেই চড়ানো সম্ভব। কিন্তু জ্যাক ওদিয়রকে তা করতে হচ্ছে দেখলে দর্শকদের মোটে ভালো লাগে না।
এমনিতে পৃথিবী জুড়ে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের নিয়ে নানা সিনেমা বা সিরিজ তৈরি হওয়া একটা নবীন ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে কিন্তু সিনেমায় যৌনসংখ্যালঘু মানুষের প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজনীয়তা ও তার গুরুত্ব টপকে তা যদি অসংবেদনশীলতায় পর্যবসিত হয়, তা হলে মুশকিল। ‘এমিলিয়া পেরেজ’ অবশ্য পুরস্কার পাচ্ছে অনেক। গত বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিল এ-ছবি। এ-বছরের অস্কারেও বহু পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। অ-ইংরেজি ছবি হিসেবে মনোনয়নের ইতিহাস গড়েছে। এমনকী ‘এমিলিয়া পেরেজ’ চরিত্রে অভিনয়ের সূত্রে অস্কারের ইতিহাসে কার্লা সোফিয়া গ্যাসকিয়ন প্রথম কোনও রূপান্তরকামী-নারী যিনি ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী’-র মনোনয়ন পেয়েছেন। কিন্তু সেই চরিত্রের যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে।
তবে এত কিছু না ভাবলে ‘এমিলিয়া পেরেজ’ বসে দেখা যায়। মাথা না ঘামালে আর পরিচালকের নাম না জানলে মধ্যমানের হলেও এমন ছবি তো কতই তৈরি হয় বলে সান্ত্বনা পাওয়া যায়। অনেকেই জো সালদানা বা কার্লা সোফিয়া গ্যাসকিয়ন-এর অভিনয় নিয়ে বলছেন, তবে এ-সিনেমায় যদি সত্যি অনবদ্য অভিনয় কেউ করে থাকেন তবে তিনি সেলেনা গোমেজ। মানিতাসের স্ত্রী হিসেবে জেসি চরিত্রে তাঁর অভিনয় মনে রাখার মতো। ওই যে দৃশ্য যেখানে এমিলিয়া বলছে সে আসলে মানিতাস, সে একজন রূপান্তরিত নারী সেখানে সেলেনা গোমেজ-এর প্রথমে অবাক হয়ে ওঠা তারপর রাগ-অভিমান-কান্নার অভিব্যক্তি যেন অত্যাশ্চর্য! অথচ অস্কারে সেলেনার কোনও মনোনয়নই নেই।
‘এমিলিয়া পেরেজ’ অস্কারে অনেক ক্ষেত্রেই পুরস্কৃত হতে পারে আবার একেবারে মুখ থুবড়েও পড়তে পারে। কিন্তু আমাদের আশা থাকবে পরিচালক জ্যাক ওদিয়র তাঁর চেনা গণ্ডিতে ফিরে গিয়ে আগের মতো অনন্যসাধারণ কিছু সিনেমা আবারও নির্মাণ করবেন।
শুধু ঘরের ভেতরটা নয়, বো-ব্যারাকের বাইরেটাও ছিল আমাদের পরিবার
বো-ব্যারাকের জীবন, কীরকম ছিল তাঁদের অতীত? কতটা বদলেছে তাঁদের বেঁচে থাকা? ক্রিসমাসেরই বা কতটা বদল? স্মৃতির সিন্দুক খুললেন এরল ভ্যানগার্ড। বো-স্ট্রিটের অন্যতম স্মৃতির ধারক-বাহক।
‘শ্রুতি’-র মোট চোদ্দোটি সংখ্যার একটিরও সম্পাদক পুষ্কর দাশগুপ্ত নন
নিভৃতে এবং প্রায় নীরবেই ফরাসি সাহিত্যের যেসব অবিস্মরণীয় অনুবাদ তিনি করে রেখে গেছেন, তা তাঁর আজীবন সাহিত্য প্রেমেরই দোসর। লিখছেন সৌম্যব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়